রাজকীয় পেঙ্গুইন স্যার নিলস ওলাভ

এডিনবার্গ চিড়িয়াখানার সকালগুলো হয় প্রাণবন্ত। দর্শনার্থীদের কোলাহল, পশুপাখিদের ডাকাডাকি আর চিড়িয়াখানার কর্মীদের ব্যস্ততা মিলিয়ে যেন এক অনন্য সুর বেজে উঠে প্রতিদিন। কিন্তু সেদিনের সকালটা ছিল ব্যতিক্রম। চিড়িয়াখানার রাজপথ বরাবর সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে সামরিক পোশাক পরা কিছু মানুষ, হাতে জাতীয় পতাকা আর ফুল। মাঝখানে লাল গালিচা পাতা, যেন কোনো রাজাকে অভ্যর্থনা জানানো হবে।
আর ঠিক সেটাই ঘটতে চলেছে। মাঠের এক প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো একটি রাজকীয় পেঙ্গুইন। নাম তার স্যার নিলস ওলাভ তৃতীয়। তার চলার ভঙ্গিতে যেন আছে আত্মবিশ্বাস, গাম্ভীর্য। আর আজ, এই পেঙ্গুইনের কাঁধেই বসবে নতুন এক সম্মান ‘নাইটহুড’, অর্থাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্মানিত ‘স্যার’ উপাধি।
পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, ‘একটি পেঙ্গুইন আর নাইটহুড?’ এটি কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, বরং বাস্তব ইতিহাস।
সবকিছুর সূচনা ১৯৭২ সালে, যখন নরওয়ের রাজকীয় গার্ড স্কটল্যান্ড সফরে এসে ভিজিট করে এডিনবার্গ চিড়িয়াখানা। সেখানে প্রথমবার একদল রাজকীয় পেঙ্গুইনের সঙ্গে পরিচয় হয় তাদের। সেই মুহূর্তেই তারা একটি পেঙ্গুইনকে নিজেদের গার্ডের সম্মানসূচক সদস্য হিসেবে ঘোষণা করে। নাম রাখা হয় নিলস ওলাভ। এটি রাখা হয় নরওয়ের তৎকালীন রাজা কিং ওলাভ পঞ্চম এবং এক সম্মানিত সামরিক কর্মকর্তার সম্মানে।
এরপর শুরু হয় এক অভিনব ঐতিহ্য। নরওয়ের গার্ড প্রতি সফরে এসে সেই পেঙ্গুইনের উত্তরসূরিকে পদোন্নতি দিতে থাকে যেমন: ল্যান্স কর্পোরাল, কর্পোরাল, মেজর, লেফটেন্যান্ট কর্নেল, একসময় ‘কর্নেল-ইন-চিফ’।
সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত আসে ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট, যখন নরওয়ের গার্ড তাকে ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করে। এডিনবার্গ মিলিটারি ট্যাটু চলাকালীন আয়োজিত হয় এক জমকালো সামরিক কুচকাওয়াজ, আর স্যার নিলস ওলাভ তৃতীয়ের গলায় পরানো হয় সম্মানসূচক পদক।
এটা শুধু একটি মজার ঘটনা নয়, বরং এটা প্রাণীদের প্রতি সম্মান, আন্তঃদেশীয় বন্ধুত্ব এবং সংস্কৃতির মেলবন্ধনের প্রতীক।বর্তমানে এই পেঙ্গুইন হলেন নিলস ওলাভ তৃতীয়, যিনি ২০১৩ সাল থেকে এই সম্মান বহন করে আসছেন। সর্বশেষ ২০২৩ সালে, তাকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। যা গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে অনন্য নজির হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
স্যার নিলস কেবল একটি পেঙ্গুইন নয়, তিনি এখন স্কটল্যান্ড ও নরওয়ের মধ্যকার এক ভিন্নধর্মী কূটনৈতিক বন্ধনের প্রতীক। চিড়িয়াখানার তারকা এই পেঙ্গুইনকে ঘিরে নানা রকম আয়োজন হয়। শিশুরা তার সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, কেউ কেউ তার মতো হাঁটতে শেখে, অনেকে আবার তার ছবি এঁকে স্কুলে নিয়ে যায়।
একবার একটি শিশু তার বাবাকে বলেছিল, ‘আমি সৈনিক হব, আর স্যার নিলস হবে আমার বস!’ সে সময় এই কথাটি ছড়িয়ে পড়েছিল এবং এটি স্যার নিলস ওলাভের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রাণীজগৎ আমাদের শুধু বিনোদন দেয় না, অনেক সময় তারা ইতিহাসও তৈরি করে। স্যার নিলস ওলাভ তৃতীয় তার জীবনচরিত দিয়ে প্রমাণ করেছে সম্মান, নেতৃত্ব এবং বন্ধুত্ব কখনো জাতি, ভাষা বা প্রজাতির সীমারেখায় আটকে থাকে না।
আজ বিশ্ব পেঙ্গুইন দিবসে, তাই মনে পড়ে যায় সেই চিড়িয়াখানার রাজপথ, লাল গালিচা, কুচকাওয়াজ আর এক পেঙ্গুইনের পদক্ষেপ। যে নিজের জাতিকে তুলে ধরেছিল অনন্য এক সম্মানের আসনে।
- আরও পড়ুন
- তুষারের শহর থেকে মহাকাশে লাইকা
সূত্র: স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন, এডিনবার্গ জু, গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস
কেএসকে/এএসএম