সিরাজগঞ্জ
নদী খননের নামে বালু বিক্রি, ঝুঁকিতে দুই সেতু
সিরাজগঞ্জে সরকারি নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কা না করে উল্লাপাড়া ও রায়গঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী ফুলজোর নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জে কে কনস্ট্রাকশন। বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম মহাসড়কের ফুলজোড় নদীর ওপর নবনির্মিত নলকা সেতু ও পুরাতন সেতুর নিচ থেকে বালু তোলার কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে সেতু দুটি। যা বালু ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ওই সেতু দুটি সংলগ্ন জায়গা থেকে খননযন্ত্রের মাধ্যমে তোলা সেই বালু দীর্ঘ পাইপলাইন দিয়ে নিয়ে ফেলা হচ্ছে উল্লাপাড়া উপজেলার পাঁচলিয়া এলাকায় মহাসড়কের পাশে সাসেক প্রকল্প-২ এর নির্মাণাধীন সার্ভিস সেন্টারে। এতে মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে সেতু দুটি। এই অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন জেলার সচেতন মহল।
আরও পড়ুন: ইছামতী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন, জানে না প্রশাসন
জে কে কনস্ট্রাকশন দুটি খননযন্ত্র বসিয়ে সেতুর প্রায় ৫০ মিটার দক্ষিণে ফুলজোর নদী থেকে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

তাদের অভিযোগ, নদীর এই অংশ এমনিতেই গভীর হওয়ায় এখানে দীর্ঘদিন বালু উত্তোলন বন্ধ ছিল। তবে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় এখানে খননযন্ত্র বসিয়ে আবারও মহাসড়কের পাশ দিয়ে পাইপলাইন করে দেদারছে অবৈধ বালু উত্তোলন করে সাসেক প্রকল্পের জায়গা ভরাট করা হচ্ছে।
শনিবার (১০ জুন) বিকেলে সরেজমিনে নলকা সেতু এলাকায় গেলে দেখা যায়, সেতু দুটির নিচে দক্ষিণপাশে ফুলজোর নদীতে চারটি বাল্কহেড ভাসছে। এর ওপর দুটি বালু তোলার যন্ত্র বসানো হয়েছে। একটি যন্ত্র থেকে পাইপ নদীতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই পাইপ দিয়ে নদী থেকে বালু তোলা হচ্ছে। অপর যন্ত্রটি পানির সঙ্গে সেই বালু মোটা লোহার পাইপের মাধ্যমে সামনে ঠেলে দিচ্ছে। মহাসড়কের পাশ দিয়ে প্রায় ৫০০-৬০০ মিটার দূরে বালু গিয়ে পড়ছে সাসেক প্রকল্পের নির্মাণাধীন সার্ভিস সেন্টারে। বালু পড়ে উঁচু হচ্ছে এই প্রকল্পের নিচু অংশ।
নদীতে বালু তোলার কাজ তদারকি করছিলেন ছয় শ্রমিক। এই কর্মযজ্ঞের চারপাশে পাহারায় নিয়োজিত আছেন আরও চার থেকে পাঁচজন। তাদের মধ্যে মুকুল হোসেন নামে এক কর্মীকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, এই খনন কাজটি সিরাজগঞ্জের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জে কে কনস্ট্রাকশন বাস্তবায়ন করছে। আমরা কজন এটি দেখভাল করি।
স্থানীয় নলকা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে এই চক্রটি নদী খননের নামে নলকা সেতুর দক্ষিণ দিকে ৫০ থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে খননযন্ত্র বসিয়ে সেতুর নিচ থেকে পাইপলাইন করে ৫০০-৬০০ মিটার দূরে নদীর বালুগুলো নিয়ে বিক্রি করছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলে কোনো লাভ হয় না।
আরও পড়ুন: অবৈধ বালু উত্তোলন, আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলা
তিনি বলেন, আমরা ছোট মানুষ। তারা আমাদের বোঝায় যে ওপর থেকে অনুমতি নিয়েই তারা এই বালুগুলো নিয়ে যাচ্ছে। তবে এভাবে চুরি করে বালু তোলা হলেও প্রশাসন যেন দেখেই দেখে না। এটি চলমান থাকায় সেতু দুটি হুমকির মধ্যে রয়েছে।
উল্লাপাড়া উপজেলার পাঁচলিয়া গ্রামের বাসিন্দা হারুন অর রশিদ বলেন, খননের নামে নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু তুলে পাইপলাইনের মাধ্যমে সাসেক প্রকল্প-২ এর নির্মাণাধীন সার্ভিস সেন্টারে দেওয়া হচ্ছে। এতে নদীর একই স্থানে গভীরতার সৃষ্টি হচ্ছে। সেতু দুটির যে কোনো সময় বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। আমরা বাঁধা দিলেও শোনেনি ঠিকাদার।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী লোকমান হাকিম জাগো নিউজকে বলেন, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০ অনুযায়ী, বিপণনের উদ্দেশে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে পাম্প বা খনন বা অন্য কোনো মাধ্যমে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এছাড়া সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন করা যাবে না।
সিরাজগঞ্জ স্বার্থ রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক জহুরুল হক বলেন, অপরিকল্পিতভাবে নানা অজুহাতে অবাধে নদীর বালু তুলে বিক্রি করা বন্ধ করতে হবে। সেইসঙ্গে এই চক্রটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি প্রশাসনের কাছে দাবি জানান।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিরাজগঞ্জ জেলা আহ্বায়ক কমিটির সভাপতি দীপক কুমার কর বলেন, এমন করেই নদী খননের নামে জেলার বিভিন্ন স্থানে বালু বিক্রির মহোৎসব শুরু হয়েছে। এতে করে নদীগুলো তাদের বৈচিত্র্য হারাচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী দিদারুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, সেতু হুমকিতে ফেলে এর আশপাশের এলাকা থেকে বালু উত্তোলন অত্যন্ত দুঃখজনক। বিষয়টি দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে বালু উত্তোলনকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, প্রতি সিএফটি চার টাকা হিসেবে চার কোটি ৫০ লাখ সিএফটি বালু সরবরাহের জন্য সাসেক প্রকল্প-২ এর ঠিকাদারের সঙ্গে সহযোগী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে জে কে কনস্ট্রাকশন। এরইমধ্যে তারা প্রকল্পটির প্রায় ৭৫ শতাংশ বালু ভরাট সম্পন্ন করেছে। এ প্রকল্পের শতভাগ বালু ভরাট সম্পন্ন হলে চুক্তি অনুযায়ী ১৮ কোটি টাকা পাবে এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অথচ নদী থেকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বালু উত্তোলন করছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জে কে কনস্ট্রাকশনের পরিচালক কে এম তানভির ইসলাম শুভ জাগো নিউজকে বলেন, আমরা নদী খনন প্রকল্পের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অলিখিত চুক্তি করে এই বালুগুলো আমাদের সরবরাহ কাজে ব্যবহার করছি। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন অবগত আছে।

আরও পড়ুন: নাফ নদ থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন, জরিমানা ২ লাখ
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, ফুলজোর নদী খননের জন্য একটি প্রকল্প চলমান আছে। তবে খনন করে সেই বালু বা মাটি নদীর তীরে জমা রাখতে হবে। নিয়মবহির্ভূতভাবে এখান থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রির কোনো সুযোগ নেই।
এ প্রসঙ্গে সিরাজগঞ্জের জেলা নদী রক্ষা কমিশন ও মাটি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মীর মোহাম্মাদ মাহবুবুর রহমান বলেন, অনুমোদিত বালুমহাল ছাড়া নদী থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। তবে না না কৌশলে যারা এমনটি করছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমআরআর/এএসএম