মিটফোর্ডে সোহাগ হত্যা

চাঁদা না দিলেই দোকান বন্ধ, ব্যবসায়ীদের মারধর

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১:১৪ এএম, ১২ জুলাই ২০২৫
পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে হত্যার দৃশ্য পেনসিল স্কেচে। ছবি: চ্যাটজিপিটি
  • • ব্যবসা দখলে অস্ত্রবাজি-ককটেল বিস্ফোরণ
  • • মহিন-অপু সিন্ডিকেটে অতিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা
  • • হত্যায় নেতৃত্বে যুবদল নেতা মহিন ও ছাত্রদল নেতা অপু দাস
  • • মৃত্যু নিশ্চিত করে রিয়াদ, সজীব, নান্নু, লম্বা মনির, ছোট মনির

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯) টেনেহিঁচড়ে নিজ দোকান থেকে বের করে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে সোহাগকে হত্যা করা হয়। নৃশংস এ ঘটনার সময় প্রাণভিক্ষা চেয়ে খুনিদের পায়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন সোহাগের কর্মচারী মো. ইসমাইল ও মো. বাবুল। বারবার অনুনয় করলেও তাতে মন গলেনি হামলাকারীদের। হায়েনার মতো সোহাগের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খুনিরা। পিটিয়ে, কুপিয়ে ও মাথা থেঁতলে নৃশংসভাবে মৃত্যু নিশ্চিত করে তার।

নারকীয় এই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন চকবাজার থানা যুবদলের সদস্য সচিব পদপ্রার্থী মাহমুদুল হাসান মহিন এবং একই থানা ছাত্রদলের সদস্য সচিব অপু দাস।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অর্ধশতাধিক লোক এ হামলায় অংশ নেয়। এর মধ্যে রিয়াদ, সজীব, নান্নু, লম্বা মনির ও ছোট মনির—পাঁচজন মিলে সোহাগের মাথা থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত করে। তারা সবাই মহিনের ঘনিষ্ঠ অনুসারী।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডে জড়িত মূলহোতা মহিন ও চকবাজার থানার ৩০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক তারেক রহমান রবিনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এছাড়া এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আরও দুজনকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব। এ নিয়ে মোট চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এজাহারভুক্ত অন্য আসামিরা এখনো পলাতক। তাদের ধরতে অভিযান চলছে।

চাঁদা না দিলেই দোকান বন্ধ, ব্যবসায়ীদের মারধরব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগ হত্যা মামলায় গ্রেফতার চকবাজার থানা যুবদলের সদস্য সচিব পদপ্রার্থী মাহমুদুল হাসান মহিন ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক তারেক রহমান রবিন। ছবি: জাগো নিউজ

স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী জানান, মহিন-অপু সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরেই মিটফোর্ড এলাকায় চাঁদাবাজি ও ব্যবসা দখলের রাজত্ব কায়েম করেছেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ হামলা। প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে ভয়-ভীতি দেখানো ছিল নিয়মিত ঘটনা।

যেভাবে নৃশংস হত্যা

সোহাগকে হত্যার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর গেট সংলগ্ন এলাকায় বৃষ্টির পানি জমে থাকা রাস্তায় অর্ধবিবস্ত্র হয়ে শুয়ে পড়ে আছেন সোহাগ। প্রায় নিথর দেহ নিয়ে নড়াচড়ারও উপায় নেই তার। নৃশংস হামলায় তখনও সোহাগের শুধু নিঃশ্বাসটুকু চলছিল। একপাশ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা সোহাগ তখন মৃত্যুপথযাত্রী। এসময় রাস্তা থেকে একটি বড় কংক্রিটের অংশ হাতে তুলে নেন হালকা আকাশি রঙের শার্ট ও জিন্সের প্যান্ট পরা রিয়াদ। মাথার ওপরে কংক্রিটের অংশ তুলে সজোরে কোমর আর বুকের মাঝখানে আঘাত করেন তিনি। সোহাগ দুই হাত আর দুই পা ছড়িয়ে রাস্তায় পড়ে থাকেন। এরপর একদম বুক বরাবর আবার আঘাত করলে সোহাগ আবার রাস্তার একপাশে মুখ ফিরিয়ে নেন। তখন টি-শার্ট আর গ্যাবাডিন প্যান্ট পরা সজীব একপাশ থেকে হেঁটে এসে আরেকটা বড় কংক্রিটের অংশ মাথায় তুলে মুখ বরাবর আঘাত করেন। এরপর আরেকটি ইট নিয়ে এসে মাথায় আঘাত করেন ছোট মনির। পাশ থেকে আবার মাথায় আঘাত করেন লম্বা মনির, আর এদের ইট এগিয়ে দেন নান্নু।

এভাবে বারবার মারতে মারতে মাথা থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় সোহাগের। আর এই পুরো হামলা এবং হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন মহিন ও অপু দাস।

মাথা থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত করা ছোট মনির মিটফোর্ড হাসপাতালের আউটসোর্সিং কর্মচারী, নান্নু হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার। বড় মনির, রিয়াদ ও সজীব যুবদল নেতা মহিনের কর্মী।

চাঁদা না দিলে মারধর, দোকান বন্ধ

স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই চকবাজার ও মিটফোর্ড এলাকায় সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন মহিন ও অপু দাস। বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন ব্যবসায়ীরা। ফুটপাত দখল করে দোকান থেকে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে হুমকি দিয়ে চাঁদা তোলা ছিল তাদের নিত্যদিনের কাজ। যারাই চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানাতেন তাদেরই মারধর করা হতো এবং দোকান বন্ধ করে দেওয়া হতো।

চাঁদা না দিলেই দোকান বন্ধ, ব্যবসায়ীদের মারধর
গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ৩০ নম্বর ওয়ার্ড চকবাজার যুবদলের কর্মিসভার মঞ্চে লাল চাঁদ সোহাগ (লাল বৃত্তে)। ছবি: সংগৃহীত

যুবদল ও ছাত্রদল সূত্রে জানা গেছে, সোহাগ একসময় মহিনের সঙ্গে চলাফেরা করলেও এলাকায় বিদ্যুতের তামার তার ও সাদা তারের অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। তামার তার ও সাদা তারের ব্যবসার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ ছিল সোহাগের কাছে। সেটির নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া ছিল মহিন, অপু, চকবাজার থানা যুবদলের সাবেক সদস্য সারোয়ার হোসেন টিটু, যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ-জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক রজ্জব আলী পিন্টুসহ মিটফোর্ড হাসপাতালের একটি চক্র। তারা ওই অবৈধ বাণিজ্যের ৫০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিল। তা নাহলে নিয়মিত চাঁদা দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। এর জেরেই দ্বন্দ্ব এবং নৃশংস হত্যাকাণ্ড বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

নিহত সোহাগের পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, এই সাদা তারের অবৈধ ব্যবসা নিয়ে সোহাগ এবং মহিন-অপু সিন্ডিকেটের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই দ্বন্দ্ব চলছিল। এই দ্বন্দ্বের জেরে সোহাগের সোহানা মেটাল নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গুলিও চালায় প্রতিপক্ষরা। এমনকি তিনদিন সোহাগকে দোকান পর্যন্ত খুলতে দেয়নি। চাঁদা না দেওয়ায় দোকান বন্ধ করে দেয় তারা।

এমনকি হত্যার আগের দিন মঙ্গলবারও (৮ জুলাই) এই নিয়ে চকবাজার এলাকায় গোলাগুলি হয়। এরপর বুধবার (৯ জুলাই) পরিকল্পিতভাবে ডেকে নিয়ে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে হত্যা করা সোহাগকে।

চাঁদার জন্য গোলাগুলি এবং ককটেল বিস্ফোরণ

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, সোহাগকে হত্যার কয়েকদিন আগেও এক অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ীকে চাঁদার জন্য সবার সামনে বেধড়ক মারধর করেন মহিন ও অপু দাস।

এছাড়াও গত মার্চ মাসে রজ্জব আলী পিন্টু, রবিন এবং আরও বেশ কয়েকজন স্থানীয় বিএনপি নেতা ইসহাক আলী সরকারের নেতৃত্বে গোলাগুলি এবং ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্যবসায়ীদের ওপর চাঁদার জন্য হামলা করে। এই ঘটনায় চকবাজার থানায় তাদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে মামলাও হয়।

সোহাগ হত্যার ঘটনায় তার বোন মঞ্জুয়ারা বেগম বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। মামলায় ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত মাহমুদুল হাসান মহিন, সারোয়ার হোসেন টিটু, মনির ওরফে ছোট মনির, আলমগীর, মনির ওরফে লম্বা মনির, নান্নু, সজীব, রিয়াদ, টিটন গাজী, রাকিব, সাবাহ করিম লাকী, কালু ওরফে স্বেচ্ছাসেবক কালু, রজব আলী পিন্টু, মো. সিরাজুল ইসলাম, রবিন, মিজান, অপু দাস, হিম্মত আলী, আনিসুর রহমান হাওলাদারসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করা হয়।

চাঁদা না দিলেই দোকান বন্ধ, ব্যবসায়ীদের মারধরহত্যার শিকার ব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগ। ছবি: সংগৃহীত

মঞ্জুয়ারা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘পরিকল্পিভাবে আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। কয়েকজন আসামি গ্রেফতার হয়েছে। আমরা চাই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাই যেন দ্রুত গ্রেফতার হয়। আর যেন কোনো বোন এভাবে ভাইহারা না হয়।’

যা বলছে পুলিশ

কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইয়াসিন শিকদার জাগো নিউজকে বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মহিন ও তারেকসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলমান।

জানতে চাইলে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেসন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে অভিযান পরিচালনা করে এজাহারভুক্ত আসামি মাহমুদুল হাসান মহিন (৪১) ও তারেক রহমান রবিনকে (২২) গ্রেফতার করে। এসময় তারেক রহমান রবিনের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব এবং পূর্ব শত্রুতার জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে। ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেফতারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

টিটি/এমএমএআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।