একজন শাহানারা বেগম

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:৩১ পিএম, ১৯ এপ্রিল ২০২৩

সুমি ইসলাম

আমার আব্বা খুবই সাধারণ ছিলেন। মা ছিলেন তারচেয়েও সাধারণ মাটির মানুষ। কোনোদিন দেখিনি তিনি আব্বার উপরে কোনো কথা বলেছেন। তার ছেলে-মেয়েকে মানুষ করার জন্যও কোনোদিন তার মুখ দিয়ে একটা বাজে কথাও বের হয়নি।

টানাটানির সংসারে কোনোদিন আম্মাকে কোনো বিষয় নিয়ে অভিযোগ করতে দেখিনি আমরা। আমাদের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন আব্বা।

আমার বড় দুই বোনের তখন বিয়ে হয়েছে। ওই মামা-চাচারাই দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছেন। বড় দুই বোনের পরে তিন ভাই, তারপরে আবার দুই মেয়ে। আর সাত সন্তানের মধ্যে আমি সবার ছোট।

আব্বা একটা পেপার মিলে চাকরি করতেন। হঠাৎ করেই মিলটা বন্ধ হয়ে যায়। আব্বা বেকার হয়ে যান। কোনো উপায় না পেয়ে শেষে আমাদের শহরের বড় মসজিদের গেটের সামনে একটি টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসতেন আব্বা। টেবিলের উপরে সাজানো থাকতো কয়েক রকমের আতর, টুপি আর নানা রঙের তসবিহ। মসজিদের মুসল্লিরা আব্বাকে চিনতেন। সবাই খুব ভালোবাসতেন আব্বাকে।

হঠাৎ করে আব্বা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এক মাস যায়, দুই মাস যায়; আব্বা সুস্থ হন না। সেই অসুস্থ শরীর নিয়েই প্রতিদিন কাজে যান। আতর বিক্রি না হলে সংসার চলবে কেমন করে।

বড় ভাইদের কাছে মা বলতেন, ‘তোদের আব্বার শরীরের যে অবস্থা; ভয় হয় কখন জানি কী হয়ে যায়।’ আম্মা ঠিকমতো ভাত খেতে পারতেন না। খালি কান্নাকাটি করতেন। পাঁচ ওয়াক্তসহ সারাদিনে কত নফল নামাজ যে তিনি পড়তেন। তিনি জায়নামাজেই থাকতেন দিনের বেশিরভাগ সময়। কত নামাজ মানত করেছিলেন। শুধু বলতেন, ‘আল্লাহ উনি চলে গেলে আমাদের কী হবে? এতগুলো বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আমি কী করবো?’ আমাদের সবার তখন একটাই ভয়, আব্বা মারা গেলে আমাদের কী হবে?’ আমাদের সংসার চলবে কেমন করে? আমাদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। মা একা একা কী করবেন? আমরা তো না খেতে পেয়ে মারা যাবো।

আমার বয়স যখন দশ, তখন আমাদের সাত ভাই-বোনকে রেখে আমার আতর, তসবিহ, টুপি বিক্রেতা আব্বা মারা গেলেন।

আব্বা তো মারা গেলেন, আমাদের ভয় শেষ হলো। আমাদের কিছুই হলো না। বড় ভাই আর মেজ ভাই আব্বার আতরের ব্যবসাটা দেখতে লাগলেন। তবে এবার আর মসজিদের বাহিরে টেবিলের উপরে রেখে নয়। মসজিদের পাশে ছোট একটা দোকান ভাড়া নিয়ে। তাতে আতর, টুপি, তসবিহর সাথে যোগ হলো জায়নামাজ, মেসওয়াক, নামাজ শিক্ষার বই ও কোরআন শরিফ।

ব্যবসার পুঁজি হলো আব্বা মারা যাওয়ার পর মসজিদের মুসল্লিদের কাছ থেকে পাওয়া সাহায্যের টাকা। দানটা নেহায়েত খারাপ ছিল না। তা না হলে বড় ভাইদের পক্ষে ব্যবসা বড় করা সম্ভব হতো না।

বেশ ভালোই চলছিল আমাদের সংসার। আগের মতো তেমন টানাটানি নেই। সেজ ভাইটা কলেজে অনার্সে ভর্তি হলো। আমি আর আমার দুই বছরের বড় বোনটা শিশু থেকে কিশোরী হলাম। আমরা বিনুনি দুলিয়ে স্কুলে যাই।

বড় দুইটা ভাই বিয়ের উপযুক্ত হলো। বিয়ে দেওয়াটা ফরজ হয়ে দাঁড়ালো। আমাদের থেকে প্রতিবেশীদের মাথা বেশি ব্যথা হতে লাগলো। কেন ছেলেদের বিয়ে দিচ্ছে না। ছেলেদের ইনকাম খাবে বলে ছেলেদের বিয়ে দিচ্ছে না। কত রকমের আজেবাজে কথা।

আমরা আবারও চিন্তায় পড়ে গেলাম। ভাইদের বিয়ে দিলে তারা যদি পর হয়ে যান। তারা যদি মা আর ছোট তিন ভাই-বোনকে না দেখেন। তখন সংসার চলবে কেমন করে। হাজারটা চিন্তা মাথায় নিয়ে দুই ভাইয়ের বিয়ে দেওয়া হলো। ছয় মাস ভালোভাবেই কাটল। তারপর একদিন রাতে দুই ভাই এসে বলল, তাদের বউরা আর একসাথে থাকতে পারবে না। এতগুলো মানুষের কাজ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এতগুলো মানুষের রান্নাবান্না করাটা তাদের জন্য অসম্ভব। তা ছাড়া এ বাড়িতে ঘর নেই। কষ্ট করে গাদাগাদি করে থাকাটা অসম্ভব।

দুই ভাই আলাদা হয়ে বাসা নিলেন। আমাদের সংসারটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। প্রথম দুই-তিন মাস দুই ভাই কিছু কিছু করে টাকা দিতো। পরে একেবারেই টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিলো। হাসি পায় খুব। আমরা যে ভয়টা পেয়েছিলাম, সেটাই হলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তাদের ছাড়াও আমরা বেঁচে থাকলাম।তাদের ছাড়া আমাদের ভেঙে যাওয়া সংসারটাও খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলতে লাগলো।

মা আমাদের মা মুরগির মতো আগলে রাখলেন। মার জন্য চিন্তা হতো। মা একা কত কাজ করেন। দিনে সংসারের কাজ করেন। কাঁথা সেলাই করেন। রাত জেগে মেশিনে জামা-কাপড়ের অর্ডারের সেলাইয়ের কাজ করেন।

আমাদের তিন নাম্বার ভাইটা টিউশনি করিয়ে, কোচিংয়ে পড়িয়ে নিজের লেখাপড়াটা চালাতে লাগলো। বড় দুই বোন আমার আর আমার বড় বোনের লেখাপড়ার খরচ দিতে লাগল। মা সেলাইয়ের কাজ করে টেনেটুনে সংসার চালাতেন।

মা কিছুদিন ধরে বেশ অসুস্থ হলেন। সব সময় জ্বর থাকে আর কাশি। পাড়ার ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ কিনে এনে খাওয়ানো হয় কিন্তু রোগ সারে না। আমরা তিন ভাই-বোন চিন্তায় পড়ে গেলাম। মায়ের কিছু হয়ে গেলে আমাদের কী হবে? কে দেখবে আমাদের?

বড় ভাইয়েরা মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা দিলেন। মাকে বড় ডাক্তার দেখানো হলো। রোগ ধরা পড়লো। লাংক ক্যান্সার। শেষ পর্যায়ে। বড় জোর তিন মাস বাঁচবেন। আমাদের মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়লো।
তিন মাসও গেলো না। তার আগেই মা আব্বার কাছে চলে গেলেন। আমরা শোকে পাথর হয়ে গেলাম।

কয়েক মাস খুব কষ্টে কাটল। বড় দুলাভাই আমার সেজ ভাইটাকে এক অল্প বেতনের চাকরি জোগাড় করে দিলেন। আমাদের কিন্তু কিছুই হলো না, মা ছাড়া দিব্যি দিন পার করছি। শুধু মনের ভেতর থেকে কষ্ট হতো, আমরা এতিম হয়ে গেলাম। আমাদের মাথার উপরে খোলা আকাশ, নিচে থই থই পানি। দুর্সম্পর্কের এক বিধবা মামিকে নিয়ে আসা হয় বাড়িতে। তিনিই আমাদের দেখাশোনা করতেন। রান্নাবান্না করতেন। তার হাতেই আমাদের নিঃশেষ হয়ে যাওয়া সংসারটার ভার দেওয়া হয়।

আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি। কলেজে গিয়ে এক সুদর্শন সিনিয়র ভাইয়ের প্রেমে পড়লাম। তুমুল প্রেম। কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচবো না টাইপের প্রেম। আমার প্রেমিক আমার সব খরচ দিতো।

আমি ইন্টারমিডিয়েট পাস করলাম। সে আমাকে ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য কোচিংয়ে ভর্তি করালো। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হলাম।

আমার প্রেমিক তার রাজনৈতিক বড় ভাইদের সাথে কথা বলে আমার জন্য হলে রুমের ব্যবস্থা করে দিলো।মাসে মাসে আমার প্রেমিক যে টাকা দিতো, তাতে আমার বেশ ভালোভাবেই চলছিল। তার কথা ছিল, আমি যেন কোনো রকম চিন্তা না করি। শুধু লেখাপড়ার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আমি তাই করলাম। আমার রেজাল্টও ভালো হলো। আমাদের প্রেম তখনো তুঙ্গে। আমরা বিয়ে করবো। আমাদের সংসার হবে। এসব চিন্তায় আমরা বুদ হয়ে থাকতাম।

আমি অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা দিলাম। হঠাৎ করেই আমার প্রেমিক আমার সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিলো। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এতদূর এসে আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে? ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো কেমন করে? আমি আত্মহত্যা করার জন্য স্লিপিং পিল খেলাম। রুমমেট, বন্ধু-বান্ধবীরা মিলে হাসপাতালে ভর্তি করলো। আমি বেঁচে গেলাম।

এত দিনের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেলো। আমার স্বপ্নে দেখা সংসার স্বপ্নেই ভেঙে গেলো। আমার প্রেমিক অন্যখানে বিয়ে করলো। আমি কিন্তু কষ্টে মরে গেলাম না। তাকে ছাড়াই আমি চলতে শিখে গেলাম। আমার ডিপার্টমেন্টের সবাই আমার প্রেমিককে চিনতো, আমাদের সম্পর্কের কথা জানতো। তারাই আমাকে সাহায্য করলো। সেখানকার বড় আপুদের সাহায্যে আমি দুটা টিউশনি জোগাড় করলাম। আমার বন্ধু-বান্ধবীরা বাকিটা দিয়ে আমার মাস্টার্স কমপ্লিট করলো। স্যারদের প্রিয় ছাত্রী ছিলাম। তাদের সুপারিশে ভালো চাকরি পেয়ে গেলাম।

কর্মস্থলে এক বছর হলো। আমার সিনিয়র কলিগ আমাকে পছন্দ করলো। বিয়ের প্রস্তাব দিলো। আমি রাজি হয়ে গেলাম। দশ বছরে আমাদের তিনটা সন্তান হলো। তাদের দেখাশোনা আর সংসারে সময় দেওয়ার জন্য চাকরিটা ছেড়ে দিলাম।

দেখতে দেখতে বিয়ের বিশ বছর পার করলাম। বড় সন্তানের বয়স আঠারো। মেজ মেয়ের বয়স পনেরো আর ছেলের বয়স দশ।

আমার স্বামী রোড অ্যাকসিডেন্ট করলেন, বাঁচা-মরা আল্লাহর হাতে। আমার সামনে অথৈই সাগর। কোথাও তল খুঁজে পাচ্ছি না। স্বামী মারা গেলেন। তার রেখে যাওয়া বাড়ি আর জমানো টাকা দিয়ে চলতে লাগলাম।পুরোনো অফিসে আবারও যোগাযোগ করলাম। কোনো কাজ হলো না। বয়স হয়ে গেছে। এখন আর চাকরির বয়স নেই। খালি হাতে ফিরে এলাম বাড়িতে।

অল্প পুঁজি দিয়ে শাড়ি-কাপড়ের বিজনেস শুরু করলাম।
কেটে গেলো আরও কিছু বছর। মেয়ের চাচারা বড় মেয়ের জন্য পাত্র আনলেন। পাত্র বিদেশে থাকে। ভালো পরিবার। বিয়ের পরই বড় মেয়ে জামাইয়ের সাথে কানাডায় চলে গেলো।

এক বছর পর ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলো চাচারা-ফুপুরা। ছোট মেয়ে কানাডা চলে গেলো।

ছেলেকে নিয়ে আমার সংসার চলছিল। ছেলেই এখন আমার একমাত্র ভরসা। ছেলেকে বুয়েটে ভর্তি করালাম। ছেলে আমার স্টুডেন্ট ভালো। সর্বোচ্চ মার্ক পেয়ে লেখাপড়া শেষ করলো। পিএইচডি করার জন্য ছেলে চলে যাবে আমেরিকায়। আমি কার কাছে থাকবো? বয়স হয়েছে। একা একা থাকতে ভয় করে। শরীরে বিভিন্ন ধরনের রোগ বাসা বেঁধেছে।

ছেলে এসে বলল, ‘মা মাত্র তো চারটা বছর। আমি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাবো। প্রতি বছর তো আমি আসবো দেশে। তুমি মন খারাপ করো না মা।’

মেয়েরা বলে, ‘মা, তুমি এই চার বছর আমাদের কাছে থাকো। তারপর না হয় ভাইয়ের কাছে যেও।’ আমি আমার স্বামীর বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি হলাম না।

ছেলে আমেরিকায় চলে গেলো, আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলাম।
এখন শেষ বয়সে এসে মনে হয়, এই যে আমরা ভাবি, কাউকে ছাড়া চলতে পারবো না। কারো জন্য আমাদের জীবনটা থেমে যাবে। এটা ভুল ধারণা। কারো জন্যই কারো জীবন থেমে থাকে না। এই যে ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর পর থেকে আমার জীবন কোনো না কোনো ভাবে চলেই গেছে। থেমে নেই কোনো কিছুর জন্য। বিশেষ কারো জন্য।

আমি শাহানারা বেগম সবাইকে হারিয়ে একা বেঁচে আছি। আমি প্রতিদিন খাওয়া-দাওয়া করছি, ঘুমাচ্ছি, টিভি দেখছি, বাজার করছি, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করছি। এখন অনেককেই আমার জীবনের গল্প বলি। তাদের বলি, ‘শোনো কেউ যদি বলে তোমার সাথে সম্পর্ক রাখবে না; তাতে কষ্ট পেয়ো না। কারণ কারো জন্যই কারো জীবন থেমে থাকবে না। যে তোমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাচ্ছে না। তাকে ছেড়ে দাও। সে চলুক তার পথে। তুমি তোমার জায়গায় অটল থাকো।’

আমি শাহানারা বেগম এখনো বেঁচে আছি। একা আছি। জীবনের চড়াই-উৎরাই পার করে আজও টিকে আছি।কতজনকে হারালাম, কতজনকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইলাম। সবাই এক এক করে চলে গেলো। রয়ে গেলাম আমি। কেউ কারো জন্য মরে যায় না, একা বাঁচতে শিখে যায়। কারো জন্য কারো জীবন আটকে থাকে না। কেউ কারো সাথে সম্পর্ক না রাখতে চাইলে কোনো সমস্যা নেই। নিজেকে নিয়ে সুখে থাকো, বিন্দাস জীবন কাটাও।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।