জসীম উদ্‌দীনের আখ্যান কাব্যে লোকজ বৈশিষ্ট্য

আবু আফজাল সালেহ
আবু আফজাল সালেহ আবু আফজাল সালেহ , কবি ও প্রাবন্ধিক
প্রকাশিত: ০১:০২ পিএম, ১৪ মার্চ ২০২৩

জসীম উদ্‌দীনকে (০১ জানুয়ারি ১৯০৩-১৪ মার্চ ১৯৭৬) ‘পল্লীকবি’ বলা হয়। কারণ তাঁর কবিতাজুড়ে পল্লি মানুষ ও পল্লির প্রতিবেশ। অন্য কবিতার ন্যায় তিনি লোকজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আখ্যান কাব্য রচনা করেছেন। তাঁর আখ্যানমূলক কাব্য চারটি হচ্ছে: নক্সী কাঁথার মাঠ (১৯২৯), সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩), সকিনা (১৯৫৯) ও মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩)। আখ্যানমূলক কাব্যগুলোর শব্দাবলি বা উপাদানগুলো আশেপাশের; সবুজ বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু মাইকেল, নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ কবি আখ্যান বা কবিতায় রামায়ণ-মহাভারত, লোকপুরাণ বা ধর্মীয় ঐতিহ্যের কাছে হাত পেতেছেন। এ ক্ষেত্রে জসীম উদ্‌দীন ব্যতিক্রম ও অনন্য। তাঁর আখ্যান কাব্য জনপ্রিয়তা ও নির্মাণশৈলীতে অনন্য।

‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ সর্বাধিক জনপ্রিয় কাব্য। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ও জনপ্রিয় কাব্য। এ দুটি আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। কবি জসীম উদ্‌দীনের কাব্যপ্রতিভায় ফুটে ওঠে লোকজ উপাদানের ব্যবহারের দক্ষতা। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সবাই নগর-চেতনাসম্পন্ন, নাগরিক জীবন-স্বভাব ও আচার-আচরণে অভ্যস্ত এবং সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও তার প্রতিফলন ঘটাতে সচেষ্ট, জসীম উদ্‌দীন সেখানে এক উজ্জ্বল, ব্যতিক্রম। তাঁর কবিতায় তিনি আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালোবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। কবির কবিতা পড়লে বোঝা যাবে, লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়।

ছোটবেলা থেকেই সৌন্দর্যের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। নদী, প্রকৃতি ও নারীর সৌন্দর্য উপভোগ করতেন তিনি। ‘মুখখানা যেন সিন্দুরের মতো ডুগু ডুগু করে’ বলে উজ্জ্বল নারীর প্রতি টানের কথা বোঝা যায়। সে সময়ে হিদু ও মুসলমানের বাস ছিল বৃহত্তর ফরিদপুর, বলা যায় বাংলার অনেক স্থানে। মাঝেমধ্যে সম্প্রীতির ফাটল দেখা যেত। এসব কবিতায় তুলে ধরেছেন। তবে হিন্দুদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল তাঁর, ছোটবেলা থেকেই। হিন্দু রমণীদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতেন। কবির নিষ্পাপ চোখের বর্ণনা পাই বিভিন্ন কবিতায়, আখ্যান কাব্যে। নক্সী কাঁথার মাঠ আখ্যান কাব্যে সাজুর সৌন্দর্য যেমন দেখি ‘লাল মোরগের পাখা’, তেমনই ‘তুলসীতলার প্রদীপ, তুলসীফুলের মঞ্জুরী কি দেব দেউলের ধূপ’, ‘সাঁঝ সকালের রঙিন মেঘেরা’ ইত্যাদি সৌন্দর্যের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। চিত্রকল্প নির্মাণ করতে গিয়ে বিভিন্ন অলংকার ব্যবহারে দেশের কাছেই হাত পেতেছেন। কিছু কিছু অংশ (তার কবিতা থেকে) তুলে ধরলেই তা পরিষ্কার হবে। নারীর অনুভব খুব গভীরতর। নারী ও প্রকৃতি মিলে দারুণ প্রকাশে ব্যঞ্জনা পেয়েছে জসীম উদ্‌দীনের কবিতায়। বাঙালি সংস্কৃতি নিয়েই তাঁর কবিতায় ওজস্বিতা প্রকাশ পেয়েছে।

আরও পড়ুন: উত্তর-আধুনিকতার মর্মকথা 

সোজন বাদিয়ার ঘাট কবি জসীম উদ্‌দীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। নক্সী কাঁথার মাঠ কাব্যের মতো এটিও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ইউনেস্কো কর্তৃক ‘Gypsy wharf’ নামে অনূদিত হয়ে আন্তর্জাতিক পাঠক-সমাজে পরিচিতি লাভ করেছে। দুটি আখ্যান কাব্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্র সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বিদেশি অনেক মনীষী কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে। দুটো কাব্যেই অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল বা গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস। সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। অন্য আখ্যান কাব্যেও তাই। হিন্দু কিশোরি দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সোজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীম উদ্‌দীন লিখলেন, ‘এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে/ মাথার ওপর একই আকাশ ভাসছে রঙের নীলে/ এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি/ সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি।’ (সোজন বাদিয়ার ঘাট)

কবি জসীম উদ্‌দীনের নক্সী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট কাহিনি কাব্য হিসেবে সম্পূর্ণ নতুন। আধুনিক বাংলা কাব্যে যারা আখ্যান কাব্যের রচয়িতা; তারা কেউই জসীম উদ্‌দীনের মতো এভাবে মৌলিক কাহিনি নির্মাণ করেননি। এসব আখ্যান কাব্যের মূল উপাদান লোকজ থেকে নেওয়া। অন্যরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনি থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীম উদ্‌দীন নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লি বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। তবে কাহিনি বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তাঁর রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সংগীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। আধুনিক কবিতায় অলংকারের প্রয়োগ লক্ষ্যণীয়।

কবি জসীম উদ্‌দীনের কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমসোক্তি ও অন্য অলংকারের যুৎসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তাঁর অলংকারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ। যুৎসই উপমা ও অনুপ্রাসের ব্যবহার কবিতার শিল্পগুণকে উন্নীত করেছে। প্রতিনিধি হিসেবে কিছু উল্লেখ করছি। প্রথমেই নক্সী কাঁথার মাঠ থেকে কিছু অলংকারিক (উপমা ও অনুপ্রাস) প্রয়োগ দেখে নিই:
১. কাঁচা ধানের পাতার মত কচি মুখের মায়া
২. লাল মোরগের পাখার মত ওড়ে তাহার শাড়ী
৩. কচি কচি হাত-পা সাজুর সোনার সোনার খেলা (যমক)
তুলসী তলার প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঝের বেলা
৪. তুলসী ফুলের মঞ্জুরী কি দেব দেউলেত ধূপ
৫. কালো মেঘা নামো নামো, ফুল তোলা মেঘ নামো
৬. বাজে বাঁশী বাজে, রাতের আঁধারে, সুদূর নদীর চরে,
উদাসী বাতাস ডানা ভেঙে পড়ে বালুর কাফন পরে (সমাসোক্তিসহ)
৭. হেমন্ত চাঁদ অর্ধেক হেলি জ্যোৎস্নায় জাল পাতি,
টেনে টেনে তবে হয়রান হয়ে, ডুবে যায় সারারাতি (সমাসোক্তির প্রয়োগ, নক্সী কাঁথার মাঠ)
৮. উদয় তারা আকাশ-প্রদীপ দুলিছে পূবের পথে,
ভোরের সারথী এখনো আসেনি রক্ত ঘোড়ার রথে (সোজন বাদিয়ার ঘাট)

আরও পড়ুন: কবিতায় বসন্তের রূপ 

রূপক, উপমা, প্রতীক, রূপকল্পের বৈচিত্র্য, নৈপুণ্যপূর্ণ ব্যবহার আধুনিক কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আগের যুগেও এর ব্যবহার ছিল। চিরচেনা পরিবেশ নিয়ে জসীম উদদীনের কবিতার চিত্রায়ন খুব স্বাভাবিক বিষয় বলেই মনে হয়। আশেপাশের লোকজ উপাদানের এমন দুটি কবিতাংশ তুলে ধরছি:
১. মাঠের যতনা ফুল লয়ে দুলী পরিল সারাটি গায়,
খোঁপায় জড়ালো কলমীর লতা, গাঁদা ফুল হাতে পায় (সোজন বাদিয়ার ঘাট)
২. এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল,
কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল!
কাঁচা ধানের পাতার মত কচি-মুখের মায়া,
তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া।
জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দুখান সরু,
গা খানি তার শাওন মাসের যেমন তমাল তরু।
বাদল-ধোয়া মেঘে কেগো মাখিয়ে দেছে তেল,
বিজলী মেয়ে পিছে পড়ে ছড়িয়ে আলোর খেল। (নক্সী কাঁথার মাঠ)

‘সোজন যেনবা তটিনীর কূল, দুলালী নদীর পানি/ জোয়ারে ফুলিয়া ঢেউ আছড়িয়া কূল করে টানাটানি/ নামেও সোজন, কামেও তেমনি, শান্ত স্বভাব তার/ কূল ভেঙে নদী যতই বহুক, সে তারি গলার হার (সোজন বাদিয়ার ঘাট)’এমন সাধারণ উপাদানে অসাধারণ বুননের কবিতা অনেক। উল্লেখিত কবিতাংশ তাঁর কবিতার প্রতিনিধি হিসেবেই ধরে নেওয়া শ্রেয় হবে। চরিত্র নির্মাণে (বিশেষত নায়ক-নায়িকা) কবি জসীম উদ্‌দীন মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। উপমার প্রয়োগে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। অন্ত্যানুপ্রাস তো কবির স্বভাবজাত। প্রেমিক-প্রেমিকার বিরহ-বেদনার বর্ণনায়ও নিখুঁত। এ যেন মধ্যযুগের কবি বিদ্যাপতির ‘এ সখি হামারি দুখে নাহি ওর।/ এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর’ কবিতাংশের মতো জসীম উদ্‌দীনের স্বর:
‘আজকে দুলীর বুক ভরা ব্যথা, কহিয়া জুড়াবে/ এমন দোসর কেহ নাই হায় তার,/ শুধু নিশাকালে, গহন কাননে, থাকিয়া থাকিয়া/ কার বাঁশী যেন বেজে মরে বারবার।/ ...কে বাঁশী বাজায়! কোন দূর পথে গভীর রাতের/ গোপন বেদনা ছাড়িয়া উদাস সুরে,/ দুলীর বুকের কান্দনখানি সে কি জানিয়াছে,/ তাহার বুকেরে দেখেছে সে বুকে পুরে?’ (সোজন বাদিয়ার ঘাট)

নক্সী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট আখ্যান কাব্য দুটিতে কবি জসীম উদ্‌দীন পল্লিজীবন ও পল্লি-ঐতিহ্যকে আঁকড়ে রেখেছেন। পল্লির বিভিন্ন অলংকার থেকে শুরু করে শব্দ বুনন, চিত্রকল্প প্রভৃতি মিলিয়ে অনবদ্য আখ্যান কাব্যে উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। শব্দ, ভাষার স্বর, ছন্দ বা উপমায় দারুণ সব কারুকাজ করেছেন। কবি জসীম উদ্‌দীন তাঁর সময়ের পরিবেশ, প্রতিবেশ, প্রীতি-দ্বন্দ্ব, মিল-অমিল, পল্লির রূপ তুলে ধরেছেন লোকজ-বৈশিষ্ট্যে। কবিতার মাধ্যমে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করতে পেরেছেন তিনি। কবিতাগুলোর প্রতিটি শব্দ যেন পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।