বাবার হাতের ‘হারকিউলিস’

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:২৩ পিএম, ১৮ জুন ২০২৩

ফাত্তাহ তানভীর রানা

প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্বব্যাপী বাবা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আজ বিশ্ব বাবা দিবস। আমার বাবা ১৯৯০ সালে হার্ট অ্যাটাক করে না ফেরার দেশে চলে যান। তখন আমি মাত্র সাত বছরের। বাবার সঙ্গে আমার খুব কম স্মৃতি থাকলেও তার প্রতি অনুভূতি আছে। বয়সের কারণে আমি স্মৃতি মনে ধারণ করতে পারিনি। তবুও ভাসা-ভাসা কিছু স্মৃতি মনে পড়ে। খুব ছোটবেলায় বাবার দ্বিচক্রযান নিয়ে আমার ভীষণ আগ্রহ ছিল। দ্বিচক্রযান কেন্দ্রিক স্মৃতি আমার মনে দাগ কেটে আছে।

পৈতৃকসূত্রে আমি সেই বাইসাইকেল পেয়েছিলাম। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আমি বিষয়টি বেশ ভালো ভাবেই বুঝেছিলাম। কারণ সাইকেল কারো প্রয়োজন হলে বা কোথাও নেওয়ার দরকার হলে আমার কাছে অনুমতি নিতে আসতেন। বয়সের কারণে সাধারণত কাউকে না বলা হয়ে ওঠেনি। তখনকার দিনে গ্রাম অঞ্চলের মানুষের সাইকেল সব বাড়িতে থাকতো না। আমার বাবা চাকরিজীবী হওয়ার কারণে তার একটা বাইসাইকেল ছিল।

এই বাইসাইকেলের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়-অনাত্মীয়, গ্রামবাসী অনেকের স্মৃতি জড়িত। অনেকেই এ বাইসাইকেলে চড়েই সাইকেল চালানো শিখেছেন। অনেকেই চড়েছেন, সময় ও অর্থ সাশ্রয় করেছেন। কিন্তু সাইকেল যখন নষ্ট হয়েছে; তখন খুব কম মানুষের দেখা মিলেছে এটিকে ঠিক করে নেওয়ার জন্য। যা-ই হোক, সাইকেলের কোম্পানির নাম না জানা থাকলেও হ্যান্ডেলের গায়ে মেড ইন ইংল্যান্ড লেখা ছিল। কথ্য ভাষায় মুরুব্বিরা অনেকেই বলতেন, ‘হারকিউলিস কোম্পানির সাইকেল’।

আরও পড়ুন: একবছর পর আব্বাকে ডেকেছিলাম

সাইকেলখানা আমার শৈশব ও কৈশোরের সাথী ছিল। আমি কলেজে পড়েছি, সেই সাইকেল চালিয়ে বাসা থেকে যাতায়াত করেছি। আমি দাদার বাড়ি গিয়েছি সাইকেল চালিয়ে। হাট-বাজারসহ অনেক উপকারে লেগেছে সাইকেলটি। মনে পড়ে, ক্লাস শেষ করে গ্যারেজে এসে দেখি, সাইকেল উল্টো করে রাখা! কে করলো এমন! কেউ বলতে পারেনি। সাইকেল চালানোর সময় বুঝতে পারলাম, চাকার পাম্প ছেড়ে দেওয়া হয়েছে! তখন সাইকেলসহ আমি হেঁটে মেকারের বাড়ি গিয়ে হাওয়া দিয়ে নিই। এ সাইকেল নিয়ে আরও অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি। প্রসঙ্গত, বলা যেতে পারে সাইকেলটি পুরাতন মডেলের ছিল এবং চেহারাও সনাতন ছিল।

আমার বাবা মোহাম্মদ আলী এ দ্বিচক্রযান বহুলভাবে ব্যবহার করতেন। তিনি নাটোর জেলার শহীদ শামসুজ্জোহা কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক ছিলেন। কলেজে আসা-যাওয়া, আমার দাদা-দাদির সঙ্গে গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখা করা ও আনুষঙ্গিক অনেক কাজ সারতে বাবা দ্বিচক্রযানটি ব্যবহার করতেন। তখন কালে-ভদ্রে আমিও চড়েছি বাবার সঙ্গে।

একদিন সকালে উঠে বাজারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। বলে নেওয়া ভালো, তখন আমার বাড়িতে নির্মাণ কাজ চলছিল। বারান্দায় সাইকেল নেই! সকালে কাঠমিস্ত্রি এসেছিলেন! তিনি তো এমন মানুষ নন; তবে কে নিয়েছে সাইকেল? রাজমিস্ত্রিরাও কাজে এসেছেন। আমি কোথাও সাইকেল খুঁজে পাচ্ছি না, সাইকেল লক করা ছিল। এমন সময়ে জানতে পারলাম, রাজমিস্ত্রিদের নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত লোহার যন্ত্রগুলো নেই! তাদের অনেক দামি যন্ত্রও ছিল। সাইকেলও তো লোহারই! কিন্তু প্রাচীর ঘেরা বাড়িতে রাতে এমন একটা পুরাতন সাইকেল কে নেবে?

আরও পড়ুন: বাবা, আপনাকে অনেক ভালোবাসি

বারবার মনে হচ্ছিল, কেউ রসিকতা করে আমার সাইকেল সরিয়ে রেখেছে। কে আমার সাইকেল বিনা অনুমতিতে নিয়েছিল, তা আজও জানতে পারিনি। আমার বিপদের বন্ধু, অনেক স্মৃতির অংশীদার বাইসাইকেলটিতে আমার বাবার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। অন্য সাইকেলের সঙ্গে এ সাইকেলের পার্থক্য এখানেই। আমার বাবার সঙ্গে আমি সাইকেলে চড়েছি একাধিকবার। চুরি হওয়ার কুড়ি বছর পরেও সাইকেলটির কথা বারবার মনে পড়ছে। সাইকেলের কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে বাবার কথা। দ্বিচক্রযানটি আমার বাবার ছিল এবং তা আমারও ছিল।

আজ ১৮ জুন, আমার বাবার ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। আমরা বড় হচ্ছিলাম; বাবার কাছে আমাদের প্রয়োজন যখন শুরু হলো, তখন বাবা পাশে নেই। বাবার আদর-শাসন, বাবার আর্থিক সাপোর্ট, বাবার বটগাছের মতো ছায়া—সবই প্রয়োজন ছিল। বাবার উপস্থিতিসহ সবকিছু থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম। হঠাৎ করে কোথা থেকে কী যেন হয়ে গেল। ২০২৩ সালের বিশ্ব বাবা দিবসই আমার বাবার মৃত্যুর দিন। বিশ্বের সব বাবার প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: ব্যাংকার ও গল্পকার।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।