করোনার জন্য বাদুড় আসলে কতটা দায়ী?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:৪৭ পিএম, ২২ জুন ২০২০

বাদুড়ের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ইরোরো তানশি। ওরা এক অসাধারণ সৃষ্টি বলেন তিনি। বাদুড়ের প্রসঙ্গ উঠলে তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস টেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেটের জন্য কাজ করছেন নাইজেরিয়ান বিজ্ঞানী তানশি।

তার মতো আরো বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী আছেন, যাদের প্রয়াসের লক্ষ্য বাদুড়ের নেতিবাচক ইমেজ দূর করা। বিশেষ করে এই সময়টায়; করোনাভাইরাস মহামারি ছড়ানোর পেছনে বাঁদুড়ের একটা ভূমিকা আছে; এরকম কথাবার্তা বাদুড়ের ইমেজ আরো বেশি খারাপ করে দিয়েছে ।

অস্ট্রেলিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত নানা জায়গায় গণহারে বাদুড় হত্যা এবং তাড়ানোর খবর পাওয়া গেছে। সংরক্ষণবাদীরা বিচলিত হয়ে পড়েছেন এসব খবরে। কিন্তু বাদুড়কে এ মহামারির জন্য দোষ দেয়ার ফলে যা হচ্ছে তা হলো– আসল যে অপরাধী সে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে।

কোভিড-১৯ মহামারির জন্য বাঁদুড়কে দায়ী করা হচ্ছে কেন? ড. ওয়েবালা বলছেন, বিবর্তনের দিক থেকে বলতে গেলে, মানুষ ও বাঁদুড়ের মধ্যে পার্থক্য অনেক। কাজেই সার্স-কোভ-টু ভাইরাস যদি বাদুড় থেকেই এসে থাকে– তাহলেও তাকে সম্ভবত মাঝখানে অন্য আরেকটা প্রাণী বা ‘হোস্ট’র মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল।

তার অর্থ হলো বাদুড়ই যদি ভাইরাসের উৎস হয়ে থাকে– তারপরও তারা সরাসরি মানুষের মধ্যে এটা ছড়ায়নি। অনেকে সন্দেহ করেন, মানুষ ও বাদুড় এই দুইয়ের মাঝখানে ছিল আরেকটি প্রাণী– সম্ভবত প্যাংগোলিন, বাংলায় যাকে বলে বনরুই।

তাহলে দোষ কার?

তানশি এবং তার সহযোগী বৈজ্ঞানিকেরা জোর দিয়ে বলেন, তারা একমত যে এই করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব এবং মানব জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ার জন্য মানুষই দায়ী। ড. ওয়েবালা বলছেন, মানুষের কর্মকাণ্ড এই মহামারির বিস্তারের জন্য আদর্শ পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

বন্যপ্রাণীর আবাসভূমিতে মানুষের অনুপ্রবেশ, আবাসস্থল ধ্বংস বা বিনষ্ট হওয়া, মানুষ কর্তৃক বন্যপ্রাণীর ব্যবসা, এক জায়গায় আটকে রাখা, ভিন্ন ভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া, এ ধরনের কাজ অন্য প্রজাতির মধ্যে রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার আদর্শ পরিস্থিতি তৈরি করে। এবং এটা ঘটছে এমন সব প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে- যারা আগে কখনো একে অপরের সংস্পর্শে আসেনি।

একাধিক দিক থেকে অনুসন্ধান করে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে প্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস করা হলে ‘জুনটিক’ রোগ বিস্তার অর্থাৎ প্রাণীর দেহে সৃষ্ট রোগ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়– বলছেন তানশি।কাজেই বাদুড় হত্যা আমাদের করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা করতে পারবে না। বরং উল্টোটাই হতে পারে।

গণহারে তাদের হত্যা এবং আবাসস্থল থেকে তাদের উচ্ছেদ করার ফলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে– এ কথাই বলছেন সংরক্ষণবিদরা। সারা পৃথিবীতে ১৪ হাজারেরও বেশি বাঁদুড়ের প্রজাতি আছে, যার মধ্যে ৭০ শতাংশই কীটপতঙ্গ-পোকামাকড় খেয়ে বাঁচে।

বাদুড় যে সমস্ত পোকামাকড় খায় সেগুলোর এক বড় অংশই উড়তে পারে এবং নিশাচর। এগুলো অনেক রকম রোগসৃষ্টিকারী অণুজীব বহন করে যা মানুষকে সংক্রমিত করে। যেমন ডেঙ্গু জ্বর এবং ম্যালেরিয়া।কাজেই বাঁদুড়কে আক্রমণ করলে তা হয়তো অন্য নানা রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়িয়ে দেবে।

বাদুড় কীভাবে মানুষের উপকার করে?

ড. ওয়েবালা বলেন, আপনি যদি আজ তুলো থেকে তৈরি অর্থাৎ সূতী কাপড় পরে আছেন, চা বা কফি পান করেছেন, শস্য থেকে তৈরি খাবার খেয়েছেন, খামারে উৎপন্ন অনেক খাবারের একটি খেয়েছেন– তাহলে আপনার দিনটির সাথে ইতোমধ্যেই বাদুড়ের একটা সংযোগ ঘটে গেছে।

প্রকৃতি, প্রাণী ও উদ্ভিদ মিলিয়ে আমাদের চারপাশের যে ইকোসিস্টেম- তাতে বাদুড় পরাগায়ন, বীজ ছড়ানো এবং পোকামাকড় ধ্বংসের ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করে। তাই খাদ্য থেকে শুরু করে প্রসাধন সামগ্রী, আসবাবপত্র এবং ওষুধ– সবকিছুতেই বাঁদুড়ের শ্রম আছে।

তিনি বলেন, বাদুড় ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার বনাঞ্চল টিকে থাকতে পারতো না। মাদাগাস্কারের বাওবাব গাছ অদৃশ্য হয়ে যেতো, ম্যাকাডামিয়ার আবাদ বিপর্যয়ের মুখে পড়তো। পাখির মাধ্যমে যত বীজ ছড়ায়– বাদুড়ের মাধ্যমে ছড়ায় তার দ্বিগুণ। এর ফলে উষ্ণমন্ডলীয় এলাকায় বিচ্ছিন্ন নানা বনভূমিতে গাছের বংশবৃদ্ধি এবং জিনের প্রবাহ সম্ভব হচ্ছে।

একাধিক জরিপে দেখা দেখা গেছে, শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বাদুড়ের কারণে শস্য বিনষ্ট হওয়া কমে যাচ্ছে এবং কৃষকদের শত শত কোটি ডলারের খরচ বেঁচে যাচ্ছে। যা তাদের কীটনাশকের পেছনে খরচ করতে হতো।

বাদুড় কেন এক অনন্য প্রাণী?

প্রকৃতি জগতে টিকে থাকার দিক থেকে বাঁদুড় এক বিস্ময়কর রকমের সফল প্রাণী। এ্যান্টার্কটিকা ছাড়া আর সকল মহাদেশেই বাদুড় পাওয়া যায়।

তানশি বলছেন, একজন বাদুড় গবেষক হিসেবে আমি বহু গুহা, জঙ্গল, পাহাড় পর্বত এবং তৃণভূমি অনুসন্ধান করেছি। দেখেছি, বাদুড় প্রকৃতির সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য চমৎকারভাবে বিবর্তিত হয়েছে।

তিনি বলেন, বাদুড়ের ক্ষেত্রে আঙুল পরিণত হয়েছে পাখায়। তারা প্রতিধ্বনিকে ব্যবহার করে অবস্থান নির্ণয় করে পথ চলতে পারে। তাদের দৃষ্টিশক্তি দারুণ। এগুলো দিয়ে বাদুড় রাতের আকাশে তাদের উপনিবেশ কায়েম করতে পেরেছে। স্তন্যপায়ী প্রাণী হওয়াকে যদি একটা আর্ট বলা হয়, তাহলে বাদুড়কে বলতে হবে মাস্টারপিস অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ শিল্পীর কাজ।

ড. ওয়েবালাও বাদুড়ের ব্যাপারে একই রকম উৎসাহী এবং তিনি তাদের সংরক্ষণের পক্ষে কিছু বাস্তব যুক্তি তুলে ধরছেন। আমরা এখন ধীরে ধীরে জানতে পারছি যে বাদুড়ের দেহে হয়তো খুবই উন্নত রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা আছে যা রোগ এবং রোগ-সৃষ্টিকারী অণুজীবকে সহ্য করতে পারে।

তিনি বলছেন, মানুষের ভাইরাস প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর নতুন কোন চিকিৎসাপদ্ধতির আবিষ্কারের ক্ষেত্রে হয়তো বাদুড়ের এই প্রতিরোধী শক্তির রহস্য কাজে লাগতে পারে। বিবিসি বাংলা।

এসআইএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।