চাকুরিচ্যুত শিক্ষকদের কাছে ঢাবি`র পাওনা সাড়ে তিন কোটি টাকা


প্রকাশিত: ০৯:০৬ পিএম, ০৮ মার্চ ২০১৫

শিক্ষা ছুটি নিয়ে দেশে ফিরে না আসা কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুণরায় যোগদান না করায় চাকরিচ্যুত ৫২ শিক্ষকের কাছে কর্তৃপক্ষের পাওনা রয়েছে ৩ কোটি ৬৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। শর্ত ভঙ্গ করে ওই শিক্ষকরা এ সব টাকা ভোগ করলেও বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও তা ফেরত দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে রবিবার অভিযুক্ত শিক্ষকদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়— শিক্ষাছুটি শেষে পুনরায় যোগদান না করায় এই ৫২ শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এ ছাড়া কিছু শিক্ষক পদত্যাগও করেছেন। কিন্তু তাদের চিঠি দিয়ে বারবার পাওনা টাকা পরিশোধের তাগাদা দেওয়ার পরও তারা পরিশোধ করেননি। ইতোমধ্যে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাওনা টাকা অনতিবিলম্বে পরিশোধ করার জন্য তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতর থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তি অনুসারে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক মিসেস শায়লা হামিদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাওনা ৫ লাখ ১৫ হাজার ৪২১ টাকা, সহকারী অধ্যাপক মিসেস ফায়েজা সুলতানার কাছে ৪ লাখ ১১ হাজার ৯৩৩ টাকা, প্রভাষক সুধীর স্যামুয়েল চৌধুরীর কাছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৮৯৮ টাকা, সহকারী অধ্যাপক মন্ময় জাফরের কাছে ৯ লাখ ৩৪ হাজার ২৬৮ টাকা, রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাইনুল হোসেন ভূঁইয়ার কাছে ৩ লাখ ৭২ হাজার ৯৩৫ টাকা, সহকারী অধ্যাপক মো. কামরুজ্জামানের কাছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৭৩০ টাকা, সহকারী অধ্যাপক মিসেস লুনা নাসরীন রহমানের কাছে ৩ লাখ ২৯ হাজার ৬১০ টাকা, প্রভাষক মো. জসিম উদ্দিনের কাছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৬১০ টাকা, প্রভাষক ড. দলিলুর রহমানের কাছে ৪৫ হাজার ৩৫০ টাকা (তবে তার ৪৮ হাজার ৩৬৯ টাকা সঞ্চয় তহবিলে জমা আছে); প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. নাজমুল হুদার কাছে ২ লাখ ২০ হাজার ১০৬ টাকা, সহকারী অধ্যাপক ড. মরিয়ম নাসরীনের কাছে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ১৭১ টাকা, সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জুবায়ের রহমানের কাছে ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬৭৭ টাকা, সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আরিফের কাছে ৬ লাখ ৩২ হাজার ৪০০ টাকা; বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আমিনুর রহমানের কাছে ৩৮ লাখ ১২ হাজার ২৪৪ টাকা; রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান ভূঞার কাছে ২৩ লাখ ১৪ হাজার ৯২৫ টাকা, অধ্যাপক ড. মো. আতাউর রহমানের কাছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ১৩ টাকা, সহকারী অধ্যাপক জাহিদ হাসানের কাছে ২ লাখ ১ হাজার ৯৬৩ টাকা; শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ.টি.এম. আব্দুলাহেল শাফীর কাছে ৪ লাখ ১৮ হাজার ৮১৯ টাকা; ইলেকট্রিকাল ও ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. সাইফুল ইসলামের কাছে ৬ লাখ ৫২ হাজার ৭৭০ টাকা, প্রভাষক ড. জামিল ইউসুফ খানের কাছে ৪১ হাজার ৭৯৩ টাকা, প্রভাষক সেকেন্দার চৌধুরীর কাছে ১৯ হাজার ১১০ টাকা, প্রভাষক আদনান সিরাজ লস্করের কাছে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৩২০ টাকা, প্রভাষক শেখ মোহাম্মদ আলীর কাছে ৩০ লাখ ৪৪ হাজার ১৮২ টাকা, সহযোগী অধ্যাপক মিসেস আনিকা আজিজের কাছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৭৬০, প্রভাষক মো. বজলুর রশীদের কাছে ২ লাখ ৩০ হাজার ৯২২, প্রভাষক মো. জহিরুল হকের কাছে ২ লাখ ৪৭ হাজার ২৯৩ টাকা, সহযোগী অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হায়দারের কাছে ৪ লাখ ২৬ হাজার ৬৮ টাকা পাওনা রয়েছে।

কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রভাষক মো. আশরাফুজ্জামানের কাছে ২ লাখ ১৯ হাজার ৩৪ টাকা, সহকারী অধ্যাপক ড. এ.কে.এম. জিয়াউর রহমানের কাছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩০৩ টাকা, সহযোগী অধ্যাপক ড. নাসিমুল নোমানের কাছে ৮ লাখ ১৫ হাজার ৬৬৭ টাকা, সহকারী অধ্যাপক মো. এনামুল করিমের কাছে ৬ লাখ ৩৫ হাজার ২১৪ টাকা, প্রভাষক ড. মাহমুদ হোসেনের কাছে ৩ লাখ ৭১ হাজার ৮৬০ টাকা, প্রভাষক রনি হাসিনুর রহমানের কাছে ১০ লাখ ৪ হাজার ৪৬ টাকা; পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মোহম্মদ আসাদ-উজ-জামানের কাছে ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৬০৩ টাকা; স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক জাহিদুল কাইউমের কাছে ৫ লাখ ৫১ হাজার ৩৭০ টাকা; ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নাসরিন ইসলাম খানের কাছে ৮ লাখ ৯৩ হাজার ৯১ টাকা; আরবি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাহমুদ বিন সাঈদের কাছে ১০ লাখ ২২ হাজার ৮৮৪ টাকা; তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হানিফ উদ্দিনের কাছে ১০ লাখ ৯৫ হাজার ৮২ টাকা; একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আরিফুর রহমানের কাছে ১৪ লাখ ২১ হাজার ১০৩ টাকা, সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নুরুল হকের কাছে ১১ লাখ ৩৮ হাজার ৩৭০ টাকা, সহযোগী অধ্যাপক অনুপ চৌধুরীর কাছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৪৮৬ টাকা, ফিন্যান্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসফিক উদ্দীনের কাছে ৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৪ টাকা, সহকারী অধ্যাপক নেহাল মাহতাবের কাছে ৯ লাখ ৮৫ হাজার ৬৭৪ টাকা, প্রভাষক মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিনের কাছে ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৫১৭ টাকা; নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মিসেস তানিয়া শারমিনের কাছে ১০ লাখ ১০ হাজার ৯৪১ টাকা; ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. জিনাত মাহজাবিনের কাছে ৬ লাখ ১৫৪ টাকা; উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মিসেস রুনা লায়লার কাছে ৮ লাখ ৬৬ হাজার ২২০ টাকা; শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. মোক্তার হোসেনের কাছে ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৬০৫ টাকা; ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আবুজার কবিরের কাছে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৬৯৩ টাকা, সহকারী অধ্যাপক মো. আমিনুল ইসলাম মল্লিকের কাছে ১৫ লাখ ৮৪ হাজার ২৮৭ টাকা, লেকচারার মো. নজরুল ইসলামের ৪ লাখ ২২ হাজার ১৫১ টাকা; প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. খলিলুর রহমানের কাছে ২ লাখ ৫২ হাজার ২৯১ টাকা পাওনা রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. ‍নূর-ই-ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ছুটিতে থাকার সময়ে এই সকল শিক্ষক বেতনবাবদ এ সব টাকা নিয়েছেন। এর বাইরে অন্যান্য খাতের টাকাও আছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিন্ডিকেট সদস্য বলেন, ‘কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী শিক্ষক যদি শিক্ষা ছুটি নিয়ে দেশের বাইরে যান তবে তিনি প্রথম চার বছর বেতন পান। পরবর্তী দুই বছর তাকে বেতন দেওয়া হয় না। এ ছাড়াও ছুটি নিতে চাইলে সেসব ছুটি তার পরবর্তী ছুটি থেকে কেটে নেওয়া হয়। কিন্তু শর্ত ভঙ্গ করলে তার বেতনভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা অবৈধ হয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘এই শিক্ষকদের বেশির ভাগই শিক্ষা ছুটি নিয়ে বাইরে গিয়ে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ রাখেননি অথবা পরবর্তীতে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, কিন্তু প্রথম চার বছরের বেতনের টাকা তুলেছেন।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জানান, ‘নির্দিষ্ট সময়ে টাকা পরিশোধ না করলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে পাওনা টাকা আদায়ের মামলা করবে।’

তিনি বলেন ‘উচ্চশিক্ষার জন্য সবেতনে ছুটি নিয়ে বিদেশ গিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ না দেওয়ায় ঐ শিক্ষকদের চাকুরিচ্যুত করা হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকবার তাদের কাছে চিঠির মাধ্যমে জানানো হলেও তারা পাওনা পরিশোধ করেননি।’

চাকুরিচ্যুত শিক্ষকদের একজন শিক্ষক মন্ময় জাফর (বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) বলেন, ‘ঢাবি কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে আমি হতবাক। এভাবে সংবাদ মাধ্যমে সব শিক্ষকের নাম প্রকাশ করা একেবারেই অনুচিৎ।’

তিনি বলেন, ‘অন্যদের কথা বলতে পারব না। আমি ঢাবির সঙ্গে বরাবর যোগাযোগ রেখেছি। তারপরেও আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। যারা দেশের বাইরে চলে গিয়েছে, অন্য কোথাও নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছে তাদের কাতারে ফেলে আমাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। আমি সাড়ে পাঁচ বছরের ছুটি নিয়ে দেশের বাইরে যাই। এর মাঝে অবশ্য কিছুদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ক্লাস নিই।’

তিনি আরও বলেন, ‘৫ বছর পরে যখন আমি মাত্র ৩/৪ মাসের জন্য ছুটি চাই তখন আমাকে ছুটি না দিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়। অথচ আমি জানি ছুটি নিয়ে ১০ বছরেরও বেশি সময় অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকেছেন।’

এ প্রসঙ্গে উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘আমরা অনেক সময় নিয়ে অনেক কিছু পর্যবেক্ষণ করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

এসআরজে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।