প্রজন্মের চেতনায় স্বাধীনতা


প্রকাশিত: ০৩:৪২ এএম, ২৬ মার্চ ২০১৫

রায়ানের বয়স আট বছর। এইটুকু বয়সেই সে বাবার কাছ থেকে শিখেছে পতাকা ওড়ানোর নিয়মাবলি। সে এখন জানে, ‘সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পতাকা ওড়াতে হবে। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ও সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বাহন ছাড়া রাতে জাতীয় পতাকা ওড়ানো দণ্ডনীয় অপরাধ। দণ্ডায়মান স্তম্ভের চূড়ায় পতাকা বেঁধে রাখতে হবে। কোণাকৃতিভাবে দণ্ডায়মান স্তম্ভের সঙ্গে পতাকা বাঁধা যাবে না।’ সে তার বাবার কাছে আরও শুনেছে এই লাল-সবুজ পতাকা কেমন করে আমাদের হল। এখন সে তার বন্ধুদেরও সেই গল্প শোনায়।

পুরান ঢাকার একটি রাস্তার ধারে বশিরের পান-চকোলেটের দোকান। বয়স তার কত হবে! পনের অথবা ষোল। পকেটে রাখা সস্তা চায়নিজ ফোন সেটে সে বাজিয়ে রেখেছে দেশের গান। এত গান থাকতে দেশের গান কেন বাজাচ্ছ জানতে চাইলে সে ভীষণ অবাক হয়! বলে, ‘দেশের গানের চেয়ে সুন্দর আর কোনও গান আছে না কি! শুনলেই কেমন মনটা ভালো হয়ে যায়। বারবার শুনতে মন চায়। আমি আমার নানির মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনছি। মুক্তিযোদ্ধারা কত কী করছে এই দেশটার জন্য! মনে মনে ভাবি আবার যদি মুক্তিযুদ্ধ হয়, আমি নিশ্চয়ই যুদ্ধে যামু।’

বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘ঘটনাবহুল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আজকের তরুণদের বেশির ভাগেরই অজানা। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও আমরা আমাদের উত্তরসূরিদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস পরিপূর্ণরূপে জানাতে পারিনি। এটি আমাদের অনেক বড় ব্যর্থতা। এরপরও আজকের তরুণ সমাজের সবাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার। তারা এক বাক্যে যুদ্ধাপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। সব মা-বাবার উচিত স্ব স্ব অবস্থান থেকে তাদের সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা। তাহলে একদিকে আমরা যেমন দায় মুক্ত হব, অন্যদিকে আবার সে চেতনাবোধ তাদের মাঝে সুদৃঢ় দেশপ্রেমর ভিত্তি স্থাপন করবে।’

বীরাঙ্গনা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষীণি বলেন, ‘একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক আমরা। কিন্তু যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা এই স্বাধীনতা অর্জন করেছি তার প্রকৃত ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে অস্পষ্ট ও অস্বচ্ছ। তাছাড়া যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছে তা খুব সীমিত পরিমাণে। তাই এই নতুন প্রজন্মের নাগরিকরা যখন আড্ডা দেয় তখন মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গটি আসে না বললেই চলে। নতুন প্রজন্মের নাগরিকদের মধ্যে দেশপ্রেম বৃদ্ধি পাচ্ছে, না কমছে তা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। তাই দেশপ্রেম বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এখনই। নতুন প্রজন্ম এখন বেড়ে উঠছে ভিন্ন একটা পরিবেশে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসবেই। কিন্তু সেই পরিবেশে দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদির ছোঁয়াও থাকা উচিত। এতে তারা গঠনমুখী হবে। বড় হয়ে দেশের কথা ভাববে।’

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন মনে করেন, ‘সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে মা-বাবাকেই এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি ঘরেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কিছু না কিছু থাকা উচিত। এটা তো আসলে দেশপ্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মারক ও স্মৃতিচিহ্ন দেখলে নতুন প্রজন্মের মনে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা তৈরি হবে। তারা এর তাৎপর্য বুঝতে শিখবে।’
বাংলার বুকে লাল-সবুজের কেতন উড়েছিল আজ থেকে ৪২ বছর আগে। ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীনতার জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল আকাশ-বাতাস। প্রত্যাশার সূর্য আজও হাতছানি দেয়। ঘুরেফিরে একটাই প্রশ্ন দেখা দেয়, স্বাধীনতা-বিজয়ের বেগবান গতি কতটা সঞ্চারিত এই প্রজন্মের কাছে?

ঢাকা মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী ইসরাত জাহান ইলা জানান, তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখেননি, কিন্তু একটি দেশে স্বাধীন হয়ে জন্ম নেয়াটা তার কাছে অনেক বড় পাওয়া। স্বাধীনতা দিবসে বারবার মনে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধের কথা। যার সব কিছুই শোনা শুরু হয়েছিল মায়ের কোলে বসে। পরবর্তিতে বই পড়ে। তার মতে স্বাধীনতার ইতিহাস জানাটা সবচেয়ে জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাহফুজ মানিক বলেন, ‘নিজের জায়গা থেকে নিজের কাজটা সঠিকভাবে করাটাই প্রকৃত দেশপ্রেম। সঠিকভাবে করতে না পারলে সেটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, যেটা ধীরে ধীরে জাতিগত ব্যর্থতায় রূপ নেয়। তবে যারা শুধু অন্যজনের দেখাদেখি বা চেতনাশূন্য হৃদয়ে বিশেষ কিছু দিনে এগুলো করে তাদের সম্পর্কে কিছুই বলার নেই। তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক এই কামনা করি।’

জাগিয়ে রাখুন দেশপ্রেম
এখন মুক্তিযুদ্ধের চিহ্নসংবলিত বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে। অনেকেই সেসব ব্যবহার করছেন। চাইলে মুক্তিযুদ্ধকে নিজের ও সন্তানের সঙ্গে সঙ্গেই রাখতে পারেন।
‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’, ‘রক্ত যখন দিয়েছি আরো দেব’, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালি’, ‘কেন এই স্বাধীন বাংলাদেশ’, ‘মুক্তিবাহিনীর দাবি’ ইত্যাদি বিষয়ের পোস্টারগুলো এখন সহজেই পাওয়া যাচ্ছে। এসব পোস্টার কিনে দেয়ালে ঝোলাতে পারেন। এগুলো হানাদারদের বিরুদ্ধে বাঙালিকে সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করেছিল আর এখন নতুন প্রজন্মকে সেই সময়কে জানতে আগ্রহী করবে।

সন্তানের হোমওয়ার্ক করার জন্য সাধারণ খাতার দরকার হয়। স্টেশনারি দোকানে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন চিত্র সংবলিত প্রচ্ছদের খাতা পাবেন। শিশুর জন্য এমন খাতা কিনে প্রচ্ছদের ছবিটির সঙ্গে তাকে পরিচিত করান। বুটিক হাউসগুলোতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ছবি, কবিতার পঙ্ক্তি ইত্যাদি নানা বিষয় সংবলিত টি-শার্ট পাবেন। এমন টি-শার্ট সারা বছরই পরতে পারেন।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ক্রিস্টালের রেপ্লিকা পাবেন গিফট শপে। এগুলো বিভিন্ন ভাস্কর্যের আদলে বানানো। ড্রয়িংরুম বা শোকেসে রাখতে পারেন। ‘বর্ণে বর্ণে মুক্তিযুদ্ধ’ শিশুর বর্ণমালা শেখার ভালো বই। এই বইটির মাধ্যমে শিশু একই সঙ্গে বর্ণমালা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে শিখতে পারবে। ফুলপরী আর রাক্ষস-খোক্ষসের গল্প না শুনিয়ে, আপনার সন্তানকে শোনান মুক্তিযুদ্ধের গল্প। সুযোগ পেলেই বেড়াতে নিয়ে যান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে এমন সব স্থানে। জানান সেসবের প্রকৃত ইতিহাস। দেখে, ছুঁয়ে আর শিখে তবেই না পরিপূর্ণ হবে আগামীর প্রজন্ম। তাদের মনে দেশপ্রেমের চারা আজ রোপণ করে দিন। একদিন তা-ই হয়ে উঠবে মহীরূহ। দেশমাতৃকার কোলে মাথা রেখে তারাও পাবে স্বাধীনতার ঘ্রাণ।

এইচএন/বিএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।