দুই দশক আগে ঢাকার কামরাঙ্গীরচর এলাকায় এক রিকশাচালকের চার বছর বয়সী মেয়েকে ধর্ষণ করেন প্রতিবেশী তরুণ। এই অভিযোগে ঘটনার দিনই কামরাঙ্গীরচর থানায় মামলা করেন শিশুটির বাবা। একদিন পর গ্রেফতার হন আসামি মো. ইকবাল হোসেন (১৮)।
Advertisement
ধর্ষণের শিকার শিশুটি আজ তরুণী। দুই দশক পেরিয়ে গেলেও আজও বিচার পাননি তিনি।
আসামি ইকবালের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার চর জগমোহনে। তিনি কামরাঙ্গীরচরে ভুক্তভোগী শিশুটির পরিবারের সঙ্গে একই বাড়িতে পাশাপাশি ঘরে ভাড়া থাকতেন।
আরও পড়ুনজিন তাড়ানোর কথা বলে কিশোরীকে ধর্ষণচেষ্টা, কবিরাজ আটক শ্যালিকাকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে দুই শিশু হত্যা, আসামির মৃত্যুদণ্ড ফরিদপুরে শিশু ধর্ষণের দায়ে যুবকের যাবজ্জীবন ৬ শিক্ষার্থীকে যৌন নির্যাতন: মাদরাসা শিক্ষকের আমৃত্যু কারাদণ্ড সিরাজগঞ্জে আমের লোভ দেখিয়ে ৬ বছরের শিশুকে ধর্ষণমামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, মামলার বাদী ও ধর্ষণের শিকার শিশুটির বাবা কামরাঙ্গীরচরে রিকশা চলাতেন। সেখানকার একটি টিনশেড বাসায় চার বছরের এক মেয়ে ও দেড় বছর বয়সী এক ছেলেকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন তিনি। ঘটনার দিন ২০০৫ সালের ১১ মে পাশের ঘরে থাকা প্রতিবেশী ইকবাল হোসেনের ঘর থেকে শিশুকণ্ঠের চিৎকার শুনতে পান তিনি। পরে গিয়ে দেখেন তার মেয়ে অর্ধনগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এবং তার প্যান্টে রক্তের দাগ।
Advertisement
এ সময় শিশুটি জানায়, ইকবাল তাকে (ভুক্তভোগী শিশু) ১০ টাকার নোট দেখিয়ে সেটা দেওয়ার কথা বলে ঘরে ডেকে নেয়। এরপর ধর্ষণ করে।
এরপর শিশুটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ঘটনার দিনই কামরাঙ্গীরচর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেন শিশুটির বাবা। মামলার পরের দিন আসামি ইকবালকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। শুরু হয় ধর্ষণের তদন্ত।
মামলা দায়েরের মাত্র ১৯ দিন পর ৩০ মে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। অভিযোগপত্রে মামলার এজাহারে বর্ণিত ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আরও পড়ুন কদমতলীতে ঘুমন্ত শিশুকে ধর্ষণ: আসামি মিন্টুর যাবজ্জীবন এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণ মামলায় সাক্ষ্য দিলেন বাদী আছিয়া ধর্ষণ-হত্যা: হিটু শেখের ডেথ রেফারেন্স নথি হাইকোর্টে বরিশালে ধর্ষণ মামলায় দুজনের যাবজ্জীবন রায়ে অসন্তুষ্ট আছিয়ার পরিবার, ন্যায়বিচার নিশ্চিত হোকএর মাত্র আড়াই মাস পর সে বছরের ১৩ আগস্ট অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু করেন আদালত। তবে বিচার শুরুর পরই বাধে বিপত্তি। অভিযোগ গঠনের ২৫ দিন পর অভিযুক্ত আসামি ইকবালের সঙ্গে আপসনামা করেন শিশুটির বাবা।
Advertisement
তবে নিয়ম অনুযায়ী শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। অভিযোগ গঠনের দেড় বছর পর ২০০৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম সাক্ষী দিতে আসেন মামলার বাদী ও ধর্ষণের শিকার শিশুটির বাবা। তবে সাক্ষীতে আসামির বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই বলে উল্লেখ করেন। আসামি ইকবাল হোসেন মামলায় খালাস পেলেও তার কোনো আপত্তি নেই মর্মে জবানবন্দি দেন তিনি। মামলার নথি থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় পরের বছর ২০০৮ সালের ২৩ নভেম্বর উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে কারামুক্ত হন আসামি ইকবাল হোসেন।
এরপর কেবলই পিছিয়েছে সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ। আদালতে আর দেখা মেলেনি নতুন কোনো সাক্ষীর। এ মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত ১৪ জন সাক্ষীর মধ্যে কেবল বাদীই সাক্ষ্য দিয়েছেন।
আরও পড়ুন কলেজছাত্রী ধর্ষণ মামলায় তিনজনের যাবজ্জীবন বনশ্রীতে শিশু গৃহকর্মীকে ধর্ষণের অভিযোগ, অভিযুক্ত গ্রেফতার ফরিদপুরে ধর্ষণের শিকার স্কুলছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার নড়াইলে শিশু ধর্ষণের পর হত্যায় যুবকের যাবজ্জীবন ফেসবুকে পরিচয়-প্রেম, ডেকে নিয়ে নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার ৩আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, একের পর এক সাক্ষীকে সমন ও গ্রেফতারি পরোয়ানা দিলেও আদালতে উপস্থিত হননি তারা।
বর্তমানে মামলাটি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪-এর বিচারক মুন্সী মো. মশিয়ার রহমানের আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য ছিল। তবে বরাবরের মতো সেদিন কোনো সাক্ষী না আসায় সাক্ষ্যগ্রহণ পেছান আদালত। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য এ বছরের ১৮ আগস্ট দিন ধার্য রয়েছে। এদিন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ধর্ষণের পর শিশুর চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকের প্রতি সমন রয়েছে।
এ নিয়ে সাক্ষ্য শুরুর পর পার হয়ে গেছে দেড় যুগেরও বেশি সময়। তবু একজনের বেশি সাক্ষীর দেখা মেলেনি আদালতে, হয়নি বিচার। নিজ বাবার আপসনামার ফলে ধর্ষণের শিকার হওয়ার দুই দশক পরও বিচার থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেছে সেই ‘শিশুটি’।
এ নিয়ে আদালতের এক আদেশনামায় বলা হয়েছে, ‘অভিযোগ গঠনের পর থেকে মাত্র একজন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন। সাক্ষীদের সমন বা গ্রেফতারি পরোয়ানা দিতে সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেয়া হয়। সমন ও গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও গাফিলতি গণ্যে তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বরাবর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া যেতে পারে।’ তবে এসবেও মেলেনি সাক্ষী, আলোর মুখ দেখেনি বিচার।
আরও পড়ুন চকলেটের লোভ দেখিয়ে শিশু ধর্ষণ: যুবকের ১০ বছরের কারাদণ্ড কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা, যশোরে যুবকের যাবজ্জীবন শিশু ধর্ষণ: র্যাবের অভিযানে অভিযুক্ত রমজান গ্রেফতার মোহাম্মদপুরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, সেনা অভিযানে গ্রেফতার ৪ প্রেমিকাকে দলবেঁধে ধর্ষণ: প্রেমিকসহ পাঁচজনের যাবজ্জীবনদুই দশক আগের এ মামলার নথিতে বাদী ও ধর্ষণের শিকার শিশুটির বাবার মুঠোফোন নম্বর সংযুক্ত না থাকায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
সাক্ষী খরার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর এরশাদ আলম জর্জ জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আমরা দ্রুতই সাক্ষীদের উপস্থিত করার চেষ্টা করবো। সাক্ষীদের উপস্থিত করার স্বার্থে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হবে।’
মামলাটি নিষ্পত্তি প্রসঙ্গে পাবলিক প্রসিকিউটর বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে ঝুলে থাকা মামলাগুলো নিষ্পত্তির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যা করণীয় তা করছি। সাক্ষী হাজির করার জন্য নিয়মিত সময় দেওয়া হচ্ছে।’
যোগাযোগ করা হলে আসামিপক্ষের আইনজীবী কাজী আব্দুস সালিম বলেন, ‘ধর্ষণের মামলা আপসযোগ্য নয়। ফলে দীর্ঘ দুই দশক ধরে সাক্ষী না আসার পরও মামলাটি চলছে। কিন্তু এতদিনও কেন রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে সাক্ষী হাজির করতে পারলো না, এটা তাদের ব্যর্থতা। মামলার বিচার শেষে আসামি দোষী হলে সাজা পাবে, নির্দোষ হলে খালাস পাবে। কিন্তু এতদিন ধরে মামলা ঝুলিয়ে রাখা তো এক ধরনের অবিচার।’
এমআইএন/এমএমএআর/জেআইএম