কতদূর এগোবে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক?
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের নেতৃত্বে ২৪ আগস্ট ঢাকায় হোটেল সোনারগাঁয়ে প্রতিনিধি দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ছবি: পিআইডি
সম্প্রতি শেষ হওয়া পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকা সফর এখনো আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে। সফরে কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন গঠনের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা।
তবে প্রশ্ন উঠেছে পাকিস্তানের কয়েকজন মন্ত্রীর সাম্প্রতিক ঢাকা সফর কতটুকু এগিয়ে নিতে পারবে দুদেশের সম্পর্ককে? বিশেষ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার সফরের সময় তিনি ‘পরিষ্কার মন নিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার’ যে বার্তা দিয়েছেন, তা ঘিরে তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
গত সপ্তাহে পাকিস্তান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দুই দিনের ঢাকা সফরে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তি, চারটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) ও একটি কর্মসূচি (প্রোগ্রাম) সই হয়েছে। দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রীর সফরে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন গঠনের সিদ্ধান্তও হয়েছে। এ ছাড়া দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খানের সফরে দেড় দশক ধরে অকার্যকর থাকা বাংলাদেশ-পাকিস্তান জয়েন্ট ইকোনমিক কমিশন কার্যকর করা হবে বলে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে।

তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, এসব উদ্যোগ সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হলেও পারস্পরিক আস্থা গড়তে হলে পুরোনো ক্ষত সারানোই সবচেয়ে জরুরি।
- আরও পড়ুন
- বিনা ভিসায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সফর করা যাবে কূটনৈতিক পাসপোর্টে
- অক্টোবরে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সরাসরি ফ্লাইট চালুর আশা ইসহাক দারের
- খালেদা জিয়ার দ্রুত আরোগ্য কামনা করলেন ইসহাক দার
- পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বড় রদবদল
বাধা একাত্তর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ‘রিগ্রেট’ শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে দায় স্বীকার এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা থেকেই যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় দিল্লি চুক্তি থেকে শুরু করে জেনারেল মোশাররফের ঢাকা সফর পর্যন্ত কোথাও সরাসরি ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি আসেনি। একাত্তরের ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে সম্পর্ক টেকসই করা সম্ভব নয়।’

‘যদি সত্যিই দুইবার সমাধান হয়ে থাকে, তাহলে তা যৌথভাবে ঘোষণার মধ্য দিয়ে, একটি সামিট লেভেলের ঘোষণায় থাকা উচিত ছিল। জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, এমনকি জাপান পর্যন্ত অতীতের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। পাকিস্তান কেন নয়?’ প্রশ্ন তোলেন ড. ইমতিয়াজ।
তিনি আরও বলেন, ‘সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হলে কেবল রাজনৈতিক সদিচ্ছা নয়, অর্থনৈতিক কাঠামোও দেখতে হবে। পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বাংলাদেশের চেয়েও দুর্বল। তাই বিনিয়োগ বা বাণিজ্যের সম্ভাবনা কতটুকু সেটাও যাচাই করতে হবে। একই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে যেন পাকিস্তান অন্যভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা না করে, সেটিও সতর্কভাবে দেখা দরকার।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম শফিউল্লাহর মতে, দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ আবারও চালু হওয়া দরকার। তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি জাহাজ, ফ্লাইট চলতো। কিন্তু ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে শেখ হাসিনার সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে ওই সব কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়। কিন্তু জনগণের ইচ্ছা এখনও আছে—সম্পর্ক হোক, বাণিজ্য বাড়ুক।’
তবে আস্থা গড়তে গেলে ইতিহাসের দায় থেকে মুক্তি নেই বলেও মনে করেন তিনি।

‘একাত্তরের ক্ষত আমাদের জাতিগত স্মৃতিতে গেঁথে আছে। পাকিস্তান যদি আন্তরিকভাবে সম্পর্ক চায়, তাহলে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। এটা ছাড়া কোনো বিশ্বাস তৈরি সম্ভব নয়,’ বলেন রাষ্ট্রদূত শফিউল্লাহ।
- আরও পড়ুন
- মুসলিম উম্মাহর ঐক্য নিয়ে ইসহাক দার ও জামায়াত আমিরের আলোচনা
- প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাৎ
- পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা চীনের উদ্যোগে নয়: তৌহিদ হোসেন
- বাণিজ্য বাড়াতে পারস্পরিক সহযোগিতায় আগ্রহী পাকিস্তান
তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘যদি ১৯৭৪ সালেই সব মীমাংসা হয়ে থাকে, তাহলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ২০০২ সালে এসে কেন আবার সেই প্রসঙ্গ তুললেন? তাছাড়া সিমলা চুক্তিতে আলোচনায় উঠে আসে তৎকালীন পাকিস্তানি আমলের সম্পদ বণ্টনের প্রশ্ন, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার অর্থের ব্যবহার এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের প্রত্যাবাসন বিষয়েও সমাধান হয়নি।’
শফিউল্লাহ স্মরণ করিয়ে দেন, পারভেজ মোশাররফ ঢাকায় এসে বলেছিলেন, ‘যদি ১৯৭১ সালে কোনো কিছু হয়ে থাকে, তবে আমরা রিগ্রেট করি। অথচ এটাও ছিল দায় এড়ানোর একটি রাজনৈতিক কৌশল। ইসহাক দারের সাম্প্রতিক মন্তব্যও সেই একই ধাঁচের।’
‘তারা কখনোই স্পষ্টভাবে ক্ষমা চায়নি। সবসময় ধোঁয়াশার মধ্যে রেখে চলেছে। মনে করে বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারবে না। এটা ছলচাতুরি। এতে সম্পর্ক গাঢ় হয় না,’ বলেন তিনি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সফরটি কূটনৈতিক প্রোটোকলের দিক থেকে যথেষ্ট সৌহার্দ্যপূর্ণ হলেও দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের এক পর্যায়ে অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যার প্রশ্নটি আলোচনায় উঠে আসার পর দৃশ্যত অস্বস্তিতে পড়ে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদল।
একাধিক কূটনৈতিক সূত্র জানায়, আলোচনায় উঠে আসে তৎকালীন পাকিস্তানি আমলের সম্পদ বণ্টনের প্রশ্ন, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার অর্থের ব্যবহার এবং এখনও বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের প্রত্যাবাসন নিয়ে ঝুলে থাকা জটিলতার বিষয়টিও উঠে আসে। তবে তাদের পূর্ববর্তী ‘দুঃখ প্রকাশের’ ব্যাখ্যা দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করলেও বাকি বিষয়গুলোতে কোনো জবাব আসেনি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে। একপর্যায়ে আলোচনার গতি শ্লথ হয়ে পড়ে।
সরকারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, বৈঠকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন, একাত্তরের ইস্যুগুলোর ‘দুইবার সমাধান’ হয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দলিল-প্রমাণ তুলে ধরে সেই দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষ সম্মত হয় যে, অমীমাংসিত ঐতিহাসিক ইস্যুগুলো নিয়ে ভবিষ্যতেও আলোচনা অব্যাহত রাখা হবে।
- আরও পড়ুন
- পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ইচ্ছাকৃতভাবে পিছিয়ে রাখা হয়েছিল
- অমীমাংসিত বিষয় সমাধানে বাংলাদেশ-পাকিস্তান একমত
- বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে যেসব চুক্তি-সমঝোতা স্মারক সই হলো
- একাত্তরের অমীমাংসিত ইস্যুর দুইবার সমাধান হয়েছে
বৈঠক শেষে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারও সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর ‘সমাধান দুইবার’ হয়েছে। তবে তার দাবির সঙ্গে একমত না হওয়ার কথা বলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।

সম্পর্কটা ভারতকেন্দ্রিক না হোক
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক যেন ভারতকেন্দ্রিক না হয়। যেহেতু ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ, এজন্য পাকিস্তান সেই সুযোগ নিতে চাইছে—এমন যেন না হয়। ভারতের সঙ্গে আমাদের ঝামেলা আমরা আলাদাভাবে মীমাংসা করব।’
এছাড়া পাকিস্তানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীনের মধ্যস্তার বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। যদিও এ বিষয়টি ঠিক নয় বলেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।

আরও সফরের সম্ভাবনা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সফরের পর এবার পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এদিকে গত মাসে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের ফিরতি সফর হিসেবে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা জননিরাপত্তা সচিব ইসলামাবাদ সফর করতে পারেন বলে আভাস মিলেছে।
- আরও পড়ুন
- ১৩ বছর পর ঢাকায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
- বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে এক চুক্তি ও ৪ সমঝোতা স্মারক সই
- বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী পাকিস্তান
- দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের প্রতিশ্রুতি ইসহাক দারের
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ এখন নির্বাচনমুখী। এই সময়ে সফর বিনিময় আসলেই হবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়।
জেপিআই/এমএমএআর/এএসএম