হঠাৎ সহিংসতা আমাদের কী শেখায়?

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:২৭ এএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫
ছবি: গুলিবিদ্ধ ওসমান হাদিকে ঢামেক থেকে এভারকেয়ারে নেওয়া হচ্ছে, ছবি: সংগৃহীত

সকালটা শুরু হয়েছিল অন্য সব দিনের মতোই। পরিকল্পনা ছিল, কাজ ছিল, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা ছিল। কিন্তু একটি মুহূর্ত, একটি শব্দ সবকিছু বদলে দিল। হঠাৎ সহিংসতা এমনই; এটি কোনো নোটিস দেয় না, সময় চায় না, প্রস্তুতির সুযোগ রাখে না। জীবনের স্বাভাবিক গতিপথে আচমকা আঘাত হেনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় এক অচেনা বাস্তবতার সামনে।

বলছি ১২ ডিসেম্বর দুপুরে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা। গুলিবিদ্ধ হয়ে হসপিটালে কাতরাচ্ছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানকেন্দ্রিক প্লাটফর্ম ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও আসন্ন নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদি। এই ধরনের ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবন আসলে কতটা অনিশ্চিত আর আমরা প্রতিদিন কতটা নিশ্চিত ভঙ্গিতে বেঁচে থাকি।

অনিশ্চয়তা আমরা মানতে চাই না

মানুষ হিসেবে আমরা নিরাপত্তা পছন্দ করি। রুটিন, পরিচিত পথ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সবকিছু মিলিয়ে একধরনের নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি তৈরি করি। কিন্তু হঠাৎ সহিংসতা সেই ভ্রান্ত নিরাপত্তাবোধ ভেঙে দেয়। বুঝিয়ে দেয়, আমাদের নিয়ন্ত্রণ আসলে খুব সীমিত। এই উপলব্ধি ভয়ংকর হলেও সত্য। কারণ আমরা যতই ভবিষ্যৎ সাজাই না কেন, একটি অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত সব হিসাব ওলটপালট করে দিতে পারে।

জীবন শুধু ‘আগামীকাল’ নয়, ‘এই মুহূর্ত’ও

সহিংস ঘটনার পর মানুষ প্রায়ই বলে, ‘কালকের কথা ভাবিনি।’ আসলে আমরা অনেক সময় বর্তমানকে অবহেলা করে ভবিষ্যতের জন্য বাঁচি। কাজ শেষে বিশ্রাম নেব, সময় হলে কথা বলব, পরে অনুভূতি প্রকাশ করব; এই ‘পরে’ শব্দটাই আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল। হঠাৎ সহিংসতা শেখায়, জীবনের নিশ্চয়তা নেই, কিন্তু বর্তমান আছে। আজ যাদের পাশে আছি, আজ যেসব অনুভূতি চাপা দিচ্ছি, সেগুলোর মূল্য এখনই দেওয়া দরকার।

সহিংসতা শুধু শরীরকে আঘাত করে না

সহিংসতা শুধু শরীরকে আঘাত করে না

সহিংসতার প্রভাব কেবল আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, এমনকি ঘটনাটি দূর থেকে দেখা মানুষদের মনেও ভয়, উদ্বেগ আর অসহায়ত্ব জন্ম নেয়। আমরা বুঝতে পারি, নিরাপত্তা আসলে ব্যক্তিগত নয়; এটি সামাজিক।

এই জায়গা থেকেই প্রশ্ন আসে আমরা কি ধীরে ধীরে সহিংসতাকে স্বাভাবিক করে নিচ্ছি? খবরের শিরোনাম বদলালেই কি আমরা ভুলে যাচ্ছি মানুষের জীবনে এর দীর্ঘ ছায়া?

সহমর্মিতা কোনো দুর্বলতা নয়

অনিশ্চিত জীবনে সবচেয়ে বড় শক্তি হতে পারে সহমর্মিতা। হঠাৎ সহিংসতার পর আমরা যদি শুধু মন্তব্য করি, বিশ্লেষণ করি, পক্ষ নেই; কিন্তু মানুষ হিসেবে পাশে না দাঁড়াই, তাহলে আমরা সমস্যারই অংশ হয়ে যাই।

কারও কষ্টের সময়ে নীরব থাকা, গুজব না ছড়ানো, অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন না করা-এগুলো ছোট কাজ মনে হলেও এগুলোই মানবিকতার ভিত্তি। সহমর্মিতা কাউকে দুর্বল করে না; বরং সমাজকে শক্ত করে।

 

এই ধরনের ঘটনা আমাদের জীবনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রেখে যায়। যেমন-

  • আমরা কি প্রতিদিন আমাদের প্রিয় মানুষদের যথেষ্ট সময় দিচ্ছি?
  • রাগ, হিংসা আর সহিংস ভাষাকে কি খুব সহজে মেনে নিচ্ছি?
  • অনলাইন বা অফলাইনে আমাদের আচরণ কি অন্যের নিরাপত্তা ও মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে?

জীবনের অনিশ্চয়তা শেখায়, শান্ত থাকা বিলাসিতা নয়; এটি প্রয়োজন। নিজের রাগ, ভাষা ও আচরণের দায় নেওয়াই পারে অনেক সহিংসতার জন্ম ঠেকাতে।

আরও পড়ুন: 

নিরাপত্তার বাইরে মানসিক প্রস্তুতি

আমরা সাধারণত নিরাপত্তা বলতে বুঝি শারীরিক সুরক্ষা। কিন্তু হঠাৎ সহিংসতা শেখায় মানসিক প্রস্তুতির কথাও। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কীভাবে নিজেকে স্থির রাখব, কীভাবে অন্যের পাশে দাঁড়াব-এই দক্ষতাগুলোও জীবনযাপনের অংশ হওয়া উচিত।

পরিবারে, শিক্ষায় ও সামাজিক আলোচনায় মানসিক স্বাস্থ্য ও সহিংসতা-বিরোধী সংস্কৃতিকে জায়গা দেওয়া জরুরি। কারণ অনিশ্চিত জীবনে মানসিক দৃঢ়তাই সবচেয়ে বড় ঢাল।

জীবন সত্যিই অনিশ্চিত। কিন্তু এই অনিশ্চয়তার মাঝেই আমাদের বেছে নিতে হয় ভয় না মানবিকতা, উদাসীনতা না সহমর্মিতা, সহিংসতা না শান্তির পথ। হঠাৎ সহিংসতা আমাদের শেখায়, জীবন খুব ভঙ্গুর। তাই একে আরও দায়িত্বশীল, আরও মানবিক করে তোলাই আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ। কারণ আমরা জানি না আগামী মুহূর্ত কী নিয়ে আসবে, কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা কেমন মানুষ হব সেই সিদ্ধান্তটা আমাদের হাতেই।

জেএস/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।