নতুন বৈশিষ্ট্যের ভাইরাসের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন কাজ করবে?
যুক্তরাজ্যে নতুন বৈশিষ্ট্যের করোনাভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ার পর থেকেই নতুন করে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশটির লাখ লাখ মানুষের জন্য চতুর্থ স্তরের বা সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিধিনিষেধ আরোপের জন্য দায়ী করা হচ্ছে ভাইরাসের এই নতুন প্রজাতিকে। এই বৈশিষ্ট্যের ভাইরাস পুরোনো বৈশিষ্ট্যের ভাইরাসের চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখে।
ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং ওয়েলসে বড়দিনের উৎসবে মানুষের মেলামেশায় কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ এবং যুক্তরাজ্যের সঙ্গে অন্য দেশগুলোর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও আসার পেছনেও দায়ী নতুন প্রজাতির ভাইরামের দ্রুত সংক্রমণ।
কিন্তু মাত্র কয়েক মাস আগেও ইংল্যান্ডে এই নতুন প্রজাতির ভাইরাসের কোন অস্তিত্ব ছিল না। মাত্র অল্পদিনেই এই ভাইরাস কিভাবে এতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে তাই এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্রিটিশ সরকারের সংক্রমণ বিষয়ক উপদেষ্টারাও মোটামুটি নিশ্চিত যে, এটা করোনাভাইরাসের অন্য প্রজাতির তুলনায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সব কাজই এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এখনও অনেক অনিশ্চয়তা এবং অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানাই রয়ে গেছে।
ভাইরাসের নতুন এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে কেন উদ্বেগ ছড়াচ্ছে?
বেশ কিছু কারণে করোনাভাইরাসের নতুন এই প্রজাতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। মূলত এটি ভাইরাসের অন্য সংস্করণগুলোকে প্রতিস্থাপিত করছে।
এর বিভাজন বা রূপান্তর ভাইরাসের কিছু অংশে পরিবর্তন আনে, যা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিভাজনের মধ্যে বেশ কিছু ল্যাবে পরীক্ষার পর দেখা গেছে যে, এগুলো মানুষের দেহের কোষকে সংক্রমিত করার ভাইরাসের যে সক্ষমতা তা বাড়িয়ে দেয়। এসব বৈশিষ্ট্য ভাইরাসটিকে সহজে ছড়িয়ে পড়ার সক্ষমতা দেয়।
তবে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা এখনও সম্পূর্ণ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না। তবে নতুন স্ট্রেইনটি উপযুক্ত পরিবেশ পেলে দ্রুত হারে ছড়িয়ে পড়তে পারে- যেমন লন্ডন। সেখানে এর আগ পর্যন্ত দ্বিতীয় স্তরের বিধি-নিষেধ ছিল।
যুক্তরাজ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ কমিয়ে আনতে এর মধ্যেই চতুর্থ পর্যায়ের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। দেশটির কোভিড-১৯ জেনোমিক্স কনসোর্টিয়ামের অধ্যাপক নিক লোমান বলেন, ‘ল্যাবরেটরিতে এ নিয়ে পরীক্ষার দরকার আছে। কিন্তু এর জন্য কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে অপেক্ষা করার সময় সম্ভবত এখন নেই।’
এই ভাইরাস কত দ্রুত ছড়ায়?
সেপ্টেম্বরে প্রথম ভাইরাসের এই নতুন ধরণটি শনাক্ত করা হয়। নভেম্বরের দিকে লন্ডনে আক্রান্তদের মধ্যে চার ভাগের এক ভাগ ছিল নতুন বৈশিষ্ট্যের এই ভাইরাসের শিকার। আর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এটি দুই-তৃতীয়াংশে পৌঁছায়।
প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলছেন, ‘এই বৈশিষ্ট্যের ভাইরাসটি ৭০ শতাংশ বেশি ছড়িয়ে পড়ে। শুক্রবার লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের ডা. এরিক ভলজ বলেন, ‘এটা এখনই বলা খুব কঠিন... কিন্তু এখনও পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে, সেটি হচ্ছে যে এটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ভাইরাসটির অন্য যে কোন বৈশিষ্ট্যের তুলনায় এটি ছড়িয়ে পড়ছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এর উপর নজর রাখতে হবে।’
তবে নতুন বৈশিষ্ট্যের এই ভাইরাসটি কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তার কোন নির্দিষ্ট হিসেব নেই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এটি ছড়িয়ে পড়ার হার ৭০ শতাংশের কম বা বেশি হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে যে, এটি আরও বেশি সংক্রামক কীনা?
ইউনিভার্সিটি অব নটিংহ্যামের ভাইরোলজিস্টের অধ্যাপক জোনাথন বলেন, এখন পর্যন্ত যে তথ্য জানা গেছে সেগুলো পর্যাপ্ত নয় এবং এগুলো অনুযায়ী কোন দৃঢ় মতে পৌঁছানোও সম্ভব নয় যে ভাইরাসটি আসলেই বিশালভাবে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে কীনা।
কত দূর ছড়িয়ে পড়েছে নতুন এই ভাইরাস?
ধারণা করা হচ্ছে যে ভাইরাসের এই নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্তরাজ্যেই কোন একজন রোগীর দেহে আর্বিভূত হয়েছে কিংবা এমন একটি দেশ থেকে এসেছে যেখানে ভাইরাসটিকে পর্যবেক্ষণ করার মতো তেমন কোন ব্যবস্থা নেই।
উত্তর আয়ারল্যান্ড ছাড়া যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় এই ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এটি মূলত রাজধানী লন্ডন এবং দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব ইংল্যান্ডেই সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। অন্য এলাকাগুলোতে খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছে না।
ভাইরাসটির জেনেটিক কোড নিয়ে কাজ করা নেক্সটস্ট্রেইন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, ডেনমার্ক এবং অস্ট্রেলিয়াতে যে ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেছে তা যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে। নেদারল্যান্ডসেও নতুন বৈশিষ্ট্যের করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে যে ভাইরাসটি প্রথম শনাক্ত করা হয়েছিল তার সাথে বিশ্বের অন্যান্য স্থানে থাকা ভাইরাসের কোনো মিল নেই।
ডি৬১৪জি নামে ভাইরাসটি গত ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপে ধরা পরে এবং এটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের।
এ২২২ভি নামে আরেকটি নতুন বৈশিষ্ট্যের ভাইরাসও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্পেনে গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় এটি বেশি ছড়িয়ে পড়ে।ভাইরাসটির নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রাথমিক একটি বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে এবং এতে ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে বলে জানা গেছে।
নতুন বৈশিষ্ট্যের ভাইরাসটির ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন কাজ করবে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন এসেছে। এটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর মাধ্যমেই ভাইরাসটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।
এন৫০১ওয়াই নামে চিহ্নিত একটি পরিবর্তনে স্পাইকের ওই জায়গায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর এসেছে যা ‘রিসেপ্টর-বাইন্ডিং ডোমেইন’ নামে পরিচিত। এর মাধ্যমেই ভাইরাসের স্পাইক মানুষের ত্বকের সঙ্গে প্রথম সংযোগ ঘটায়। যে কোনো ধরণের পরিবর্তন, যা এই ভাইরাসটিকে শরীরে সহজে প্রবেশ করতে সহায়তা করে তা ভাইরাসটির জন্য সুবিধাজনক হতে পারে।
এটাকে আপাত গুরুত্বপূর্ণ অভিযোজন মনে হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক লোমান। অন্য পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে ভাইরাসের এইচ৬৯/ভি৭০ অংশটি বাদ পড়া। এই প্রক্রিয়ায় স্পাইকের একটি ছোট অংশ বাদ পড়ে। তবে এটি এর আগেও অনেকবার হয়েছে। বিশেষ করে মিংক নামে প্রাণীদের দেহে সংক্রমণের ক্ষেত্রে।
ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের অধ্যাপক রাভি গুপ্তার গবেষণায় তিনি বলেছেন যে, ল্যাব পরীক্ষার ফলাফল বলছে এই পরিবর্তন সংক্রমণের হার দুই গুণ বাড়িয়ে দেয়। এই দলের আরেকটি গবেষণা বলছে, এই পরিবর্তনের কারণে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হওয়ার পর যারা সেরে ওঠেন তাদের রক্তে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তার ভাইরাসটিকে আক্রমণ করার ক্ষমতা কমে যায়।
অধ্যাপক গুপ্তা বলেন, ‘এটা ব্যাপক হারে বাড়ছে। যা সরকারকে চিন্তিত করছে, আমাদের চিন্তিত করছে, বেশিরভাগ বিজ্ঞানীদের চিন্তিত করছে।’
এই বৈশিষ্ট্যের ভাইরাসটি অত্যন্ত পরিবর্তনশীল। এর সবচেয়ে ভাল ব্যাখ্যাটি হচ্ছে, ভাইরাসটি এমন কোন রোগীর দেহে তৈরি হয়েছে, যার রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসটির বিরুদ্ধে একদমই প্রতিরোধ গড়তে পারেনি।
এর পরিবর্তে ওই রোগীর দেহ ভাইরাসটির পরিবর্তনের উর্বরক্ষেত্র হিসেবে কাজ করেছে। তবে এখনও পর্যন্ত এমন কোন প্রমাণ মেলেনি যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এটি সংক্রমণকে আরও বেশি প্রাণঘাতী বা মারাত্মক করে। তবে এটি পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
এখন পর্যন্ত যে তিনটি ভ্যাকসিন এসেছে তাদের সবগুলোই বর্তমানে থাকা ভাইরাসটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আর এ কারণেই এই প্রশ্নটি সামনে এসেছে যে, নতুন প্রজাতির ভাইরাসের ক্ষেত্রেও এসব ভ্যাকসিন কার্যকর হবে কীনা।
অধ্যাপক গুপ্তা বলেন, ‘ভ্যাকসিন রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ভাইরাসের বিভিন্ন অংশকে আক্রমণ করতে উদ্দীপ্ত করে। আর তাই এর কিছু অংশ যদি পরিবর্তিত হয়েও থাকে, তারপরও ভ্যাকসিনের ভাইরাসটির বিরুদ্ধে কাজ করার কথা। কিন্তু যদি আরও বেশি পরিবর্তন বা বিভাজন ঘটতে দেয়া হয়, তাহলে তখন দুঃশ্চিন্তা করতেই হবে।’
তিনি বলেন, ‘ভাইরাসটি এমন একটি পথে রয়েছে যেখানে হয়তো সে ভ্যাকসিন এড়িয়ে যেতে পারে। আর সেদিকেই কয়েক কদম এগিয়েছে ভাইরাসটি।’ ভ্যাকসিন এড়ানোর মানে হচ্ছে, ভাইরাসটি পরিবর্তিত হচ্ছে। যার কারণে ভ্যাকসিন পুরোপুরি কার্যকর হয় না এবং ভাইরাসটি তখন মানুষকে সংক্রমিত করা অব্যাহত রাখে।
আর এখন ভাইরাসটি যে অবস্থায় আছে তাতে এই বিষয়টিই সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হয়ে দেখা দিয়েছে। ভাইরাসটির নতুন বৈশিষ্ট্য এটা জানান দিচ্ছে যে, এটি যতই মানুষকে আক্রান্ত করছে, ততই খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগোর অধ্যাপক ডেভিড রবার্টসন শুক্রবার এক উপস্থাপনায় বলেন, এই ভাইরাসটি সম্ভবত নিজেকে এমনভাবে পরিবর্তন করবে, যাতে সে ভ্যাকসিন এড়াতে পারে।
তার মতে, এটা আমাদেরকে অনেকটা ফ্লু’র বিরুদ্ধে যুদ্ধের জায়গায় নিয়ে যাবে। অর্থাৎ নিয়মিতভাবে ভ্যাকসিনের পরিবর্তন ঘটাতে হবে।তবে সৌভাগ্যবশত বর্তমানে যেসব ভ্যাকসিন রয়েছে, সেগুলোতে সহজেই পরিবর্তন আনা সম্ভব।
টিটিএন/জেআইএম