বেসরকারি কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে চার্জ বৃদ্ধি, রপ্তানিতে নতুন শঙ্কা

ইকবাল হোসেন
ইকবাল হোসেন ইকবাল হোসেন , নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ০১:৩৩ পিএম, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
১৯টি বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে বিভিন্ন সেবায় চার্জ বাড়িয়েছে বিকডা, ছবি: জাগো নিউজ
  • • বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে চার্জ বাড়লো গড়ে ৫০ শতাংশ
  • • রপ্তানিকারকরা বলছেন, বিদেশি বায়াররা বাংলাদেশ বিমুখ হবে
  • • ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বিকডা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না
  • • চার্জ বাড়ানো নিয়ে বিকডার দাবি, ডলারের দাম সমন্বয় করা হয়েছে

দেশের ১৯টি বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে বিভিন্ন সেবায় চার্জ বাড়িয়েছে বেসরকারি ডিপো মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা)। আগের চেয়ে গড়ে ৫০ শতাংশ চার্জ বাড়ানো হয়েছে। যা ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, এর ফলে ঝুঁকি আর শঙ্কার মধ্যে পড়েছে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, বেসরকারি ডিপোগুলোতে ট্যারিফ বাড়ানোর কারণে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হবে। বিশেষ করে বিদেশি বায়াররা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ডিপোগুলোতে ট্যারিফ নির্ধারণের জন্য একটি মূল্যায়ন কমিটি রয়েছে। কিন্তু কমিটির মতামত না নিয়ে, আলাপ-আলোচনা ছাড়াই ট্যারিফ বাড়িয়েছে বিকডা।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের ভেতরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে ৫৯ হাজার টিইইউএস। কিন্তু বেসরকারি ১৯ কনটেইনার ডিপোর সক্ষমতা রয়েছে এক লাখ ৬ হাজার টিইইউসের। রপ্তানির সব পণ্য এসব বেসরকারি ডিপোর মাধ্যমে কনটেইনার ভর্তি হয়ে জাহাজীকরণ হয়। একইভাবে ৬৫ ধরনের আমদানি পণ্য খালাস হয় ডিপোগুলো থেকে। সব মিলিয়ে বছরে ২২ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয় এসব ডিপোতে।

ট্যারিফ বাড়ানোর বিষয়ে বিকডা মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বিপ্লবের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তিনি বলেন, ‘বর্ধিত ট্যারিফটি ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হলো।’

চার্জ বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ট্যারিফটি নেওয়া হয় টাকায়। এ চার্জটা আমাদের বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা দেবেন না। আমরা বিদেশি বায়ারদের পক্ষে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডদের কাছ থেকে টাকাটা (চার্জ) নিচ্ছি।’

রুহুল আমিন সিকদার যুক্তি দিয়ে বলেন, ‘শিপিং এজেন্টরা তাদের বিল পান ডলারে। আমরা পাই স্থানীয় মুদ্রা টাকায়। যেহেতু বিগত সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। এটার কারণেই নতুন করে চার্জ সমন্বয় করতে হয়েছে। তাছাড়া ডিপোগুলোর মানোন্নয়নে যেসব যন্ত্রাংশ কেনা হয়, সবগুলো ডলারেই কিনতে হয়। যেমন ২০২১ সালে ২০ ফুট কনটেইনারের জন্য ১০০ ডলার হিসেবে ৮ হাজার ২৫০ টাকা পেতাম। এখন সেই ১০০ ডলার নিলেই তাদের সাড়ে ১২ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। রেটটা এ জন্যই বাংলা টাকায় বাড়ানো হয়েছে। এখন যেহেতু আমরা বিদেশি বায়ারদের সঙ্গে কাজ করি, তাহলে এখন থেকে তা ডলারে নেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

‘গার্মেন্টসগুলো তাদের বিল পাচ্ছে ডলারে, শিপিং এজেন্ট, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডরা তাদের মাশুল পায় ডলারে। ডলারের পরিবর্তে বাংলা টাকা দিলে কি তারা মানবে? আমরা কেনো টাকায় নেবো?’, যোগ করেন বিকডা মহাসচিব।

কোন খাতে কত চার্জ বাড়লো?

কারখানা থেকে আসা রপ্তানি পণ্য ডিপোগুলোতে কনটেইনারবোঝাই করে বন্দরে পাঠানো পর্যন্ত ২০ ফুট কনটেইনারের ক্ষেত্রে বর্ধিত রেটে প্যাকেজ চার্জ ৯ হাজার ৯০০ টাকা করা হয়েছে। যা আগে ছিল ৬ হাজার ১২৭ টাকা। এতে ২০ ফুট কনটেইনারে খরচ বেড়েছে ৩ হাজার ৭৭৩ টাকা বা প্রায় ৬২ শতাংশ।

৪০ ফুট কনটেইনারের ক্ষেত্রে বর্ধিত রেটে প্যাকেজ চার্জ ১৩ হাজার ২০০ টাকা করা হয়েছে। যা আগে ছিল ৮ হাজার ২৫০ টাকা। এতে ৪০ ফুট কনটেইনারে বেড়েছে ৪ হাজার ৯৫০ টাকা বা ৬০ শতাংশ। অন্যদিকে, ৪০ ফুট (হাইকিউব) কনটেইনারের চার্জ আগে ছিল ৮ হাজার ২৫০ টাকা। বর্তমানে হাইকিউব কনটেইনারের ক্ষেত্রে চার্জ ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৯০০ টাকা। এ কনটেইনারে প্যাকেজ চার্জ বাড়ানো হয়েছে ৬ হাজার ৬৫০ টাকা। এতে খরচ বাড়ানো হয়েছে প্রায় ৮১ শতাংশ।

 

কিছু কিছু পোশাক হ্যাঙারে ঝুলন্ত অবস্থায় নির্ধারিত ফ্রেম আকারে কনটেইনারজাত করে রপ্তানি করা হয়। এসব কনটেইনারকে গ্যামেন্ট অন হ্যাঙার কার্গো (জিওএইচ কার্গো) বলা হয়। জিওএইচ কার্গোর ক্ষেত্রেও আগে সাধারণ কনটেইনারের চার্জ ছিল। কিন্তু বর্তমানে ২০ ফুট জিওএইচ কার্গোবাহী কনটেইনারের প্যাকেজ চার্জ করা হয়েছে ১১ হাজার ৯০০ টাকা। এতে বেড়েছে পাঁচ হাজার ৭৭৩ টাকা। একইভাবে ৪০ ফুট জিওএইচ কার্গোবাহী কনটেইনারের প্যাকেজ চার্জ করা হয়েছে ১৫ হাজার ২০০ টাকা এবং ৪০ ফুট হাইকিউব কনটেইনারের ক্ষেত্রে করা হয়েছে ১৬ হাজার ৯০০ টাকা। সব ধরনের রেফার কনটেইনারের প্লাগইন চার্জ আগে ছিল ১৭০০ টাকা। এখন করা হয়েছে দুই হাজার ২০০ টাকা।

আগে ২০ ফুট কনটেইনারে গ্রাউন্ড রেন্ট চার্জ ছিল ১১৫ টাকা। এখন করা হয়েছে ১৫০ টাকা। পাশাপাশি ৪০ ফুট ও ৪০ হাইকিউব কনটেইনারের গ্রাউন্ড রেন্ট ছিল ২৩০ টাকা। বর্তমানে ৭০ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩০০ টাকা। খালি কনটেইনারের ক্ষেত্রেও একইভাবে চার্জ বাড়ানো হয়েছে।

খালি কনটেইনারের লিফট-অন/লিফট-অফ (জাহাজের ক্রেন) চার্জ ৫২০ টাকার স্থলে ৭৫০ টাকা, কনটেইনারপ্রতি ডকুমেন্টেশন চার্জ ২৭৬ টাকার স্থলে ৪৫০ টাকা করা হয়েছে। তাছাড়া খালি কনটেইনার আনা নেওয়ার পরিবহন চার্জ হিসেবে ২০ ফুটের ক্ষেত্রে দুই হাজার ৫০০ টাকা এবং ৪০ ফুট ও হাইকিউব কনটেইনারের ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার টাকা করা হয়েছে। আগে ২০ ফুট খালি কনটেইনার পরিবহন চার্জ ছিল এক হাজার ৭০৫ টাকা এবং ৪০ ফুট ও হাইকিউব কনটেইনারের ক্ষেত্রে ছিল তিন হাজার ৪১০ টাকা।

অন্যদিকে, সিএফএস স্টোরেজ চার্জও বাড়ানো হয়েছে। আগে রপ্তানি পণ্য কারখানা থেকে ডিপোর সিএফএস শেডে রাখার জন্য ৭ দিন ফ্রি টাইমের পর প্রতিদিন প্রতি ঘনমিটার পণ্যের জন্য ৪৫ টাকা চার্জ ধরা হয়েছে। আগে এটি ছিল ২৯ টাকা। একইভাবে শার্টআউট কার্গোর ক্ষেত্রে ফ্রি টাইম ছাড়াই প্রতিদিন প্রতি ঘনমিটারের চার্জ ১৬ টাকা বাড়িয়ে ৪৫ টাকা করা হয়েছে।

রপ্তানিপণ্যবাহী কনটেইনার জাহাজীকরণের ক্ষেত্রে সুবিধার জন্য সঠিক ওজন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নিয়ম অনুযায়ী, পণ্যসহ কনটেইনার ওজন পরিমাপ করতে হয়। শিপিংয়ের ভাষায় একে ভিজিএম (ভেরিফাইড গ্রস মেস) বলা হয়। ডিপোগুলোতে ভিজিএম চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে কনটেইনারপ্রতি এক হাজার ৭২০ টাকা।

তাছাড়া ডিপোর সিএফএস শেড থেকে কনটেইনারে জিওএইচ কার্গো লোড করার ক্ষেত্রে আগে কোনো চার্জ না থাকলেও বর্তমানে প্রতি পিসের জন্য দুই টাকা হারে লেবার চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে। একইভাবে স্টোরিং চার্জ তিন টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ছয় টাকা করা হয়েছে।

 

বিকডার ট্যারিফ বাড়ানো নিয়ে নিজের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন রপ্তানিকারক ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব। তিনি বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক ও ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

এস এম আবু তৈয়ব জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিকডার ট্যারিফ বাড়ানোর জন্য একটি মূল্যায়ন কমিটি রয়েছে। কিন্তু এবার ওই কমিটির কোনো মতামত না নিয়েই অযৌক্তিতভাবে এক লাফে ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে। বিকডা কোনো স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা না করেই একতরফাভাবে এ ট্যারিফ বাড়িয়েছে। এটি জাতীয় স্বার্থের বিষয়। কিন্তু তারা (বিকডা) এমন আচরণ করছে, তারা কাউকেই মানছেন না। পোর্টকে মানে না, এনবিআরকে মানে না, আমাদেরকেও মানে না।’

ডলারের দাম সমন্বয়ের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আবু তৈয়ব বলেন, ‘শ্রমিকদের মজুরি তো ডলারে পরিশোধ করা হচ্ছে না। ডিপোগুলোতে যাবতীয় খরচ টাকায় পরিশোধ করা হয়। তাহলে তাদের খরচ কেমন করে বেড়েছে। মূল্যায়ন কমিটি রয়েছে, খরচ বাড়ার যুক্তিগুলো তাদের (বিকডা) প্রমাণ করতে হবে। সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হবে বিকডাকে।’

তিনি বলেন, ‘একদিনে বন্দরের সব ধরনের চার্জ বাড়লো। এমনিতে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আমাদের রপ্তানি কমে গেছে। এখন অফডকগুলোর চার্জ বাড়ানো হলে তার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে। বিদেশি বায়াররা নিরুৎসাহিত হবেন। রপ্তানিখাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহ-সভাপতি খাইরুল আলম সুজন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিকডার ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি একতরফা হয়ে গেছে। উচিত ছিল সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তটি নেওয়া। এ নিয়ে বন্দর চেয়ারম্যান একটি মিটিংয়ের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওই মিটিং হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘এমনিতেই আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। চারদিকে একটি প্রেসার রয়েছে। এখন বিকডার চার্জ বাড়ানোর বাড়তি এই চাপ ব্যবসায়ীরা কতটুকু সামাল দিতে পারবেন, তা আলোচনার বিষয়। বর্ধিত এ ট্যারিফের কারণে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিশেষ করে রপ্তানিকারকরা ক্ষতির শিকার হবেন। তাছাড়া ওভারসিজ যেসব এজেন্ট রয়েছে, তাদের ওপরও প্রভাব পড়বে। সবমিলিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।’

এমডিআইএইচ/এসএনআর/এমএমএআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।