ছিল না অনুমোদন

মেয়রকে এড়িয়ে ৪৯ কোটি টাকার টেন্ডার ডাকলেন প্রধান প্রকৌশলী

ইকবাল হোসেন
ইকবাল হোসেন ইকবাল হোসেন , নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ১০:০৭ এএম, ০৯ অক্টোবর ২০২৫
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন/সংগৃহীত

চলমান পুরোনো প্রকল্প সংশোধন করে ৪৯ কোটি টাকার নতুন একটি ভবন নির্মাণের প্রস্তাব আরডিপিপি (সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদনের আগেই মেয়রকে এড়িয়ে টেন্ডার ডেকে বসলেন প্রধান প্রকৌশলী।

টেন্ডারের যাবতীয় কাজ শেষে কার্যাদেশ দেওয়ার আগ মুহূর্তে ঘটনাটি প্রকাশ্যে এলে সমালোচনা তৈরি হয়। নিয়মের ব্যত্যয় হওয়ায় আলোচিত টেন্ডারটি এরই মধ্যে বাতিলের নির্দেশ দিয়েছেন মেয়র। ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক)।

চসিকের প্রধান প্রকৌশলী আনিসুর রহমান প্রচলিত আইন ও বিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কাজটি করেন। ঘটনা প্রকাশ্যে এলে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন অনুমোদনের আগেই টেন্ডারের বিষয়টি তাকে অবগত করে ডাকা হয়নি বলে দাবি করেন। নিয়মের ব্যত্যয় হওয়ায় আলোচিত টেন্ডারটি বাতিলেরও নির্দেশ দেন তিনি।

এ বিষয়ে কথা বলতে দাপ্তরিক ও ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও প্রধান প্রকৌশলী আনিসুর রহমান রিসিভ করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তা দিলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।

চসিক সূত্রে জানা যায়, পরিচ্ছন্নকর্মীদের আবাসন নিশ্চিতে ২৩১ কোটি ৪২ লাখ ৬৮ হাজার টাকায় ‘পরিচ্ছন্নকর্মী নিবাস নির্মাণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করে চসিক। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। প্রকল্পে সরকারি (জিওবি) তহবিল থেকে ১৮৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা এবং চসিকের নিজস্ব তহবিল থেকে ৪৬ কোটি ২৮ লাখ ৫৩ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়।

এ প্রকল্পের আওতায় পরিচ্ছন্নকর্মীদের জন্য ১৪ তলা বিশিষ্ট সাতটি ভবন নির্মাণ করার কথা। যেখানে এক হাজার ৩০৯টি ফ্ল্যাট থাকবে। এর মধ্যে বান্ডেল কলোনিতে তিনটি, ঝাউতলায় দুটি, ফিরিঙ্গবাজারে একটি এবং সাগরিকায় চসিকের নিজস্ব জায়গায় একটি ভবন নির্মাণের কথা ছিল। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়। পরে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়।

মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেওয়ার আগেই কাজ করার জন্য টেন্ডার ডেকে আগেভাবে অবৈধ লাভবান হওয়ার জন্য দুর্নীতির অভিপ্রায়ে এ টেন্ডার ডেকেছেন প্রধান প্রকৌশলী। এখানে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিপ্রায়- দুটিই দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধ।- সুজন চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী

সরেজমিনে দেখা যায়, মেয়াদ বাড়িয়েও প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ করা যায়নি। এর মধ্যে ঝাউতলায় একটি ভবনের ১২ তলা পর্যন্ত হয়েছে। অন্যটির কাজ শুরুই হয়নি। বান্ডেল কলোনির তিনটি ভবনের মধ্যে একটির আটতলা, আরেকটির ১১ তলা পর্যন্ত হয়েছে। জায়গার অভাবে হচ্ছে না অন্য ভবনের নির্মাণ। ফিরিঙ্গি বাজারে নির্মাণাধীন ভবনটির চারতলার ছাদ ঢালাই হয়েছে। তবে সাগরিকায় নির্মাণাধীন ভবনটির বেশির ভাগ কাজ শেষ।

আরও পড়ুন
ভারী যান চলাচলে বেহাল মাঝিরঘাট সড়ক, ধুলা-কাদায় অতিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা
কর্ণফুলীতে বিপিসির ‘তেল চুরির’ সত্যতা মিলেছে, বন্ধে ১২ সুপারিশ
খাস কালেকশনের নামে রাজস্বের টাকা ভাগাভাগি
খুঁড়িয়ে চলছে ৬ হাজার কোটি টাকার রং শিল্প

এদিকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ঠিকাদাররা কাজ বন্ধ করে দেন। অনেকে চুক্তি বাতিলের আবেদন করেন চসিকে। যে কারণে প্রকল্প এগিয়ে নিতে প্রকল্প সংশোধনের উদ্যোগ নেয় চসিক। এর মধ্যে বান্ডেল কলোনিতে জায়গার অভাবে নির্মাণ করতে না পারা ভবনটি পূর্ব মাদারবাড়িতে করপোরেশনের নিজস্ব জায়গায় করার প্রস্তাব করা হয়। এতে প্রকল্প ব্যয় ৭৮ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৩০৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা করা হয়। বর্ধিত প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে জিওবি অংশের ৬৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা মঞ্জুরি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু আরডিপিপির জন্য অতিরিক্ত ব্যয়ের অনুমোদন দেয়নি স্থানীয় সরকার বিভাগ। এর মধ্যে টেন্ডার ডাকা পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত ১৪ তলা ভবনটিও রয়েছে। আরডিপিপিতে ভবনটির জন্য প্রাক্কলন ধরা হয় ৪৮ কোটি ৬৭ লাখ ৯৩ হাজার ২৭১ টাকা।

তবে মন্ত্রণালয় অনুমোদন না দিলেও মেয়রের অজ্ঞাতসারে মাদারবাড়ির ভবনটি নির্মাণের জন্য ৪ জুন দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রে সই করেন প্রধান প্রকৌশলী আনিসুর রহমান। গত ১৩ জুলাই দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন এবং উন্মুক্ত করার সময় নির্ধারিত ছিল। ইজিপিতে (ই-গভর্মেন্ট প্রকিউরমেন্ট) ডাকা টেন্ডারে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়।

টেন্ডারটির পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৪৩ কোটি ৮১ লাখ ১৩ হাজার ৯৪৪ টাকায় সর্বনিম্ন দরদাতা হয় শেলটেক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। ৪৬ কোটি ৫৫ লাখ ৫৬ হাজার ১১৫ টাকায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন হয় মেসার্স তৌহিদ অ্যান্ড ব্রাদার্স-আরএ (জেভি), ৪৭ কোটি ২৪ লাখ ৩২ হাজার ৮৭০ টাকায় তৃতীয় সর্বনিম্ন হয় ডেল্টা ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনসোটিয়াম লিমিটেড, ৪৮ কোটি ৩৯ লাখ ৮৯ হাজার ৪১৫ টাকায় চতুর্থ সর্বনিম্ন হন আরএন ইয়াকুব অ্যান্ড ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেড এবং ৪৮ কোটি ৯৬ লাখ ২১ হাজার ২৯৪ টাকায় পঞ্চম সর্বনিম্ন দরদাতা হন মোহাম্মদ ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্স (প্রা.) লিমিটেড।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন প্রকৌশলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘পূর্বানুমোদন ছাড়া কেউ সরকারি কাজের টেন্ডার ডাকতে পারেন না। এটা পুরোপুরি অনিয়ম। এখন যে আরডিপিপির কথা বলা হচ্ছে, সেটি মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয়নি এবং ভবিষ্যতে কাজটি সিটি করপোরেশনকে নিজেদের টাকায় করার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে বলা হয়েছে। ফলে নতুন ভবনটির বাস্তবায়ন অনিশ্চিত। কিন্তু প্রধান প্রকৌশলী টেন্ডারটি আহ্বান করায় অনেক টাকার ক্ষতি হয়েছে। কারণ টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরি থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞানসহ প্রত্যেকটি কাজের ব্যয় আছে।’

টেন্ডারটির বিষয়ে আগে কিছুই জানতাম না। তবে প্রধান প্রকৌশলী কাজটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য টেন্ডারটি ডেকেছেন। এখন নিয়মের ব্যত্যয় হওয়ায় টেন্ডারটি বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছি।- চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন

এ বিষয়ে কথা হলে সুশাসনের জন্য সাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা দেশের জনগণ এখন ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়েছি। সবগুলো প্রতিষ্ঠানের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আখের গোছানোর তালে আছে। বিধি মেনে টেন্ডার আহ্বান করা উচিত ছিল। বিধি মানলে তো সময়ের প্রয়োজন হবে। তাই তাড়াতাড়ি খাওয়ার জন্য আগেভাগে ঘোড়ার আগে গাড়ি ঠেলে দিয়ে এ কাজটি করেছেন। এতে চরম একটি দুর্নীতির চিত্র ফুটে উঠেছে।’

তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেওয়ার আগেই কাজ করার জন্য টেন্ডার ডেকে আগেভাবে অবৈধ লাভবান হওয়ার জন্য দুর্নীতির অভিপ্রায়ে এ টেন্ডার ডেকেছেন প্রধান প্রকৌশলী। এখানে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিপ্রায়- দুটিই দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধ।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘টেন্ডারটির বিষয়ে আগে কিছুই জানতাম না। তবে প্রধান প্রকৌশলী কাজটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য টেন্ডারটি ডেকেছেন। এখন নিয়মের ব্যত্যয় হওয়ায় টেন্ডারটি বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছি।’

প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে এ অনিয়মের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মূলত মাদারবাড়িতে সেবকদের পুরোনো ভবন জীর্ণশীর্ণ হওয়ায় গণমাধ্যমে অনেক বিরূপ প্রতিবেদন এসেছে। আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ও ইতোমধ্যে ৬৩ কোটি টাকা অর্থ ছাড় দিয়েছে। ওনারও (প্রধান প্রকৌশলী) দোষ নেই। তাতে দুর্নীতির অভিপ্রায় ছিল না। মূলত মাদারবাড়ির বিল্ডিং নিয়ে পত্রিকায় বেশি লেখালেখি হওয়ায় উনি (প্রধান প্রকৌশলী) কাজটি দ্রুত এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। তারপরেও যেহেতু নিয়মের ব্যত্যয় হয়েছে, বলেছি টেন্ডারটি বাতিল করে দিতে।’

মেয়র বলেন, ‘স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে আরডিপিপি অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় সরকার বিভাগ বলছে এখন নতুন করে প্রকল্পের আরডিপিপি অনুমোদন দেওয়া যাবে না। নতুন কাজের সব টাকা, প্রায় ৮০ কোটি টাকা আমাদের (সিটি করপোরেশন) থেকে দিতে হবে। এখন এত টাকা আমরাও কোথা থেকে দেবো। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের সঙ্গে কথা বলেছি।’

এমডিআইএইচ/এএসএ/এমএফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।