অতিরিক্ত রাজস্বের চাপে হয়রানিতে করদাতারা

মেসবাহুল হক
মেসবাহুল হক মেসবাহুল হক , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:২৯ পিএম, ২৭ মে ২০২০

>> অবাস্তব রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রায় মানসিক চাপে কর্মকর্তারা
>> অসম্ভব বিবেচনায় অনেকেই একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেন
>> কাগজে নয়, বাস্তবসম্মত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের তাগিদ

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে স্থবির গোটাবিশ্ব। দেশেও প্রায় দুই মাস ধরে চলছে সাধারণ ছুটি। এই ছুটিকে কার্যত লকডাউন-ই বলা চলে। তাই থমকে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্য। ফলে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। তারপরও আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) প্রায় অবাস্তব তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হচ্ছে।

অতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং তা আহরণে এনবিআরের বিশ্লেষণ হলো, এমন পরিস্থিতিতে মাঠপর্যায়ের রাজস্ব আহরণকারী কর্মকর্তাদের ওপর একধরনের মানসিক চাপ তৈরি হয়। এজন্য অনেকে অসম্ভব বিবেচনায় একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেন। অনেক ক্ষেত্রে করদাতাদের ওপর হয়রানির অভিযোগ আসে। আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা যৌক্তিকীকরণের বিষয়টি বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানান সংস্থাটির চেয়ারম্যান। এনবিআরের এমন অনুরোধের বিষয়ে সমর্থন জানিয়েছেন বিশ্লেষকরাও।

করোনার প্রভাবে রাজস্ব আদায় কমে যাওয়া এবং আগামী অর্থবছরে যৌক্তিক হারে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের অনুরোধ জানিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তিনি এসব কথা উল্লেখ করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

corona_business-04.jpg

করোনায় রাজস্ব আহরণের প্রভাব এবং এনবিআরের অবস্থান নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।

চিঠিতে অর্থ সচিবের উদ্দেশ্যে এনবিআর চেয়ারম্যান লেখেন, “সারাবিশ্বে কোভিড-১৯ সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিস্থিতি সম্পর্কে আপনি সম্যক অবগত আছেন। এ বিষয়ে আপনার মন্ত্রণালয় কর্তৃক সার্বক্ষণিক নজরদারি এবং সংঘটিত সম্ভাব্য অর্থনৈতিক-সামাজিক বিপর্যয় রোধে গৃহীত প্রশংসনীয় কার্যাবলি এ দফতর (এনবিআর) আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করে আসছে।

প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আমদানি-রফতানি শুল্ক ও স্থানীয়পর্যায়ে মূসক এবং আয়কর থেকে অভ্যন্তরীণ সম্পদের সিংহভাগ জোগান দিয়ে আসছে। প্রতি বছর এ রাজস্বের পরিমাণ পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে আসছিল। বিগত পাঁচ বছরে এ প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল প্রায় ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। চলমান অর্থবছরের শুরুর দিকে নতুন মূসক আইন চালু ও অর্থনৈতিক গতিশীলতার কারণে এ প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধির আশাবাদ তৈরি হয়েছিল।”

corona_business-04.jpg

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

অর্থ সচিবকে লেখা চিঠিতে তিনি আরও উল্লেখ করেন, “আপনি জানেন যে, আন্তর্জাতিক, অন্তর্দেশীয় ও জাতীয় অর্থনৈতিক বিবিধ প্রকরণ ও ক্রিয়াশীলতার ওপর অভ্যন্তরীণ কর ও রাজস্ব আহরণ সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। করোনাভাইরাস-জনিত দুর্যোগ-মহামারি সমগ্র পৃথিবীর সামাজিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

বিশেষত এ দুর্যোগ পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে এবং পূর্বতন জীবনযাত্রা ফিরে আসবে সেটা নির্দিষ্ট করে বলা কারও পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। কর আহরণের ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সারাবিশ্বের সব মানুষের ভোগ বা চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। কোভিড-১৯ জনিত পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও সনাতনী ধারার অর্থনীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আহরণ, বণ্টন, বাণিজ্য ও ভোগে বিপুল পরিবর্তন নিয়ে আসবে। সারাবিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশেও অবধারিতভাবে পরিবর্তনের ঢেউ আঘাত হানবে বলে ধারণা করা যায়।

স্থানীয় ভোগের চাহিদা কমে গেলে আমদানি কমবে, শিল্পোৎপাদন কমলে কাঁচামাল, যন্ত্রপাতির চাহিদা কমে যাবে; এতে পরোক্ষ করের ওপর ব্যাপক ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে আয়বর্ধক কার্যক্রম কমে মন্দা শুরু হলে প্রত্যক্ষ করও কমে যাবে।

ধারণা করা যায় যে, নিকট আগামীতে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বড় একটি অংশ জনগণের মৌলিক চাহিদা-সেবায় নিয়োজিত হবে। যার মধ্যে চিকিৎসা-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, খাদ্য, শিক্ষা, আবাসন ও জনগণের নিরাপত্তার দিকেই অধিকতর মনোযোগ নিবিষ্ট করতে হবে। এসব মৌলিক সম্পদ উৎপাদন, বিপণন, সরবরাহ ও সেবা আবার বেশির ভাগই সম্পূর্ণ করমুক্ত বা ন্যূনতম করের আওতাধীন।

corona_business-04.jpg

ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ

সুতরাং নিকট ভবিষ্যতে দুর্যোগ অবস্থা স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও তার দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়ায় স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ওপর ঋণাত্মক প্রভাবে রাজস্ব আহরণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন প্রধান তিনটি খাত শুল্ক, মূসক ও আয়কর আহরণের গতিপ্রকৃতি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক বিবেচনায় নিয়ে গবেষণা ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে জানা যায় যে, চলতি অর্থবছরের শেষে সর্বমোট দুই লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব অহরিত হতে পারে। পূর্ববর্তী গড় প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ হিসাবে আগামী অর্থবছরের সর্বমোট রাজস্ব আহরণ দুই লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে না।

অপরদিকে আগামী অর্থবছরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা আদায় করা দুরূহ হবে। অতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হলে মাঠপর্যায়ে রাজস্ব আহরণকারী কর্মকর্তাদের ওপর একধরনের মানসিক চাপ তৈরি হয়। অনেকে অসম্ভব বিবেচনা করে একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেন এবং অনেক ক্ষেত্রে করদাতাদের ওপর হয়রানির অভিযোগ আসে।

অন্যদিকে লক্ষ্যমাত্রা যৌক্তিক হলে কর্মকর্তাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রচেষ্টা থাকে এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কৃতিত্ব পাবার অনুপ্রেরণা তৈরি হয়। এ পরিস্থিতিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জন্য ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ এই দুই অর্থবছরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা যৌক্তিকীকরণের বিষয়টি বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।”

চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এমনকি অর্থ সচিব অব্দুর রউফ তালুকদারও কোনো কথা বলতে চাননি।

তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সাধারণত প্রতি বাজেটেই বেশি ধরা হয়। তবে অর্থবছরের মাঝামাঝিতে সংশোধিত বাজেটে সেটা আবার কমানো হয়।

তবে এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলেন, জাতীয় সংসদে পাস করা একটা বাজেটে যখন বলে দেয়া হয় যে, এনবিআরকে এত টাকা রাজস্ব আহরণ করতে হবে, এটার জন্য তো একটা জবাবদিহিতা থাকা দরকার। এনবিআর কেন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারল না, তারও জবাবদিহি দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে অযৌক্তিক লক্ষ্যমাত্রা চাপিয়ে দেয়া হয়। তাই এর কোনো জবাবদিহিতাও থাকে না। এতে বাজেটের মূল উদ্দেশ্যই বাধাগ্রস্ত হয়। অতিরিক্ত ঋণে জড়িয়ে পড়ারও সম্ভাবনা তৈরি হয়।

corona_business-04.jpg

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাজেটে রাজস্ব আহরণের একটা সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা উচিত। কিন্তু প্রতি বছরই আমাদের দেশে এনবিআরকে রাজস্ব আদায়ের একটা অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়। যা কোনোদিনও বাস্তবায়নযোগ্য নয়।’

এ বিষয়ে সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অতিরিক্ত বিবেচনায় যে সমস্যাগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন বর্তমান চেয়ারম্যান সেগুলোর সঙ্গে আমিও একমত। দেশের চাহিদা অনুযায়ী বাজেটের আকার বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। তবে এনবিআরকে রাজস্ব আহরণের অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা দেয়া ঠিক নয়।’

করোনাভাইরাসের কারণে থমকে যাওয়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রায় পাঁচ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আগামী ১১ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনের কথা রয়েছে।

অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, পাঁচ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ধরে আগামী বাজেট প্রণয়নের কথা ভাবা হয়েছিল। পরে তা কমিয়ে পাঁচ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার কথা চিন্তা করা হয়। করোনার নেতিবাচক প্রভাব সব খাতে পড়ায় শেষ পর্যন্ত বাজেটের আকার কম ধরা হচ্ছে।

এমইউএইচ/এমএআর/এমএস

প্রতি বছরই আমাদের দেশে এনবিআরকে রাজস্ব আদায়ের একটা অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়। যা কোনোদিনও বাস্তবায়নযোগ্য নয়

রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অতিরিক্ত বিবেচনায় যে সমস্যাগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন বর্তমান চেয়ারম্যান সেগুলোর সঙ্গে আমিও একমত

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।