চিনিতে হাজার কোটি টাকা নতুন বিনিয়োগ করবে দেশবন্ধু গ্রুপ
উৎপাদন বাড়াতে চিনি কারখানায় এক হাজার কোটি টাকা নতুন বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা নিয়েছে দেশবন্ধু গ্রুপ। এতে গ্রুপটির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান দেশবন্ধু সুগার মিলসের উৎপাদন বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এদিকে চলতি বছরে এই ব্যবসায়ী গ্রুপটি ৮শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এতে গ্রুপটিতে এক বছরে প্রায় পাঁচ হাজার নতুন কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। সেই সঙ্গে গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার বেড়েছে ১৪ শতাংশ।
শনিবার (২৪ ডিসেম্বর) দেশবন্ধু গ্রুপের কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। সরেজমিনে দেখা গেছে, দেশবন্ধু গ্রুপের নরসিংদীর চরসিন্দুর পলাশ শিল্প এলাকায় অবস্থিত সব কারখানায় চলছে কর্মযজ্ঞ।
গ্রুপটির দায়িত্বশীলরা জানান, গত বছর দেশবন্ধু গ্রুপের অধীনে কাজ করতো ২০ হাজার মানুষ। বর্তমানে তা বেড়ে ২৫ হাজারে পৌঁছেছে। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি নিজেদের ব্যবসা বাড়াতে উৎপাদমুখী নানা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠান দেশবন্ধু সুগার মিলস, সাউথ ইস্ট সোয়েটার, জিএম অ্যাপারেলস, বেভারেজ, প্যাকেজিং ও দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও উৎপাদন বাড়াতে ২০২২ সালে ৮শ কোটি টাকা নতুন করে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
এতে নতুন করে ২৫ শতাংশ কর্মসংস্থান বেড়েছে। গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার দুই হাজার ৪শ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দুই হাজার ৮শ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। তবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়লেও প্রত্যাশা অনুযায়ী উৎপাদন ও বিক্রি কার্যক্রম অর্জিত হয়নি বলে জানিয়েছেন গ্রুপটির কর্মকর্তারা।
এর কারণ হিসেবে তারা জানান, ৮শ কোটি টাকা নতুন বিনিয়োগের শুরুতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সারাবিশ্বে নেমে আসে নতুন করে আর এক বিপর্যয়। করোনা শঙ্কা যেতে না যেতেই শুরু হয় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা। এর প্রভাবে দেশে ডলারের দামে রেকর্ড হয়। ডলারের অধিক মূল্য বৃদ্ধিতে কাঁচামাল আমদানিতে বড় ধাক্কা লাগে। কমতে থাকে রিজার্ভ, শুরু হয় ডলার সংকট। এ কারণে বন্ধ হয়ে যায় এলসি। একের পর এক কমতে থাকে বায়ারদের ক্রয় আদেশ। নতুন করে যুক্ত হয় গ্যাস সংকট, জ্বালানি ও বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততার সঙ্গে চড়া দাম। পাশাপাশি বাড়ে পরিবহন ভাড়া।
তারা আরও জানান, নানা সমস্যার সত্ত্বেও গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়নি। নিয়মিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন-ভাতা পেয়েছেন। একজন কর্মীও চাকরি হারাননি। উল্টো গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠান মিলে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এমনকি ব্যাংক ঋণের কিস্তি সীমিত হলেও নিয়মিত পরিশোধ করে যাচ্ছে গ্রুপটি।
অন্যদিকে চলতি বছরে উত্তরবঙ্গের চাহিদানুযায়ী দেশবন্ধু সিমেন্ট কারখানার সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। যা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সরকারের কোষাগারে জমা হবে মোটা অঙ্কের ভ্যাট ও ট্যাক্স। রাজধানীর উত্তরখানে দেশবন্ধু গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সাউথ ইস্ট সোয়েটার লিমিটেড ও জিএম অ্যাপারেলস লিমিটেড। গত বছর এর বাণিজ্য কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
সার্বিক বিষয়ে দেশবন্ধু গ্রুপের পরিচালক (প্রশাসন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাকির হোসেন বলেন, করোনায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রতিটি দেশই বিপর্যস্ত। সেই ধাক্কা কাটতে না কাটতে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে সারাবিশ্বে আমদানি-রপ্তানিতে বিরূপ প্রভাব পড়ে।
তিনি বলেন, দেশবন্ধু গ্রুপের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলো শুধু রপ্তানিনির্ভর। সে সব কোম্পানি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যুদ্ধের কারণে। এমন বাস্তবতা সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অব্যাহত রেখে দেশ ও দেশের মানুষের সেবায় কাজ করে যাচ্ছে দেশবন্ধু গ্রুপ। শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, রপ্তানি করা সব ধরনের পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে দেশবন্ধু।
জাকির হোসেন বলেন, দেশবন্ধু গ্রুপ একটি মানবিক ও কর্মীবান্ধব প্রতিষ্ঠান। এদিকে খুব অল্প সময়েই দেশবাসীর মন জয় করেছে দেশবন্ধু বেভারেজের সব ধরনের পণ্য। বিশেষ করে দেশবন্ধু মিনারেল ওয়াটার সারাদেশে ব্যাপক চাহিদা তৈরি করতে পেরেছে। ফলে গত বছরে দেশবন্ধু বেভারেজ কারখানার নতুন সেকশনসহ সার্বিক উন্নয়নে করোনার মধ্যেই দুইশ কোটি টাকার বেশি নতুন বিনিয়োগ করা হয়েছ।
তিনি বলেন, কারখানায় উন্নত প্রযুক্তির ইটালিয়ান মেশিনারিজ স্থাপন করা হয়েছে। চলতি বছরের মধ্যেই উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে ধীরগতিতে চলছে উৎপাদন কাজ। তবে কারখানার নতুন মেশিনারিজে পুরোদমে উৎপাদন শুরু হলে প্রতি ঘণ্টায় উৎপাদন হবে ৭৫ হাজার (বিপিএইচ) বোতল। অর্থাৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে ৬৫ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থান হবে প্রায় দেড় হাজার মানুষের।
দেশবন্ধু গ্রুপের আবাসিক পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এবিএম আরসাদুল হোসেন বলেন, উৎপাদন বাড়াতে দেশবন্ধু সুগার মিলসে এক হাজার কোটি টাকা নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এতে উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। বর্তমানে আমরা প্রতিদিন ৮শ থেকে সাড়ে ৮শ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করছি। নতুন বিনিয়োগের ফলে এই উৎপাদন বেড়ে দেড় হাজার মেট্রিক টন হয়ে যাবে।
দেশবন্ধু বেভারেজের কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক মারুফ হোসেন বলেন, দেশবন্ধু ফুড অ্যান্ড বেভারেজ দেশবন্ধু গ্রুপের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। কোনো অবস্থাতেই পণ্যের মানের বিষয়ে ছাড় দেওয়া হয় না। শতভাগ কোয়ালিটি বজায় রেখে নিজস্ব কারখানায় উৎপাদন পণ্যের মাণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
তিনি বলেন, বেভারেজ তৈরিতে যেসব কাঁচামাল ব্যবহৃত হয়, এর সবই অস্ট্রেলিয়া, ইতালি ও ব্রাজিলসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু বর্তমানে ডলারের দর বৃদ্ধি ও এলসি না পাওয়ার কারণে পূর্ণমাত্রায় উৎপাদনে যাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, দেশবন্ধু বেভারেজের নিজস্ব কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে দেশবন্ধু মিনারেল ওয়াটার, দেশবন্ধু কোলা, ফ্রেন্ডস আপ, দেশবন্ধু লিচি, দেশবন্ধু জিরা, দেশবন্ধু অরেঞ্জ, দেশবন্ধু ম্যাংগো জুস, গুড় ও নিয়নসহ মোট ১৮টি ফ্লেবার। দেশবন্ধু বেভারেজে উৎপাদিত পণ্য দেশে বিক্রি ছাড়াও দুবাই, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, গ্রিসেও রপ্তানি হচ্ছে।
দেশবন্ধু প্যাকেজিং ও পলিমার লিমিটেডের প্রধান (বৈদেশিক বিপণন) মো. শফিউল আজম তালুকদার বলেন, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে দেশবন্ধু গ্রুপ পালন করছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে আনছে বৈদেশিক মুদ্রা।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত গ্রুপের একমাত্র প্রতিষ্ঠান দেশবন্ধু পলিমার। সরেজমিনে দেখা যায়, পলিমারের উৎপাদন কার্যক্রম বেশ গোছালো ও আন্তরিকতার সঙ্গে করছেন কর্মীরা।
দেশবন্ধু পলিমারের মহাব্যবস্থাপক ইঞ্জিনিয়ার সাখাওয়াত হোসেন জানান, দেশবন্ধু সুগার মিলস চালু হওয়ার পর মোড়কের জন্য প্রতি বছর ৩৫ থেকে ৩৬ লাখ চিনির ব্যাগ প্রয়োজন হয়, সেই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৬ সালে দেশবন্ধু পলিমার কারখানা স্থাপন করা হয়। প্রথমে তাইওয়ানের মেশিনারি দিয়ে স্বল্প পরিসরে অর্থাৎ বার্ষিক এক কোটি ব্যাগ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন মিল স্থাপন করা হয়। পরবর্তীসময়ে আরও মেশিনারিজ সংযোজনের মাধ্যমে ২০১৩ ও ২০১৬ সালে আরও উৎপাদন বৃদ্ধি করে সিমেন্ট ব্যাগসহ বর্তমানে এর উৎপাদন ছয় কোটি ব্যাগে উন্নত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে কানাডা যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে দেশবন্ধু পলিমার ও দেশবন্ধু প্যাকেজিংয়ের ডব্লিউপিপি ব্যাগ, ওয়ান ও ডাবল প্লাই সিমেন্ট ব্যাগ, বিওপিপি (সুইং ও পেস্টিং) ও এফআইবিসি ব্যাগ।
১৯৮৯ সালে ট্রেডিং ও সার আমদানির মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে ‘দেশবন্ধু’। এ বছর গ্রুপটি অগ্রগতির ৩৩ বছর উদযাপন করেছে। দেশবন্ধু পলিমার, দেশবন্ধু সিমেন্ট, সাউথইস্ট সোয়েটার, দেশবন্ধু শিপিং, জিএম হোল্ডিংস, সাহেরা অটো রাইস মিলস, দেশবন্ধু সিকিউরিটি সার্ভিসেস, ট্রেডিং কোম্পানিজ, দেশবন্ধু পাওয়ার প্ল্যান্ট, দেশবন্ধু টেক্সটাইল, দেশবন্ধু ফাইবার, দেশবন্ধু কনজ্যুমার অ্যান্ড অ্যাগ্রো, সাহেরা ওয়াসেক হাসপাতাল, দেশবন্ধু পার্সেল অ্যান্ড লজিস্টিকস এবং দেশবন্ধু মিডিয়া দেশের বেসরকারি খাতে কাজ করছে।
এমএএস/আরএডি/জেআইএম