বয়স ১২ হলেই বিয়ে


প্রকাশিত: ০৮:১৪ এএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪

নাওভাঙ্গা ও কুলুরচর দুটি গ্রাম। গ্রাম দুটির এক অংশ জামালপুর আর অপর অংশ শেরপুর জেলা। জামালপুর জেলা শহরের গা-ঘেঁষা নদী বেষ্টিত অবহেলিত গ্রাম দুটিতে ঠিকভাবে পৌঁছেনি সভ্যতার ছোঁয়া, নেই কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্র, গড়ে উঠেনি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তার উপর প্রতিবছর নদী ভাঙ্গন।

সকল নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত গ্রাম দুটিতে চলছে বাল্য বিয়ের হিড়িক। অশিক্ষিত আর নিম্নআয়ের পেশায় জড়িত স্বজনরা মেয়ের বয়স ১২ হলেই বসিয়ে দিচ্ছে বিয়ের পিঁড়িতে। প্রতি বছর ৮ থেকে ১০টি বাল্য বিয়ের ঘটনা ঘটলেও সীমানা জটিলতার কারনে কোন পদক্ষেপ নিতে পারছে না প্রশাসন।

১২ বছরের হালিমার বিয়ে হয়েছে বছর দুই আগে। রিক্সাচালক বাবার রোজগারে সংসারই চলে না, তাই অভাবের সংসারে চতুর্থ শ্রেণীর গন্ডি পেরুবার আগেই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন প্রতিবেশী ফারুকের সাথে। চৌদ্দ বছরের রিতার বিয়ে হয়েছে সপ্তাহখানেক হলো। আট ভাইবোনের বিশাল সংসারে লেখাপড়া করা হয়ে উঠেনি তার। তাই বিয়ের পরই স্বামী সাজু মিয়ার সংসারের দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছে রিতা।

চৌদ্দ বছরের রুবিজার বাবা রোজগার করে না, তাই অন্ধ মা সারাদিন ভিক্ষা করে যা রোজগার করের তাই দিয়ে কোন রকমে চলছিলো তাদের সংসার। অভাবের সংসারে লেখাপড়া করা হয়ে উঠেনি, অল্প বয়সেই বাবা বিয়ে দিয়েছেন একই গ্রামের রুবেলের সাথে। স্বামী ছাড়াও শ্বশুড়-শ্বাশুড়ী, ননদ-ভাসুরের বড় সংসারের দায়িত্ব এখন তার কাঁধে।

শুধু এরা তিনজনই নয়, নাওভাঙ্গা এবং কুলুরচর গ্রামের বাতাসী, বিউটি, জামেলা, চায়না, ঝর্না, শিউলীর মতো শতাধিক মেয়ে বাল্য বিয়ের শিকার। ব্রহ্মপুত্র নদের দুটি শাখা নদী  নাওভাঙ্গা আর কুলুরচর গ্রাম দুটিকে দুই জেলা থেকে আলাদা করে রেখেছে। শেরপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে হলেও জামালপুর জেলা শহর থেকে নাওভাঙ্গা এবং কুলুরচর গ্রামের দুরত্ব ব্রহ্মপুত্র শাখা নদের উপর পায়ে হাটা ৩শ’ ফুটের কাঠের একটি ব্রিজের ব্যবধান মাত্র। অথচ গ্রাম দুটিতে সেভাবে পৌঁছেনি সভ্যতার ছোঁয়া।

প্রায় আড়াইশ পরিবারের জনবসতিপূর্ণ গ্রাম দুটির বাসিন্দারা সেলুন কর্মচারী, সবজি, বাদাম, চটপটি, ঝাল মুড়ি বিক্রেতার মতো নিম্নআয়ের পেশায় জড়িত। আর গত কয়েক বছর ধরে ব্রহ্মপুত্র নদের অব্যাহত ভাঙ্গনে গ্রাম দুটির প্রায় অর্ধেকটাই নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় অনেকেই আবার গৃহহীন।

গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও বছর তিন আগে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় অবহেলিত গ্রাম দুটিতে শিক্ষার আলো ছড়ানোর শেষ প্রদীপটিও নিভে গেছে। ফলে অশিক্ষিত আর নিম্নআয়ের পেশায় জড়িত বাবা-মা তাদের মেয়ের বয়স ১২ কিংবা ১৪ হলেই বসিয়ে দিচ্ছে বিয়ের পিঁড়িতে।

বাল্য বিয়ের শিকার এসব মেয়েরা অপ্রাপ্ত বয়সে সন্তান ধারনের ফলে ভুগছে নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে, এমনকি অল্প বয়সে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ঘটেছে একাধিক মাতৃ মৃত্যুর ঘটনাও। গ্রামে কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্র না থাকায় নূন্যতম স্বাস্থ্য সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে এসব মেয়েরা।

জেলা প্রশাসনের দৃষ্টি সীমায় থাকা গ্রাম দুটিতে প্রতি বছর ৮ থেকে ১০টি বাল্য বিয়ের ঘটনা ঘটলেও দুই জেলার সীমানা জটিলতার কারনে কোন পদক্ষেপ নিতে পারছে না প্রশাসন। অশিক্ষা, দারিদ্রতা আর আইনি জটিলতার ফাঁক গলিয়ে দিনের পর দিন গ্রাম দুটিতে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে বাল্য বিয়ের সংখ্যা।

কুলুরচর গ্রাম পঞ্চায়েতের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আব্দুল মালেক বলেন, গ্রামটা দুই জেলার সীমানায় হওয়ায় আমরা পুরোপুরি অবহেলিত। প্রতি বছরের নদী ভাঙ্গনে গ্রামের অর্ধেকটাসহ একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিলো সেটাও নদীগর্ভে। গ্রামের কিছু ছেলে-মেয়ে নদী পার হয়ে জামালপুর শহরে পড়তে আসলেও থ্রি-ফোর পর্যন্ত পড়ার পর তারাও ঝড়ে পড়ে। অভাব-অনটনের সংসারে বাবা-মারাই ছোট মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছে। কোন সমস্যায় পড়লে আমরা জামালপুরের সহযোগিতাও পাইনা আবার শেরপুরের প্রশাসনও আমাদের খেয়াল রাখেনা। শুধুমাত্র নির্বাচন আসলেই গ্রামের লোকজনদের খোঁজ-খবর নেওয়া হয়।

জামালপুর তরঙ্গ মহিলা কল্যাণ সংস্থার সভানেত্রী শামীমা খানম জানান, দেশের অন্যান্য জেলার চাইতে জামালপুরে বাল্য বিয়ের হার এমনিতেই বেশি। আর শহরঘেষা নাওভাঙ্গা এবং কুলুরচর গ্রাম দুটিতে শিক্ষিত লোক নেই বললেই চলে, যে কারনে বাল্য বিয়ে এখানে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। তবে জামালপুর ও শেরপুর জেলা প্রশাসন সার্বিক সহযোগিতা করলে গ্রাম দুটিতে বাল্য বিয়ে ছাড়াও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কাজ করা সম্ভব হবে।

জামালপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বাল্য বিয়ের কথা স্বীকার করে বলেন, সীমানা জটিলতার কারনে গ্রাম দুটিতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না, তবে বিভিন্ন এনজিও’র মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সীমানা জটিলতা সমাধান করা গেলে বাল্য বিয়ে বন্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।