আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন কারাগার ভেঙে ও পুড়িয়ে প্রায় দুই হাজার ২০০ বন্দি আসামি পালিয়ে যায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কঠিন সময়ে কারাগারের হাল ধরেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন। ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি।
Advertisement
সেনাবাহিনীর এই চৌকশ কর্মকর্তা দায়িত্ব গ্রহণের পর কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসন্তোষ থেকে শুরু করে অনেক কঠিন পরিস্থিতি সামাল দেন। ধীরে ধীরে গ্রেফতার ও আত্মসমর্পণ হতে থাকে পালিয়ে যাওয়া আসামি। অন্যদিকে কারাগারগুলোতে সংস্কারের কাজ চলতে থাকে। বর্তমানে দেশের সব কটি কারাগার সচল রয়েছে এবং কারাগারের সমস্যাগুলোর সমাধানে তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন ১৯৯৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর ৩১তম বিএমএ লং কোর্সে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পদাতিক কোরে কমিশন লাভ করেন। অসামান্য পেশাদারত্ব ও দক্ষতার সঙ্গে তিনি বিভিন্ন কমান্ড, স্টাফ ও ইন্সট্রাকশনাল অ্যাপয়েন্টমেন্টে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (বিএমএ), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশনস ট্রেনিং (বিপসট) এবং স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সেও (এসএসএফ) সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একজন ক্রীড়াপ্রেমী এবং কৃতী গলফার। কারা মহাপরিদর্শক হিসেবে যোগদানের আগে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোতাহের বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) মহাপরিচালক হিসেবে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
কারাগারের বিভিন্ন সংকট, কারাগারের ভেতর শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মোবাইলে কথা বলা, ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের সুবিধা দেওয়ার গুঞ্জন, কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অ্যাকশন, কারাগারে মাদক, বন্দিদের ভার্চুয়ালি হাজিরাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোতাহের হোসেন। বিশেষ এ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক তৌহিদুজ্জামান তন্ময়। তিন পর্বের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।
Advertisement
জাগো নিউজ: কারাগারে মাদকের ছড়াছড়ি। ঠেকানো যাচ্ছে না কেন?
কারা মহাপরিদর্শক: কারাগারে মাদক একটি বড় সমস্যা। এজন্য মাদকাসক্ত আসামিদের পৃথক কারাগারে পাঠানোর চিন্তা রয়েছে। বন্দিদের জন্য পৃথক পৃথক ওয়ার্ড রয়েছে। কিন্তু ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দি থাকায় মেইনটেইন করা যাচ্ছে না। এছাড়া কারাগারে মাদকের সাপ্লাই রুট বন্ধের কাজ চলমান। কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে এটি হয়। যখন একজন বন্দি কারাগারে আসে তার এন্ট্রি থেকেই নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে; যাতে মাদক নিয়ে কেউ কারাগারে প্রবেশ করতে না পারে।
আবার যখন একজন বন্দি কারাগার থেকে আদালতে হাজিরা দিতে যাচ্ছে, সেখান থেকে মাদক বহন করে আনে অনেক বন্দি। ইদানীং দেখা যাচ্ছে পেটের মধ্যে মাদক নিয়ে কারাগারে আসছে বন্দিরা। এমন অনেক বন্দির কাছ থেকে মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। এজন্য বডি স্ক্যানার ও লাগেজ স্ক্যানার সক্রিয় করা হয়েছে, যাতে পেটের মধ্যে মাদক থাকলেও তা শনাক্ত করা যাচ্ছে। বন্দিরা আদালতে গেলে সেখান থেকে মাদক ঢোকার বড় রুট আমাদের কাছে ডিটেক্ট হয়েছে। এ কারণে সরকারের কাছে আবেদন করেছি মাদকাসক্তদের আদালতে না নিয়ে কারাগারে বসে ভার্চুয়ালি হাজিরা দেওয়ার ব্যবস্থা করার। সরকার এ সিদ্ধান্তে একমত হয়েছে। শিগগির এটি বাস্তবায়ন হবে। এতে প্রিজনভ্যানে অথবা গারদে থাকা অবস্থায় মাদকের সাপ্লাই আর পাবে না। এছাড়া ভবিষ্যতে প্রশিক্ষিত ডগ স্কোয়াড দিয়ে তল্লাশি চালাবো।
দুটি ডকুমেন্ট্রি তৈরি চলছে। একজন মানুষ যখন কারাগারে আসবে, তখন তিনি কারাগারে কি কি কাজ করতে পারবেন আর কি কি কাজ করতে পারবেন না, এসব বিষয় ডকুমেন্ট্রিতে থাকবে। আরেকটি ডকুমেন্ট্রি তৈরি করা হচ্ছে বন্দিদের আত্মীয়-স্বজনের জন্য। তারা তাদের বন্দির সঙ্গে কীভাবে সাক্ষাৎ করতে পারবেন, কীভাবে টেলিফোনে কথা বলতে পারবেন; এসব বিষয় থাকবে।
Advertisement
জাগো নিউজ: কারাগারে বসে ভার্চুয়ালি হাজিরা কতদূর?
কারা মহাপরিদর্শক: দেশের ৭০টি কারাগার একে অপরের সঙ্গে ফাইবার অপটিক ক্যাবল নেটওয়ার্ক দিয়ে কানেকটিভ। আদালতের সঙ্গে সমন্বয় করার চেষ্টা করছি। কয়েকজন সেনসেটিভ বন্দিকে ভার্চুয়ালি আদালতে হাজির করা হয়েছে। আসামিদের কারাগার থেকে আদালত পর্যন্ত পুলিশের গাড়িতে পরিবহন করে। এই জায়গায় কারাগারের সরাসরি কন্ট্রোল নেই। যে কারণে দুর্বলতা আছে। এ কারণে বন্দিদের পরিবহনের সময় মনিটরিংয়ের আওতায় আনার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বন্দিদের সঙ্গে মনিটরিং ডিভাইস দেওয়া হবে, কারারক্ষীদের বডিক্যাম দেওয়া হবে। এছাড়া আরএফআইডি রিস্টব্যান্ড প্রদানেরও পরিকল্পনা রয়েছে।
আরও পড়ুনকারাগারে মশার কামড়ে ঘুম হচ্ছে না, খুব কষ্টে আছি কারাগারে ঈদ উদযাপনে গরু ও খাসি কোরবানি নেত্রকোনায় রাতভর বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন কারাগার কাশিমপুর কারাগারে অসুস্থ কয়েদির ঢামেকে মৃত্যুজাগো নিউজ: কারাগারে জামিন বাণিজ্য এখনো হচ্ছে?
কারা মহাপরিদর্শক: আসামি আদালত থেকে জামিন পেলেও কারাগার থেকে জামিন বাণিজ্যের অভিযোগ ছিল। তবে বর্তমানে আমরা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দিয়েছি। আদালত থেকে বন্দির জামিনের পর কাগজপত্র পৌঁছানোমাত্র কারা কর্তৃপক্ষ কারামুক্ত দেয়। জামিন পেলেও কোনো বন্দিকে বেশি সময় আটকে জামিন বাণিজ্যের সুযোগ নেই। কারাগারগুলোর সামনে ডিজিটাল বোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই ডিসপ্লেতে বন্দি কখন কারামুক্ত হবেন তা দেখা যায়। নিয়ম অনুসারে বিকেল ৪টার আগে কাগজ কারাগারে এলে ৪টার আগেই কারামুক্তি। আর ৪টার পর কাগজ এলে পরদিন মুক্তি দেওয়া হয়। বন্দি জামিনে মুক্তির বিষয়ে দালাল ধরার কোনো কারণ নেই।
জাগো নিউজ: কারাগারকে বলা হয় সংশোধনাগার। কতটা সংশোধন হন বন্দিরা?
কারা মহাপরিদর্শক: আগে প্রচলিত ছিল বন্দিদের অত্যাচার করে সংশোধন করা। কিন্তু বর্তমানে সেই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। এজন্য সংশোধনমূলক কার্যক্রম গতিশীল করতে চাই। কারাগারের মোটোতেও একই কথা বলা হয়েছে- ‘রাখিব নিরাপদ দেখাবো আলোর পথ।’ ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার কারাগারের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন নাম হবে ‘কারেকশন সার্ভিস বাংলাদেশ’। যাতে একজন বন্দি কারাগার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে জামিন পেয়ে পরিবার তথা সমাজকে সাপোর্ট দিতে পারে।
আরও পড়ুনকাশিমপুর কারাগার থেকে পালানো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি গ্রেফতার কারাবন্দিদের স্বজনদেরও আপ্যায়ন করছে কারা কর্তৃপক্ষ বাইরের চেয়ে ভেতরেই ভালো আছি: শাজাহান খান পরিবার থেকে আসা খাবার তল্লাশি শেষে খেতে পারছেন কারাবন্দিরাজাগো নিউজ: কারাগারে ধারণক্ষমতা কত, আর বন্দির সংখ্যা বর্তমানে কত?
কারা মহাপরিদর্শক: দেশের কারাগারে ৪২ হাজারের মতো ধারণক্ষমতা রয়েছে। কারাগারগুলোতে ৭৫ হাজারের বেশি বন্দি। বেশি বন্দি থাকায় ব্যবস্থাপনায় চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যাও বর্তমানে অনেক বেশি। বর্তমানে দেশের ২৩টি কারাগারে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা ১৫৩ জন। এই চাপ কমাতে সারাদেশে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের জন্য কেরানীগঞ্জে পৃথক কারাগার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে অন্য কারাগারে চাপ কমে আসবে।
জাগো নিউজ: গুঞ্জন আছে ডিভিশনপ্রাপ্ত ভিআইপি বন্দিরা বাসার খাবার খাচ্ছেন এবং অন্যান্য সুযোগ পাচ্ছেন।
কারা মহাপরিদর্শক: কারাগারের কাজ বন্দিদের নিরাপদ রাখা এবং সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী পালন করা। কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কারও প্রতি পক্ষপাত করছেন না। পত্রিকায় দেখতে পাবেন ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি কোনো অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। জেল সুপারদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে এবং আমি প্রতিনিয়ত মনিটর করছি। নিয়মের মধ্যে থেকে একজন ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দির যতটুকু সুবিধা পাওয়ার কথা, ঠিক ততটুকুই পাচ্ছেন। এছাড়া কারাগারে বাইরের খাবার কোনো বন্দির জন্য অ্যালাউ করা হয় না। কারণ নিরাপত্তার ইস্যু রয়েছে। এছাড়া ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের অনেকের থ্রেটও (হুমকি) রয়েছে। এটি আমরা ইগনোর করছি না। তাদের নিরাপত্তার জন্য কিছু আইসোলেশন করতে হচ্ছে। (চলবে...)
আগামীকাল থাকছে সাক্ষাৎকারের শেষ পর্ব: মোবাইলে কথা বলা ঠেকাতে জ্যামার বসছে কারাগারে।
টিটি/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম