সাত কলেজের ৭ বছর
কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি, ঢাবিকে আরও আন্তরিক হতে হবে

২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত করা হয়। অধিভুক্তির সাত বছর পূর্ণ করেছে সাত কলেজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারি সাত কলেজকে ঢাবির অধিভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে সাত কলেজের শিক্ষার মানের কতটা উন্নয়ন হয়েছে, বর্তমানে সংকটইবা কতটুকু? এছাড়া ভর্তি প্রক্রিয়া, পরীক্ষা পদ্ধতি, খাতা মূল্যায়নসহ সর্বোপরি শিক্ষা সংকট আদৌ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কাটিয়ে উঠতে পেরেছে কি না- এসব বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা কলেজ শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক এবং সেভেন কলেজ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ড. মো. আব্দুল কুদ্দুস সিকদার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের ঢাকা কলেজ প্রতিনিধি মো. নাহিদ হাসান।
জাগো নিউজ: অধিভুক্তির সাত বছরে শিক্ষার মানের কতটা উন্নয়ন হলো?
ড. মো. আব্দুল কুদ্দুস সিকদার: শিক্ষার মানোন্নয়ন হোক তা বরাবরই চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে সাত কলেজের অধিভুক্তি একটা নতুন অধ্যায়। পরবর্তীকালে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন কলেজ যাবে। এরকম একটা পরিকল্পনা আছে। প্রধানমন্ত্রীর এ পরিকল্পনাকে আমরা স্বাগত জানাই। ঢাবিতে অধিভুক্তি আমরা সাদরে গ্রহণ করেছি। আমাদেরও চাওয়া শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পাক।
আরও পড়ুন: চাকরি-বিদেশে পড়াশোনায় বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা
একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে আমরা যখন যাত্রা শুরু করি খুব দ্রুতই যে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় তেমন নয়। সবসময় সেটি সম্ভব হয়ে ওঠে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমাদের পথচলার সাত বছর পূর্ণ হয়েছে। এখন এই প্রশ্ন আমাদেরও করা উচিত যে মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা কতটা অগ্রসর হয়েছি। আমরা সন্তুষ্ট হতে পারবো না এই কারণে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হলেও তার অধিভুক্ত সাত কলেজে যে গতিতে শিক্ষার মানোন্নয়ন হওয়ার কথা সেখানে গতিশীলতার অভাব আছে। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। তারপরও আমি বলবো আগের তুলনায় শিক্ষার মানের অগ্রগতি হয়েছে, অনেক কিছুরই উন্নয়ন হয়েছে।
জাগো নিউজ: আপনি বলছেন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি। কেন এমনটা মনে হচ্ছে?
ড. মো. আব্দুল কুদ্দুস সিকদার: কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর অনেকগুলো ক্রাইটেরিয়া আছে। এর অন্যতম দুটি হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষক ও মানসম্মত পরিবেশ। মানসম্মত পরিবেশের সঙ্গে মানসম্মত ইকুইপমেন্টসও প্রয়োজন। আমি যদি বিজ্ঞান শিক্ষার কথা বলি, সাত কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে যে পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সেটা নিয়ে আরও উদ্যোগী হতে হবে।
উদাহরণ হিসেবে বলি, আমাদের যে ল্যাবগুলো আছে সেগুলো আধুনিকীকরণ করা হয়নি। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। পরিবেশগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। যেমন- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ কী ছিল.. সেশনজট। সেই সেশনজট দূর করতে তারা দ্রুত পরীক্ষা নেওয়া শুরু করলো। ভর্তির পর অনেক ক্ষেত্রে আট মাসের মধ্যে পরীক্ষার সময়সূচি দেওয়া হতো। আমি মনে করি এটা যথার্থ পদক্ষেপ নয়। সিলেবাস শেষ না করে যদি শুধু পরীক্ষা নেওয়া হয় তাহলে সেখানে শিক্ষার্থী থাকে না, শুধু পরীক্ষার্থীই থাকে। সেই অভিযোগ থেকে আমরা এখনো বের হতে পারিনি।
আরও পড়ুন: সাত কলেজের সমস্যা সমাধানে কর্মপরিকল্পনা করা হবে
জাগো নিউজ: শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে কি না?
ড. আব্দুল কুদ্দুস সিকদার: সাত কলেজের শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে হলে শিক্ষকদের মানোন্নয়নও করতে হবে। ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই জায়গায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। সিলেবাস আর কারিকুলাম যেটা আপডেট করা হচ্ছে। সেই জায়গায়ও সাত কলেজ পিছিয়ে। কিংবা কোথাও কোথাও সামান্য পরিবর্তন এসেছে।
জাগো নিউজ: সাত কলেজের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথক নীতিমালা আছে কি না। এর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
ড. আব্দুল কুদ্দুস সিকদার: সাত কলেজের জন্য পৃথক একটি নীতিমালা প্রয়োজন ছিল। সেই নীতিমালার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে চলা উচিত ছিল। ঢাবিতে এক ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে অন্য ডিপার্টমেন্টের মিল নেই। কেউ তিন ঘণ্টা পরীক্ষা নিচ্ছে, কেউ নিচ্ছে চার ঘণ্টা। সামঞ্জস্যতা বিধান হচ্ছে না। ফলে খাতা মূল্যায়নেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পরীক্ষার সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করে। যেখানে তিনজন সদস্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। বাকি দুজন থাকেন সাত কলেজ থেকে। এখানে তিনজনের মধ্যেই আহ্বায়ক রাখা হচ্ছে। সাত কলেজের কোন শিক্ষককে আহ্বায়ক করা হচ্ছে না।
আরও পড়ুন: সাত কলেজের মান মূল্যায়নের সুযোগ হয়নি: ঢাবি উপাচার্য
যখন কোনো চিঠি দেওয়া হয় সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন লেকচারারের অধীনে নাম থাকে সাত কলেজের একজন প্রফেসরের। এই যে একটা মানসিক দৈন্য এটা যতক্ষণ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূর না হবে... ততক্ষণ ভালো কিছু আশা করা যায় না। অনেক সময় শিক্ষকরা সাত-আট মাস ঘুরেও বিল পান না। শিক্ষকদের সাথে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও পাওয়া যায়। এগুলো মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা।
জাগো নিউজ: সাত কলেজের একাডেমিক বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নির্ভর করে আর প্রশাসনিক বিষয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেখে। এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা আছে কি না?
ড. আব্দুল কুদ্দুস সিকদার: আমাদের শিক্ষক দরকার হলে বা পদ সৃষ্টির প্রয়োজন হলে সেখানে দেখা দেয় জটিল প্রক্রিয়া। একজন শিক্ষক যখন সাত কলেজের পাঠদান প্রক্রিয়া, প্রশ্নপত্র প্রণয়নে অভ্যস্ত হয়ে যান সেই শিক্ষক যখন অন্যত্র চলে যান এবং নতুন শিক্ষক আসেন তখন বিশাল একটা গ্যাপ তৈরি হয়। কর্তৃপক্ষ যদি এটি বিবেচনা করে যে, তুলনামূলক অভিজ্ঞ শিক্ষকদের যেন বদলি করলেও যথাসম্ভব সাত কলেজের মধ্যে রাখা হয়। সেটি করা গেলে তা মানসম্মত শিক্ষার জন্য সহায়ক হবে।
জাগো নিউজ: পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও সিলেবাস প্রণয়নে সাত কলেজের শিক্ষকদের ভূমিকা কতটুকু?
ড. আব্দুল কুদ্দুস সিকদার: এখানে সাত কলেজের শিক্ষকদের ভূমিকা অনেকটাই গৌণ। সিলেবাস পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে একাডেমিক কমিটি ও বিভাগীয় প্রধানরা তা করেন। কিন্তু এরপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে পরিমাণ আন্তরিকতা থাকা প্রয়োজন সেখানে ঘাটতি রয়েছে।
আমি যদি আমার ইতিহাস বিভাগের কথা বলি, এর সিলেবাস পরিবর্তন করা প্রয়োজন। সমাজ এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন শুধু রাজা-রানিদের কাহিনি পড়ালে চলবে না। পাঠ্যবইয়ে সমাজের প্রতিটি বিষয় যুক্ত করার প্রয়োজন আছে। অর্থনীতির ইতিহাস, সামাজিক পরিবর্তন, সোশ্যাল কনফ্লিক্টগুলো গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে আনতে হবে। সিলেবাসে যা আছে সেগুলো পড়ে শিক্ষার্থীরা কোনো লক্ষ্য ঠিক করতে পারছে বলে আমার মনে হয় না।
আরও পড়ুন: সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা এখন চাকরিতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে
এই জায়গায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গুরুত্ব দিয়ে সিলেবাসকে আরও আধুনিক করতে হবে। সিলেবাস পরিবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সিস্টেম তাতে একেবারেই আমি দ্বিমত পোষণ করি। এটা আমার কাছে গতানুগতিক মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী যে স্বপ্ন নিয়ে সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দিয়েছিলেন সেই স্বপ্নের ব্যাঘাত ঘটছে। আমরা সামনে যাচ্ছি ঠিক, কিন্তু যে গতিতে যাওয়া দরকার, যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া দরকার সেটা হচ্ছে না।
জাগো নিউজ: সাত কলেজের পরীক্ষার খাতা সিঙ্গেল এক্সামিনার দেখেন। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
ড. আব্দুল কুদ্দুস সিকদার: সাত কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করেন। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য শিক্ষার্থীর খাতার যথার্থ মূল্যায়ন। সেই মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একটা ধারণা প্রচলিত যে, দুজন শিক্ষক খাতা দেখবেন। তারপর উভয়ের নম্বর গড় করে মূল্যায়ন করা হবে। এতে শিক্ষার্থীর যেমন অতিমূল্যায়ন হওয়ার সুযোগ নেই তেমনি অবমূল্যায়ন হওয়ার সুযোগও নেই। এখন সাত কলেজের খাতা একজন এক্সামিনার দেখেন। এজন্য মাঝে মধ্যে দেখি শিক্ষার্থীরা এক বিষয়ে গণহারে ফেল করছে। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের কিছু অভিযোগ সঠিক। সেশনজট কমাতে একজন পরীক্ষক দিয়ে খাতা দেখিয়ে ফলাফল প্রকাশ করা যাবে। কিন্তু তাতে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের মানসম্মত শিক্ষার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: ঢাকায় সব সরকারি কলেজ অধ্যক্ষের কক্ষে বসবে সিসি ক্যামেরা
জাগো নিউজ: অধিভুক্তির পর সাত কলেজের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা কি বেড়েছে? নাকি বিশ্ববিদ্যালয় আর মন্ত্রণালয়ের টানাপোড়েনে তা সংকুচিত হয়েছে?
ড. আব্দুল কুদ্দুস সিকদার: আমরা সরকারি চাকরি করি। সরকার আমাদের বেতন দিচ্ছে। আমি যেখানে যে অবস্থায় থাকি আমাকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সরকার যে বেতন দেবে, সুযোগ-সুবিধা দেবে তাতে আমার সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এর বাইরে গিয়ে যদি বলি তাহলে বলতে হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসার পর শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা উল্টো কমেছে। কারণ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিশাল পরিসর ছিল। উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, কোনো পরীক্ষা হলে আমি সরকারি বিএল কলেজ বা রাজেন্দ্র কলেজে ভাইবা নিতে গেলাম। সেখানে যাতায়াতের বাইরেও একটা সম্মানী পেতাম। আবার খাতা দেখা, প্রশ্ন প্রণয়ন এসবেও আর্থিক সুবিধা থাকতো। অধিভুক্তির পর সেগুলো সংকুচিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কাজ এখনো ম্যানুয়াল। সেখানে অ্যানালগ পদ্ধতিতে বিল পেমেন্ট করা হয়। এগুলো নিয়ে হতাশার জায়গাও আছে।
আমরা যেহেতু যাত্রা শুরু করেছি, ফলে প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য অর্জনে যে গতিতে যেভাবে পরিবর্তন আনা সম্ভব সেভাবেই এগোতে হবে। সেক্ষেত্রে সাত কলেজের প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও আন্তরিক হতে হবে। কারণ, আমরা তাদের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ফ্রন্টলাইনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
জাগো নিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. আব্দুল কুদ্দুস সিকদার: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
এমকেআর/জেআইএম