গল্প পরিচিতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সুভা’: সমাজের প্রতিচ্ছবি

‘মেয়েটির নাম যখন সুভাষিণী রাখা হইয়াছিল তখন কে জানিত সে বোবা হইবে। তাহার দুটি বড় বোনকে সুকেশিনী ও সুহাসিনী নাম দেওয়া হইয়াছিল, তাই মিলের অনুরোধে তাহার বাপ ছোটো মেয়েটির নাম সুভাষিণী রাখে। এখন সকলে তাহাকে সংক্ষেপে সুভা বলে।’ কবিগুরু বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘সুভা’ শুরু হয়েছে ঠিক এভাবেই।
‘সুভা’ একটি মর্মস্পর্শী বাংলা ছোটগল্প; যা প্রেম, যোগাযোগ এবং সামাজিক প্রত্যাশার বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। গল্পটি সুভাষিণী নামে এক তরুণীকে ঘিরে রচিত হয়েছে। যাকে আদর করে সুভা বলা হয়, কিন্তু সে আসলে বোবা। কথা বলতে না পারা সত্ত্বেও সুভা গভীরভাবে অভিব্যক্তিপূর্ণ। প্রকৃতি এবং প্রাণীর সাথে তার সম্পর্কের মধ্যে সান্ত্বনা খুঁজে পায়।
তাই তো লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘প্রকৃতি যেন তাহার ভাষার অভাব পূরণ করিয়া দেয়। যেন তাহার হইয়া কথা কয়। নদীর কলধ্বনি, লোকের কোলাহল, মাঝির গান, পাখির ডাক, তরুর মর্মর সমস্ত মিশিয়া চারিদিকের চলাফেরা-আন্দোলন-কম্পনের সহিত এক হইয়া সমুদ্রের তরঙ্গরাশির ন্যায় বালিকার চিরনিস্তব্ধ হৃদয় উপকূলের নিকটে আসিয়া ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়ে।’
সুভার বাবা-মা তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়, বিশেষ করে তার বিয়ে নিয়ে। প্রকৃতি এবং প্রাণীদের সাথে সুভার বন্ধন একটি মূল বিষয়। কারণ তারা তাকে সাহচর্য এবং বোঝার অনুভূতি দেয়। যা সে মানুষের কাছ থেকে পায় না। সুভাষিণী যে বোবা, সে কথা জানার পরও প্রতাপ তাকে বিয়ে করার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু প্রতাপের অহংকারী বাবা তা মেনে নেয়নি। এ ক্ষেত্রে প্রেমিক পুরুষের প্রাপ্তি একটি উজ্জ্বল বিষয় রূপে পরিগণিত হয়েছে।
তাই তো গল্পে দেখা যায়, ‘কন্যাভারগ্রস্ত পিতামাতা চিন্তিত হইয়া উঠিয়াছেন। লোকেও নিন্দা আরম্ভ করিয়াছে। এমন-কি, এক-ঘরে করিবে এমন জনরবও শুনা যায়। বাণীকণ্ঠের সচ্ছল অবস্থা, দুই বেলাই মাছভাত খায়, এজন্য তাহার শত্রু ছিল।’
অবশেষে সুভার বাবা-মা তার নিঃশব্দতা সম্পর্কে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির সাথে তার বিবাহের ব্যবস্থা করে। বিয়ের পর দেখা যায়, ‘সে কাহাকেও প্রতারণা করে নাই। তাহার দুটি চক্ষু সকল কথাই বলিয়াছিল, কিন্তু কেহ তাহা বুঝিতে পারে নাই। সে চারিদিকে চায়— ভাষা পায় না— যাহারা বোবার ভাষা বুঝিত সেই আজন্মপরিচিত মুখগুলি দেখিতে পায় না— বালিকার চিরনীরব হৃদয়ের মধ্যে একটা অসীম অব্যক্ত ক্রন্দন বাজিতে লাগিল— অন্তর্যামী ছাড়া আর-কেহ তাহা শুনিতে পাইল না।’
গল্পটি একটি দুঃখময় পরিস্থিতিতে শেষ হয়। যা সামাজিক চাপের করুণ পরিণতি। যারা এমন পরিস্থিতির শিকার তাদের জন্য বোঝার এবং সহানুভূতির অভাবকে তুলে ধরেছে। সুভা হলো তাদের নীরব যন্ত্রণার প্রতিফলন। যারা সামাজিক নিয়ম মেনে চলতে পারেন না। এটি ঐতিহ্যগত সমাজে ব্যক্তি, বিশেষ করে নারীদের ওপর আরোপিত কঠোর প্রত্যাশার সমালোচনা করে।
সুভা গল্পটি মূল চরিত্রকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আলোচ্য গল্পে সুভা নামের বোবা মেয়েটির মূল বেদনাকে লুকিয়ে রেখেছেন। ভাষাহীন মেয়ের এমন নাম আর এই নির্বাক মেয়েটির ক্রমপরিণতি পাঠককে এক নিদারুণ বেদনার মধ্যে নিয়ে যায়। সুভার ভাষাহীনতাই গল্পের আগাগোড়া প্রাণ সঞ্চার করেছে। সুভার মতো নারীদের মনোবেদনা উচ্চকিত হয়েছে এই গল্পে। অব্যক্ত বেদনাকে শৈল্পিক উপায়ে উপস্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ছোটগল্পের জনক। বাংলা ছোটগল্পকে তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। কেননা বাংলা ছোটগল্পের সার্থক সূচনা তার হাতেই। এমনকি প্রকৃতির সঙ্গে এক অকৃত্রিম নিবিড়তা সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিরন্তন শিল্পবৈচিত্র্য। তাই তো তিনি এক বিমূর্ত যন্ত্রণার অব্যক্ত অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করেছেন এই গল্পে। বিখ্যাত গল্পটি নিয়ে বাংলাদেশে নাটক ও সিনেমা নির্মিত হয়েছে। তাই তো গল্পটি পাঠক এবং দর্শকের হৃদয়কে নাড়া দিতে পেরেছে।
এসইউ/জেআইএম