এক ব্রিজে দুঃখ ঘুচবে ৩০ হাজার মানুষের
একটি ব্রিজের অভাবে রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়নের হরিণবাড়ীয়া চরের পাঁচটি ওয়ার্ডের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। ওই ইউনিয়নের পদ্মার কোল এলাকায় হিরু মোল্লার ঘাটে একটি ব্রিজ নির্মাণ হলে এই ভোগান্তি থেকে মুক্তি মিলবে। ব্রিজ না থাকায় চরের বাসিন্দাদের ইউনিয়নের মূল ভূখণ্ড বা উপজেলা শহরে যাতায়াতে এখনো একমাত্র ভরসা নৌকা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে হিরু মোল্লার ঘাটে ব্রিজ নির্মাণের কথা শুনে আসলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বাধ্য হয়ে যানবাহনসহ ঝুঁকি নিয়ে তারা খেয়া নৌকায় পারাপার হন। এসময় বাঁশের মাচালী দিয়ে নৌকায় উঠতে বা নামতে গিয়ে অনেকে পানিতে পড়ে যান। একবার খেয়া মিস করলে আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এতে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা, ক্লাস, প্রাইভেটে যেতে দেরি হয়ে যায়। এছাড়া নৌকায় রোগী আনা-নেওয়া ও কৃষিপণ্য বাজারজাতে সমস্যায় পড়তে হয়। একটি ব্রিজ হলে চরের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণসহ সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটবে।

রতনদিয়া ইউনিয়নের প্রায় অর্ধেক অংশ পদ্মা নদী সংলগ্ন হরিণবাড়ীয়া চরে। চরের বাসিন্দারা দিনে খেয়া বা ব্যক্তিগত নৌকায় পারাপার হলেও সন্ধ্যায় নামলেই তারা হয়ে যান বিচ্ছিন্ন এক জনপদের বাসিন্দা। শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে গেলে কোনোরকম যাতায়াত করা গেলেও বর্ষায় নৌকার বিকল্প নেই। নৌকায় ওঠা-নামার জন্য করা হয়েছে বাঁশের মাচালীর ঘাট, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
আরও পড়ুন: সেতুর অভাবে দুর্ভোগে ১৫ গ্রামের মানুষ
জানা গেছে, রতনদিয়া ইউনিয়নটির প্রায় অর্ধেক অংশ পড়েছে পদ্মার কোল চরে (৩, ৪, ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড)। এরমধ্যে তিনটি ওয়ার্ডের আংশিক ও দুটি ওয়ার্ড সম্পূর্ণ চরের মধ্যে পড়েছে। সেখানে কয়েকটি স্কুল ও হাট-বাজারসহ রয়েছে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। তাদের সবাইকে উপজেলা শহরে আসতে হিরু মোল্লার ঘাট পাড়ি দিতে হয়। ঘাটের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের দূরত্ব প্রায় দেড়শ গজের মতো।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চরের বেশিরভাগ পরিবারের মূল পেশা কৃষিকাজ। চরের উর্বর মাটিতে ভালো ফসল উৎপাদন হয়। কিন্তু একটি ব্রিজের অভাবে তারা সবদিক থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কৃষিপণ্য বাজারজাত করা, রোগীদের হাসপাতালে নেওয়া, শিক্ষার্থীসহ সবার উপজেলা শহরে যাতায়াতের একমাত্র ভরসা নৌকা। তারা জরুরি প্রয়োজনে উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদে যেতে পারেন না। আর কোনো বিপদে পড়লে তাদের ভোগান্তির সীমা থাকে না। তাদের অভিযোগ, নির্বাচনের সময় জনপ্রতিনিধিরা এসে অনেক প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু নির্বাচনের পর সব ভুলে যান।
কলেজ পড়ূয়া শিক্ষার্থী শান্ত জানান, প্রতিদিন পড়াশোনার জন্য শতশত শিক্ষার্থীকে চর থেকে কালুখালীতে যেতে হয়। সবাইকে ঘড়ি ধরে ঘাটে আসতে হয়। নৌকা মিস করলে কমপক্ষে আধাঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এতে করে পরীক্ষা ও প্রাইভেটে সময়মতো পৌঁছাতে সমস্যা হয়। নৌকায় মোটরসাইকেল তুলতেও সমস্যা হয়। সামান্য এদিক-ওদিক হলে পানিতে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। এতে করে পড়াশোনার উৎসাহ হারাচ্ছে শিক্ষার্থী।

কৃষক আব্দুল ওহাব বলেন, হিরু মোল্লার ঘাটে একটি ব্রিজ চরবাসীর জন্য অতিপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষিকাজ করে আমার সংসার চলে। কিন্তু যে ফসল ফলাই তা বিক্রিতে খুব কষ্ট করতে হয়। ফসল কালুখালীর বাজারে নিতে অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়। আবার অনেক সময় নৌকা থেকে কৃষিপণ্য পানিতে পড়ে যায়। একটি ব্রিজ থাকলে অল্প সময়ের মধ্যে ফসল বিক্রি করতে পারলে দামও ভালো পেতাম। আমার মতো চরের হাজার হাজার কৃষক এমন দুর্ভোগে আছেন।
আরও পড়ুন: সেতুর অভাবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন লক্ষাধিক মানুষ
ঘোড়াগাড়ির চালক আলাল জানান, তিনি ঘোড়ার গাড়িতে ফসলাদিসহ মালামাল আনা-নেওয়া করে সংসার চালান। কিন্তু ব্রিজ না থাকায় এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে পারেন না। এতে আয়-রোজগার কমে গেছে। জরুরি প্রয়োজনে ঝুঁকি নিয়ে ওইপাড়ে যেতে হলে ঘোড়াসহ গাড়ি সাঁতরে পানির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।

গৃহবধূ শিল্পী খাতুন জানান, তার বাবার বাড়ি চরে, আর শ্বশুরবাড়ি কালুখালীতে। শিশু সন্তান নিয়ে নৌকায় আসা-যাওয়া করতে খুব কষ্ট হয়। আবার খেয়া নৌকা না পেলে দীর্ঘসময় ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চরের মাধবপুর বাজারে যাওয়ার জন্য হিরু মোল্লার ঘাট থেকে কোম্পানির মালসহ ভ্যান নৌকায় তুলতে গিয়ে তিনি নদীতে পড়ে যান। এতে ব্যাগে থাকা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ তিনি ভিজে যান। পরে ভেজা কাপড়েই তাকে যেতে হচ্ছে। এভাবে মাঝেমধ্যে অনেকেই পড়ে যান। একটি ব্রিজ থাকলে তাদের এভাবে দুর্ভোগে পড়তে হতো না।
রতনদিয়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. লতিফ মোল্লা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি হিরু মোল্লার ঘাটে ব্রিজ হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত দৃশ্যমান কিছুই হয়নি। চরে প্রায় পাঁচটি ওয়ার্ডের ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। ব্রিজের অভাবে তাদের সন্তানদের স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়া ও মালামাল আনা-নেওয়ায় খুবই কষ্ট হয়। অনেক সময় তারা পানিতে পড়ে যান। বিশেষ করে মোটরসাইকেল, ভ্যান, রিকশা নিতে খুব কষ্ট হয়। চরের বাসিন্দারা ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কালুখালী আসতে পারেন না। দ্রুত ব্রিজ নির্মাণ হলে পুরো রতনদিয়াবাসী উপকৃত হবে।

কালুখালী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলিউজ্জামান চৌধুরী টিটো বলেন, হিরু মোল্লার ঘাটে ব্রিজ নির্মাণের জন্য অনেক আগে থেকেই রাজবাড়ী-২ আসনের এমপি জিল্লুল হাকিমসহ আমরা জোর চেষ্টা করছি। মাপজোখসহ সেখানকার মাটি পরীক্ষা হয়ে গেছে। এখন নির্মাণ খরচ নিয়ে আলোচনা চলছে।
আরও পড়ুন: এক সেতুর অভাবে দুর্ভোগে ২০ গ্রামের মানুষ
তিনি বলেন, চর এলাকায় হাজার হাজার মানুষের বসবাস। ব্রিজটি তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিজ না থাকায় চরের বাসিন্দারা কৃষিপণ্য বাজারে আনা-নেওয়াসহ শিক্ষা-স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ব্রিজটি নির্মাণ হলে কৃষিপণ্য বাজারজাতসহ সব ধরনের সুবিধা পাবে চরবাসী। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন হবে।
তবে এ বিষয়ে এলজিইডির কালুখালীর উপজেলা প্রকৌশলী মো. তৌহিদুল হক জোয়ার্দ্দার কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
এমআরআর/জিকেএস