প্রতিবন্ধকতায় ঢাকা পড়ছে খাদ্যপণ্য রপ্তানির সম্ভাবনা

নাজমুল হুসাইন
নাজমুল হুসাইন নাজমুল হুসাইন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৩:৩৮ পিএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫
নানান প্রতিবন্ধকতায় খাদ্যপণ্য রপ্তানি নিম্নমুখী/ছবি: এআই নির্মিত

প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রপ্তানিতে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা ছিল ভারত-বাংলাদেশের বন্দরগুলোর অবকাঠামো দুর্বলতা। চলতি বছর থেকে ভারতের অধিকাংশ স্থলবন্দর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা ও দেশটিতে পণ্য অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতায় ভুগছে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত। এসব নিয়ে জাগো নিউজের জ্যৈষ্ঠ প্রতিবেদক নাজমুল হুসাইনের তিন পর্বের ধারাবাহিকের আজ থাকছে তৃতীয়শেষ পর্ব

কম দূরত্ব ও সমজাতীয় পণ্যের প্রচলনের কারণে বাংলাদেশ থেকে যত খাদ্যপণ্য রপ্তানি হতো তার প্রায় ৪০ শতাংশ যেত ভারতে। বাকি পণ্যগুলোর গন্তব্য ছিল বিশ্বের অন্য শতাধিক দেশে। সম্প্রতি স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভারতে পণ্য রপ্তানি কমেছে। খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে প্রতিবন্ধকতায় ঢাকা পড়ছে এ খাতের অসীম সম্ভাবনা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সবশেষ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিধিনিষেধের আগে গত বছরের (২০২৪) জুলাইয়ে বাংলাদেশের প্রায় ১৯টি প্রতিষ্ঠান ভারতে পণ্য রপ্তানি করে, যার অর্থমূল্য ছিল প্রায় ৪১ লাখ ডলার। কিন্তু ঠিক এক বছর পরের গত জুলাইয়ে এ রপ্তানি কমে আসে ৩৪ লাখ ডলারে। কমেছে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও। ওই মাসে ভারতে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ছিল ১৪টি। তবে এরপর থেকে এ ডিসেম্বর পর্যন্ত রপ্তানি আরও কমেছে বলে ধারণা রপ্তানিকারকদের। যদিও এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য মিলছে না, তারপরও ভারতে রপ্তানি অর্ধেকে নেমেছে বলে ধারণা তাদের।

এদিকে এ পরিস্থিতিতে সার্বিক কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানিতে এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের মাইলফলক ছুঁয়েছিল। পরের পাঁচ বছরের মধ্যে ওই রপ্তানির পরিমাণ দ্বিগুণ করার প্রত্যাশা ছিল খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। কিন্তু এসব নানা প্রতিবন্ধকতায় সে আশা এখন ‘গুড়েবালি’। এখনো রপ্তানি সেই বিলিয়নের ঘরেই আটকে রয়েছে, বরং আরও কমেছে।

তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি আয় ছিল ১২৮ কোটি ডলার, ২০২১-২২ সালে তা কমে ১১৬ কোটি ২০ লাখ ডলারে নেমে আসে। পরের অর্থবছর ২০২২-২৩ সালে ৮৩ কোটি ডলার এবং ২০২৩-২৪ সালে ৯৬ কোটি ৪৩ লাখ ডলার ছিল রপ্তানি। আর শেষ ২০২৪-২৫ সালে ৯৮ কোটি ৮৬ লাখ ডলারের রপ্তানি হয়েছে। অন্যদিকে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সার্বিক রপ্তানি আগের চেয়েও ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমেছে বলে ধারণা করছেন রপ্তানিকারকরা।

আরও পড়ুন
প্রথম পর্ব: ভারতে খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে পাড়ি দিতে হচ্ছে হাজার কিলোমিটার বেশি পথ
পণ্য আটকা পড়লে ডেমারেজ গুনতেই চলে যায় কয়েক চালানের লাভ
ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যে অশুল্ক বাধায় খরচ বেড়েছে ২০ শতাংশ
বাংলাদেশে ভারতের পণ্য রপ্তানি কমেছে ২৮ শতাংশ

চট্টগ্রামের বিএসপি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের প্রধান বাজার ছিল ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা। এই দুই রাজ্যের নিকটতম স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য রপ্তানির সুযোগ না থাকায় প্রতিষ্ঠানটি এখন রপ্তানি একদম কমিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অজিত কুমার দাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে ভারতে প্রতিমাসে প্রায় সাত থেকে আট লাখ টাকার পণ্য যেত। আমাদের মোট রপ্তানির অর্ধেক হলো ভারতে।’

তিনি বলেন, ‘এখন নানা প্রতিবন্ধকতায় গত ছয় মাসেও রপ্তানি আগের একমাসের সমান হয়নি। এখন যেটুকু রপ্তানি করছি লোকসান দিয়ে, কারণ দীর্ঘ তিন বছরের তৈরি একটি বাজার এভাবে নষ্ট করতে চাই না।’

রপ্তানিকারকরা বলছেন, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র–এই পাঁচটি দেশ থেকে আসে মোট রপ্তানির প্রায় ৬০ শতাংশ। মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, কানাডা, ওমান, কাতার, নেদারল্যান্ডসসহ বাকি ১০১টি দেশে রপ্তানি হয় অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ। এখন ভারতের মতো একটি বড় বাজার হারিয়ে তারা বিপদে পড়ছেন।

কথা বলে জানা যায়, খাদ্যপণ্যের বড় রপ্তানিকারক প্রাণ-আরএফএল গ্রুপসহ এসিআই ফুডস, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, আবুল খায়ের গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, ইস্পাহানি গ্রুপ, বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, টি কে গ্রুপ, আকিজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভারতে পণ্য রপ্তানি কমেছে।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভারতে এখন পণ্য পাঠাতে যেভাবে খরচ বেড়েছে, তাতে অনেক কোম্পানি পোষাতে পারছে না। ফলে তারা ভারতের বাজার থেকে ছিটকে পড়ছে। যদিও এ বাজার আমাদের জন্য অনেক সম্ভাবনাময় ছিল।’

ভারতের পাশাপাশি অন্য দেশেও বিভিন্ন জটিলতার কথা জানিয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের এ পরিচালক বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে ট্যারিফ ব্যারিয়ার, শিপিং লাইন ও কনটেইনার ভাড়া বৃদ্ধি, সরকারের অপর্যাপ্ত ওয়্যারহাউজ ফ্যাসিলিটি ও বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিংয়ের দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশি পণ্য পিছিয়ে রয়েছে।’

এসব বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভারতের বিধিনিষেধের বিষয়টি এখন রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সঙ্গে সম্পর্কিত। উভয় দেশের মধ্যে দ্রুত খোলামেলা আলোচনা হওয়া দরকার এসব বিষয়ে। সরকার সমস্যা শুরুর পরপরই কিছু উদ্যোগ নিলেও সেটা পরবর্তীসময়ে এগিয়ে নিতে পারছে না। এটা দুঃখজনক।’

এসব বিষয়ে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হলেও গত ছয় মাসে সাড়া পাওয়া যায়নি।

সম্ভাবনাময় খাতে প্রতিবন্ধকতা নিয়ে দুশ্চিন্তা

বাংলাদেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাত দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ খাত একদিকে যেমন দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে, অন্যদিকে বিদেশে পণ্য রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের শীর্ষ পাঁচটি রপ্তানি খাতের মধ্যে এ খাত একটি।

তথ্য বলছে, দেশের জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ১২ শতাংশ। জিডিপিতে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য খাতের অবদান ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২৭ সালের মধ্যে এ খাতের পণ্য রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে ২০০ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হতে পারে।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্যাকেটজাত খাবারের বাজার ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের, যা ২০৩০ সালে প্রায় ৬ বিলিয়নে উন্নীত হবে। রপ্তানি খাতে এই খাদ্যপণ্যের অবদান দিন দিন বাড়ছে।

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বাংলাদেশের কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খাত প্রাথমিক কৃষি ও উৎপাদনের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। এটি জিডিপি, রপ্তানি বৈচিত্র্য ও গ্রামীণ কর্মসংস্থানে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। কৌশলগত গুরুত্ব সত্ত্বেও এ খাত সম্ভাবনার তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে, বিশেষ করে মূল্য সংযোজনসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে। এ পরিস্থিতি দুশ্চিন্তার।

সুযোগ হারাচ্ছে এ খাত

বিশ্বব্যাপী প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বড় চাহিদা রয়েছে, সে জায়গায় বাংলাদেশের পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখাতে পারছে না। বিশ্বব্যাংকের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চার ট্রিলিয়ন ডলারের এগ্রিকালচারের এক্সপোর্ট বৈশ্বিক বাজার রয়েছে। আর এ বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ দখলে রেখেছে ইউরোপের দেশগুলো।

যদিও বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে ছোট দেশ নেদারল্যান্ডসের কৃষিপণ্যের রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যেও থাইল্যান্ড কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে অনেক এগিয়ে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প দেশটির তৃতীয় বৃহৎ শিল্প খাত। দেশটির মোট জিডিপির শতকরা ২৩ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। প্রতি বছর কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি করে থাইল্যান্ড ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে।

সার্বিক সহায়তা পেলে বাংলাদেশের এ খাতকেও নেদারল্যান্ডস কিংবা থাইল্যান্ডের মতো উল্লেযোগ্য জায়গায় নেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন রপ্তানিকারকরা।

কিন্তু বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের মাত্র ১ শতাংশ প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। অন্যদিকে ভিয়েতনামে ৫ শতাংশ, চীনে ৩৮, ফিলিপাইনে ৩১, আমেরিকায় ৭০, থাইল্যান্ডে ৮১ ও মালয়েশিয়ায় ৮৪ শতাংশ কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত হয়।

বিডার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৬৩ ধরনের মৌলিক কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যসহ প্রায় ৭শ ধরনের কৃষিপণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। দেশে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত প্রায় এক হাজার প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রপ্তানির সঙ্গে জড়িত প্রায় ২৫০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বড় ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান ২০টি। এ খাতে কমসংস্থান প্রায় পাঁচ লাখ।

কিন্তু রপ্তানির প্রায় ৬০ শতাংশের গন্তব্য বিশ্বের মাত্র পাঁচটি দেশে। পাশাপাশি মোট রপ্তানির অর্ধেকই পাঁচ ধরনের পণ্য। ফলে বাংলাদেশি খাদ্যপণ্য রপ্তানির নতুন নতুন গন্তব্য সৃষ্টি ও পণ্য বহুমুখীকরণে দুর্বলতা রয়েছে। বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

এনএইচ/এএসএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।