বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস
ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ের পথে বাংলাদেশ
ডা. ইমরান আহমেদ চৌধুরী ও সিমিন ইবনাত ধরিত্রী
ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা আবিষ্কার হয়েছে ১০০ বছর আগে। কিন্তু এত বছর পরেও ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগ (এনসিডি) এখনো বিশ্বের প্রধান প্রাণঘাতী রোগ হিসেবে বিবেচ্য।
এসব রোগের মধ্যে রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, হৃদরোগ ও ক্যানসার। বর্তমানে বিশ্বের মোট মৃত্যুর ৭৫ শতাংশের জন্যই দায়ী এসব অসংক্রামক রোগ। এর কারণে প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ অকালে প্রাণ হারান। তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশের মানুষ।
অসংক্রামক রোগের প্রভাব শুধু শারীরিক নয়, এটি মানুষরে জীবনযাত্রা, পরিবার ও সমাজের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে অনেকে হয়ে পড়েন র্সবস্বান্ত।
উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস এমন রোগ, যার জন্য আজীবন ওষুধ খেতে হয়। পাশাপাশি প্রয়োজন হয় নিয়মিত হাসপাতালে চিকিৎসার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাস্থ্যখাতে নিজের খরচ নিজেকেই বহন করতে হয় - বিশ্বের এমন দেশের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। ফলে দেখা যায়, দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসার খরচ রোগী বা তার পরিবারকেই বহন করতে হয়।
চিকিৎসার খরচ হিসাব করে দেখা যায়, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ৬১ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছে। ব্র্যাকের মাঠকর্মীদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, শহরে বস্তিতে অনেক পরিবার তাদের আয়ের অধিক ব্যয় করছে চিকিৎসায়।
একটি নতুন উদ্যোগ বদলে দিচ্ছে চিত্র
বাংলাদেশে সরকার, ব্র্যাক এবং বিশ্বের অন্যতম স্বাস্থ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মেডট্রনিক ল্যাবসের যৌথ উদ্যোগ এনসিডি ৩৬০ ডিগ্রি ইতিমধ্যে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের হার ৩১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭২ শতাংশ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের হার ২৩ শতাংশ থেকে ৪৭ শতাংশে উন্নীত করেছে।
এনসিডি ৩৬০ ডিগ্রি বাংলাদেশ সরকারের দশ বছরের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ভিত্তিতে গড়ে উঠছে। ২০১২ সালে সরকার জনস্বাস্থ্য নীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। এর আওতায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অসংক্রামক রোগের জন্য পৃথক চিকিৎসা কক্ষ (এনসিডি কর্নার) চালু করা হয়। প্রতিটি উপজেলায় এনসিডি কর্নারে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সের তত্ত্বাবধানে রোগ নির্ণয়, পরামর্শ এবং বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে।
সারাদেশে বর্তমানে এনসিডি কর্নারের সংখ্যা ৪০০টি। যাত্রা শুরুর পর থেকে এনসিডি কর্নারগুলো কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব রাখলেও শুরুতে নানা কারণে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাচ্ছিল না। এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল চিকিৎসক ও নার্সের অভাব, প্রয়োজনীয় ওষুধের জন্য যথাযথ বাজেট না থাকা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি- অসংক্রামক রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতার অভাব।
আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এই রোগগুলোর প্রভাব ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়, ফলে সাধারণ মানুষ ভাবতে থাকে যে তারা রোগাক্রান্ত নন এবং এখনো ঝুঁকিমুক্ত। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে সরকার, ব্র্যাক ও মেডট্রনিক ল্যাবস মিলে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করে যে কীভাবে মানুষকে অসংক্রামক রোগ সম্পর্কে সচেতন করা যায়। এই ভাবনা থেকেই এনসিডি ৩৬০ ডিগ্রি যাত্রা শুরু।
ব্র্যাকের কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী নেটওয়ার্ক এবং মেডট্রনিক ল্যাবসের প্রযুক্তিগত সহায়তায়, অসংক্রামক রোগের হার সবচেয়ে বেশি এমন দুটি জেলায় —নীলফামারী ও নারায়ণগঞ্জে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করে এনসিডি ৩৬০ ডিগ্রি।

ডা. ইমরান আহমেদ চৌধুরী, হেড অব হেলথ সিস্টেম ট্রান্সফরমেশন অ্যান্ড ইনোভেশন, ব্র্যাক স্বাস্থ্য র্কমসূচি, ব্র্যাক।
ঘরে ঘরে স্বাস্থ্যসেবা
এনসিডি ৩৬০ ডিগ্রির আওতায় সারাদেশে ব্র্যাকের কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীরা নিয়মিত মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছাচ্ছেন। তারা সাধারণ মানুষকে অসংক্রামক রোগ সম্পর্কে সচেতন করার পাশাপাশি রোগ পরীক্ষা (স্ক্রিনিং) এবং ফলো-আপ কার্যক্রমও চালাচ্ছেন।
স্বাস্থ্যকর্মীরা একটি মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করেন, যেখানে প্রতিটি ভিজিটে রোগীর রক্তে শর্করা ও রক্তচাপের তথ্য আপডেট করা হয়। অ্যাপটি তাৎক্ষণিকভাবে রোগীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য জানায় এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তাকে সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা এনসিডি কর্নারে রেফার করার পরামর্শ দেয়।
কমিউনিটি ক্লিনিকে সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর প্রাথমিক মূল্যায়ন করে, প্রয়োজন অনুযায়ী এনসিডি কর্নারে রেফার করেন। এনসিডি কর্নারে নার্স প্রথমে রোগীর শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করেন, এরপর চিকিৎসক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা নির্দেশ দেন। পরে ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসেবীরা রোগীর সঙ্গে বসে চিকিৎসা, জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং কীভাবে নজরদারি করতে হবে, সে সম্পর্কে পরামর্শ দেন। এ সময় তারা রোগীর বিভিন্ন প্রশ্নেরও উত্তর দেন। রোগ নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীরা কল সেন্টারের সহায়তায় নিয়মিত রোগীর ফলো-আপ চালিয়ে যান।
এ পর্যন্ত এনসিডি ৩৬০ ডিগ্রি উদ্যোগের মাধ্যমে প্রায় দেড় লাখ মানুষ স্ক্রিনিং সুবিধা পেয়েছেন, যা ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যার দুটি জেলার নীলফামারী ও নারায়ণগঞ্জ- প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। বর্তমানে মানুষ এনসিডি কর্নারে স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার আগ্রহ বাড়ছে। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ২৫ শতাংশই ব্র্যাকের কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে রেফার করা হয়েছে।
শুধু রোগ শনাক্ত করাই নয়, এনসিডি কর্নারের কার্যক্রম আরও বিস্তৃত। এই উদ্যোগ স্থানীয় জনগণ ও সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে একটি সুন্দর সংযোগ তৈরি করছে, যা পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে সক্রিয় ও কার্যকর করতে সাহায্য করছে। অসংক্রামক রোগের হার তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায়, উত্তরাঞ্চলের এমন পাঁচটি জেলায় এনসিডি কর্নারের উদ্যোগ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। তবে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত প্রতি তিনজন রোগীর মধ্যে মাত্র একজন নিয়মিত সেবা নিচ্ছেন।

সিমিন ইবনাত ধনিত্রী, কমিউনকেশন কনসালট্যান্ট, কমিউনিকেশনস, ব্র্যাক।
সীমাহীন সম্ভাবনার পথ
অসংক্রামক রোগ যেমন নির্দিষ্টভাবে রোগীর শারীরিক ও অর্থনৈতিক অবস্থায় প্রভাব ফেলে, তেমনি এই রোগ মোকাবিলায় যথাযথ বিনিয়োগ না করা হলে সমাজে এর বহুমাত্রিক প্রভাব পড়তে পারে।
২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগ বিশ্বে শারীরিক প্রতিবন্ধিতার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে এই রোগ ৬৩ শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধিতার জন্য দায়ী।
গবেষণায় দেখা গেছে, জনস্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করলে অকাল মৃত্যু, অসুস্থতা ও প্রতিবন্ধিতার হার কমিয়ে সঠিক বিনিয়োগ সাতগুণ পর্যন্ত ফেরত পাওয়া সম্ভব।
শারীরিক অসুস্থতা একদিকে যেমন পরিবারে দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়, অন্যদিকে এটি পরিবার ও সমাজকে বিভিন্নভাবে ঝুঁকিতে ফেলে। যেমন- অভিভাবকের মৃত্যু শিশুদের বাল্যবিবাহ বা শিশুশ্রমের ঝুঁকিতে ফেলে।
সারা বিশ্বেই স্বাস্থ্য বাজেটে সংকোচন হচ্ছে। এই বাস্তবতায় আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে, কীভাবে এ সমস্যাগুলো মোকাবিলা করা যায়। স্থানীয় সরকারি সংস্থাগুলোর দক্ষতা, সক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং সরকারি বিনিয়োগের সমন্বয়ে এই চ্যালেঞ্জ জয় করা সম্ভব। এনসিডি ৩৬০ ডিগ্রি উদ্যোগটি এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
লেখক
ডা. ইমরান আহমেদ চৌধুরী
হেড অব হেলথ সিস্টেম ট্রান্সফরমেশন অ্যান্ড ইনোভেশন
ব্র্যাক স্বাস্থ্য র্কমসূচি, ব্র্যাক
এবং,
সিমিন ইবনাত ধনিত্রী
কমিউনকেশন কনসালট্যান্ট
কমিউনিকেশনস, ব্র্যাক
এএমপি/এমএস