জীবন বিমায় বকেয়া দাবির পাহাড়, বিপর্যয়ে ৭ কোম্পানি
দেশে ব্যবসা করা জীবন বিমা কোম্পানিগুলো সঠিকভাবে গ্রাহকের দাবির টাকা পরিশোধ করছে না। ফলে বকেয়া বিমা দাবির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে যে বিমা দাবি উত্থাপিত হয়েছে তার ৬৫ শতাংশ পরিশোধ করেনি জীবন বিমা কোম্পানিগুলো।
দাবি পরিশোধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে সমস্যাগ্রস্ত ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটিতে প্রায় ৯৯ শতাংশ বিমা দাবি বকেয়া পড়ে রয়েছে।
সম্প্রতি বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তৈরি করা প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে দেশে ব্যবসা করা ৩৬টি জীবন বিমা কোম্পানিতে বিমা দাবি উত্থাপিত হয় পাঁচ হাজার ৯৮৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকার। বিপরীতে কোম্পানিগুলো পরিশোধ করেছে দুই হাজার ১০৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর দাবি বকেয়া রয়েছে তিন হাজার ৮৮০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ ৩৫ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ করা হয়েছে।
সার্বিক জীবন বিমা খাতে ৬৫ শতাংশ বিমা দাবি বকেয়া থাকার পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে সাতটি কোম্পানি। এর মধ্যে রয়েছে- ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রোগ্রেসিভ লাইফ, সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স, গোল্ডেন লাইফ, হোমল্যান্ড লাইফ, বায়রা লাইফ এবং সান লাইফ ইন্স্যুরেন্স। এই কোম্পানিগুলোতে প্রায় সব বিমা দাবি বকেয়া পড়ে রয়েছে। এই সাত কোম্পানিতে বকেয়া বিমা দাবির পরিমাণ তিন হাজার ৫৭১ কোটি ৯০ লাখ টাকা। অর্থাৎ, জীবন বিমা খাতের যে বিমা দাবি বকেয়া আছে তার ৯০ শতাংশের বেশি এই সাত কোম্পানির।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি বিমা দাবি বকেয়া রয়েছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে। কোম্পানিটিতে দুই হাজার ৮১৫ কোটি এ কলাখ টাকার বিমা দাবি উত্থাপিত হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে কোম্পানিটি। বিপরীতে বিমা দাবি বকেয়া রয়েছে ৩৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। দাবি পরিশোধ না করার হার ৯৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
গুটিকয়েক কোম্পানি পুরো বিমা খাতের পরিবেশ নষ্ট করছে। তারা ঠিকমতো গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধ না করায় পুরো সেক্টরে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। যতদিন এসব কোম্পানি গ্রাহকের দাবির টাকার পরিশোধ করতে পারবে না, ততদিন তাদের নতুন পলিসি ইস্যু করতে দেওয়া উচিত হবে না।- প্রগতি লাইফের সিইও মো. জালালুল আজিম
এছাড়া বায়রা লাইফে দাবি উত্থাপিত হয়েছে ৭৯ কোটি ৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাত্র ৪০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে পেরেছে কোম্পানিটি। বাকি ৭৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা অপরিশোধিত রয়েছে। পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ২৫৭ কোটি ৪২ লাখ টাকার দাবি উত্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে দুই কোটি ১৪ লাখ টাকা, বকেয়া ২৫৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। হোমল্যান্ড লাইফে উত্থাপিত হওয়া ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকার দাবির মধ্যে ৬৩ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বিপরীতে বকেয়া ৩৪ কোটি ২১ লাখ টাকা।
গোল্ডেন লাইফে উত্থাপিত হওয়া ৪৩ কোটি ২৭ লাখ টাকার বিমা দাবির বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি এক কোটি ৬৭ লাখ টাকার দাবি পরিশোধ করেছে। বিপরীতে বকেয়া রয়েছে ৪১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। প্রোগ্রেসিভ লাইফে উত্থাপিত হওয়া ১৬২ কোটি ৮৬ লাখ টাকার বিমা দাবির মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে ৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, বকেয়া ১৫৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। আর সানফ্লাওয়ার লাইফে উত্থাপিত হওয়া ১৯৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা দাবির মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি তিন কোটি ৯৪ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে। বিপরীতে বকেয়া ১৯০ কোট ৫৮ লাখ টাকা।
অপরদিকে, বিমা দাবি পরিশোধের হার সবচেয়ে বেশি আলফা লাইফ, এলআইসি বাংলাদেশ, মার্কেন্টাইল ও সোনালী লাইফের। এই চার কোম্পানি শতভাগ দাবি পরিশোধ করেছে। এর মধ্যে আলফা লাইফ ১১ কোটি ২৯ লাখ, এলআইসি বাংলাদেশ এক কোটি ২৪ লাখ, মার্কেন্টাইল লাইফ চার কোটি ৫ লাখ এবং সোনালী লাইফ ৯৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা বিমা দাবির পুরোটাই পরিশোধ করেছে।
আরও পড়ুন
জীবনে ২৫ হাজার, সাধারণে ৫ লাখ টাকা স্বল্প অঙ্কের বীমা দাবি
বিমা আইন সংশোধনের আগে আইডিআরএ’র সংস্কার প্রয়োজন
৮ বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার বীমা দাবি পরিশোধ
এর পরের অবস্থানে রয়েছে পপুলার লাইফ। কোম্পানিটিতে উত্থাপিত হওয়া ১০৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকার মধ্যে ১০২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বিপরীতে বকেয়া রয়েছে দুই কোটি ১৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠানটির দাবি পরিশোধের হার ৯৭ দশমিক ৯১ শতংশ।
তারা তো আর টাকা দিতে পারবে না। তাদের টাকা বাইরে চলে গেছে। আইডিআরএ বিমা রেজ্যুলেশন অ্যাক্ট-২০২৫ এর খসড়া তৈরি করেছে। সেটা যদি পাস হয়, তাহলে সেই অনুযায়ী গ্রাহকের টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।- আইডিআরএর মুখপাত্র সাইফুন্নাহার সুমি
টাকার অংকে সবচেয়ে বেশি বিমা দাবি পরিশোধ করেছে মেটলাইফ বাংলাদেশ। কোম্পানিটিতে চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে ৮৩৯ কোটি ৭৮ লাখ টাকার বিমা দাবি উত্থাপিত হয়। এর মধ্যে ৭৬৯ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানটি পরিশোধ করেছে। বিপরীতে বকেয়া রয়েছে ৭০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। দাবি পরিশোধের হার ৯১ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
নতুন কোম্পানিগুলোর দাবি পরিশোধের চিত্র
আকিজ তাকাফুল লাইফ এক কোটি ২৪ লাখ টাকার মধ্যে এক কোটি ২২ লাখ টাকা, আস্থা লাইফে চার কোটি ৯ লাখ টাকার মধ্যে চার কোটি ৮ লাখ টাকা, বেঙ্গল লাইফে চার কোটি ৫ লাখ টাকার মধ্যে তিন কোটি ৭৮ লাখ টাকা, বেস্ট লাইফে এক কোটি ২৭ লাখ টাকার মধ্যে এককোটি ১৫ লাখ টাকা, চার্টার্ড লাইফে চার কোটি ৩০ লাখ টাকার মধ্যে তিন কোটি ৬৯ লাখ টাকা, ডায়মন্ড লাইফে এক কোটি ৯ লাখ টাকার মধ্যে ৮১ লাখ টাকা, গার্ডিয়ান লাইফে ১৪৬ কোটি ৪ লাখ টাকার মধ্যে ১৩৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, যমুনা লাইফে দুই কোটি ৫৬ লাখ টাকার মধ্যে দুই কোটি ৩০ লাখ টাকা, এনআরবি ইসলামী লাইফে ৬৬ লাখের মধ্যে ৫৮ লাখ টাকা, প্রটেকটিভ ইসলামী লাইফে চার কোটি ২৪ লাখ টাকার মধ্যে দুই কোটি ৮৮ লাখ টাকা, শান্তা লাইফে এক কোটি ৪ লাখ টাকার মধ্যে ৯৯ লাখ টাকা, স্বদেশ লাইফে ৫২ লাখ টাকার মধ্যে ৪৮ লাখ টাকা, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফে তিন কোটি ৩৭ লাখ টাকার মধ্যে তিন কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং জেনিথ ইসলামী লাইফে দুই কোটি ৮৮ লাখ টাকার মধ্যে দুই কোটি ৭৭ লাখ টাকা দাবি পরিশোধ করেছে।
পুরোনো কোম্পানিগুলোর দাবি পরিশোধ করেছে
ডেল্টা লাইফে ২৪১ কোটি ৬৮ লাখ টাকার মধ্যে ১৯৫ কোটি টাকা, জীবন বীমা করপোরেশনে ২৩৪ কোটি ৩১ লাখ টাকার মধ্যে ১৩৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, মেঘনা লাইফে ৬২ কোটি ৮৬ লাখ টাকার মধ্যে ৫৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ন্যাশনাল লাইফে ৩০৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকার মধ্যে ২৯১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, প্রগতি লাইফে ৮২ কোটি ৩৭ লাখ টাকার মধ্যে ৭৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, প্রাইম ইসলামী লাইফে ১২৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকার মধ্যে ৬৭ কোটি টাকা, রূপালী লাইফে ২৮ কোটি ৪২ লাখ টাকার মধ্যে ২৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা এবং সন্ধানী লাইফে ৪৪ কোটি ২৩ লাখ টাকার মধ্যে ৪১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা দাবি পরিশোধ করেছে।
কার কত বিমা দাবি বকেয়া
নতুন ব্যবসা শুরু করা বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে আকিজ তাকাফুল লাইফে ২ লাখ, আস্থা লাইফে ১ লাখ টাকা, বেঙ্গল লাইফে ২৭ লাখ, বেস্ট লাইফে ১২ লাখ, চাটার্ড লাইফে ৬১ লাখ, ডায়মন্ড লাইফে ২৮ লাখ, গার্ডিয়ান লাইফে ১০ কোটি ৯ লাখ, যমুনা লাইফে ২৫ লাখ, এনআরবি ইসলামী লাইফে ৭ লাখ, প্রটেকটিভ ইসলামী লাইফে ১ কোটি ৩৬ লাখ, শান্তা লাইফে ৫ লাখ, স্বদেশ লাইফে ৪ লাখ, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফে ৮ লাখ এবং জেনিথ ইসলামী লাইফে ১১ লাখ টাকা বিমা দাবি বকেয়া রয়েছে।
পুরোনো কোম্পানিগুলোর মধ্যে ডেল্টা লাইফে ৪৬ কোটি ৬৮ লাখ, জীবন বীমা করপোরেশনে ৯৪ কোটি ৩৬ লাখ, মেঘনা লাইফে ৩ কোটি ৬ লাখ, ন্যাশনাল লাইফে ১২ কোটি ৬৫ লাখ, প্রগতি লাইফে ৫ কোটি ৬৮ লাখ, প্রাইম ইসলামী লাইফে ৫৬ কোটি ৯৫ লাখ, রূপালী লাইফে ৫৫ লাখ এবং সন্ধানী লাইফে ২ কোটি ৩৬ লাখ টাকার বিমা দাবি বকেয়া রয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে প্রগতি লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. জালালুল আজিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সার্বিকভাবে জীবন বিমা কোম্পানিগুলোতে ৬৫ শতাংশ বিমা দাবি বকেয়া থাকার চিত্র ভালো লক্ষণ নয়। বিমা দাবি এত বেশি হারে বকেয়া থাকার জন্য গুটিকয়েক কোম্পানি দায়ী। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।’
তিনি বলেন, ‘গুটিকয়েক কোম্পানি পুরো বিমা খাতের পরিবেশ নষ্ট করছে। তারা ঠিকমতো গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধ না করায় পুরো সেক্টরে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। আমার মতে, যতদিন এসব কোম্পানি গ্রাহকের দাবির টাকা পরিশোধ করতে পারবে না, ততদিন তাদের নতুন পলিসি ইস্যু করতে দেওয়া উচিত হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইডিআরএর কথায় মনে হয়েছে সমস্যাগ্রস্ত কোম্পানিগুলোকে মার্জ করে তারা একটি কোম্পানি গঠন করতে চাই। পরিকল্পনামাফিক এটি করা সম্ভব হলে তা ভালো ফল দেবে। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে মার্জ করে ব্যাংকের মতো সরকার থেকে অর্থসহায়তা দিতে হবে।’
যোগাযোগ করা হলে আইডিআরএর মুখপাত্র সাইফুন্নাহার সুমি জাগো নিউজকে বলেন, ‘যে বিমা দাবি বকেয়া রয়েছে তার মধ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি ফারইস্ট লাইফের, যাদের কাছে কোনো টাকা নেই। এর বাইরে আরও পাঁচ-ছয়টি কোম্পানির কারণে অপরিশোধিত দাবি বেশি হচ্ছে।’
এই কোম্পানিগুলো নিয়ে আপনাদের কোনো পরিকল্পনা আছে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘তারা তো আর টাকা দিতে পারবে না। তাদের টাকা বাইরে চলে গেছে। আইডিআরএ বিমা রেজ্যুলেশন অ্যাক্ট-২০২৫ এর খসড়া তৈরি করেছে। সেটা যদি পাস হয়, তাহলে সেই অনুযায়ী গ্রাহকের টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’
এমএএস/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম