১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে খাবার নেই, জরিপ ব্র্যাকের

বিশেষ সংবাদদাতা
বিশেষ সংবাদদাতা বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৭:৩৬ পিএম, ১০ এপ্রিল ২০২০

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় ও ঘরে থাকার নির্দেশনা মানতে গিয়ে নিম্নআয়ের মানুষের আয় প্রায় ‘নেই’ হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে চরম দারিদ্র্যের হার আগের তুলনায় বেড়ে গেছে ৬০ শতাংশ। করোনায় সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দেশের ১৪ শতাংশ মানুষেরই ঘরে কোনো খাবারই নেই।

৬৪ জেলায় ২ হাজার ৬৭৫ জন নিম্নআয়ের অংশগ্রহণকারীর ওপর বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত জরিপে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। গত ৩১ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিলের মধ্যে চলে জরিপটি।

করোনাভাইরাসের স্বাস্থ্যগত দিকগুলো সম্পর্কে নিম্নআয়ের মানুষের উপলব্ধি এবং এর অর্থনৈতিক সংকট সম্পর্কে ধারণা পেতে জরিপটি পরিচালিত হয়। ব্র্যাকের হেড অব মিডিয়া অ্যান্ড এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স রাফে সাদনান আদেল স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এতে বলা হয়, ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেইঞ্জ প্রোগ্রাম পরিচালিত জরিপটিতে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করেন ব্র্যাকের মাইক্রোফাইন্যান্স, আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম এবং পার্টনারশিপ স্ট্রেংদেনিং ইউনিটের কর্মীরা।

জরিপে দেখা যায়, কী কী ব্যবস্থা অবলম্বনের মাধ্যমে করোনাভাইরাসে সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯ প্রতিরোধ করা সম্ভব, সে বিষয়ে ৩৬ শতাংশ উত্তরদাতার পরিষ্কার ধারণা নেই। এমনকি করোনা সংক্রমণের লক্ষণ (জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট) দেখা দিলে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সরাসরি চলে না আসার যে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে সে বিষয়েও ধারণা নেই অধিকাংশের।

৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন প্রতিবেশি এসব লক্ষণ দেখা দিলে তাকে শহরের হাসপাতাল বা সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেবেন। মাত্র ২৯ শতাংশ হেলপলাইনে ফোন করার কথা বলেছেন।

জরিপে উঠে আসা চিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে ব্র্যাকের প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ করা হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
>>টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে এর ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয় সম্পর্কে পৃথক, বৃহৎ মাত্রার প্রচারাভিযান চালাতে হবে।
>>সামাজিক দূরত্বের পদক্ষেপ সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য দেশব্যাপী খাদ্য সংকটে পড়া মানুষের কাছে অতি শিগগির খাদ্য পৌঁছাতে হবে, নয়তো তাদের ঘরে রাখা সম্ভব হবে না। জীবিকা অর্জনে তারা বাইরে বের হতে বাধ্য হবেন।
>>শহর থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ গ্রামে ফিরে গেছেন যাঁরা গ্রামকেন্দ্রিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাভুক্ত নন। তাদের কাছে জরুরি খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানোর আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
>>এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি বোরো ধান কাটা শুরু হবে যা চলবে মে মাসের শেষ পর্যন্ত। এ সময় কৃষক যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন এবং সঠিক দাম পান সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে আগাম ধান ক্রয় অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে।
>>গ্রাম থেকে শহরে সবজি, দুধ-ডিম-মাছসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য পরিবহন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে গ্রামে এসবের দাম কমে গেছে। খাদ্যসরবরাহ চেইন যাতে স্বাভাবিক থাকে সেজন্য বিশেষ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এছাড়া সংকটপরবর্তী সময়ে গ্রামাঞ্চলের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ক্ষতি পুষিয়ে পুনরায় ব্যবসা চালু করার জন্য অর্থায়নসহ অন্যান্য সহযোগিতা পৌঁছানোর পদ্ধতি-প্রক্রিয়া নিয়েও আগাম পরিকল্পনা করা উচিত।

এই জরিপে যেসব বিষয় উঠেছে, তার মধ্যে আছে-

উপার্জন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় প্রভাব
করোনাভাইরাস প্রতিরোধের পদক্ষেপের ফলে নিম্নআয়ের মানুষ জীবিকার দিক থেকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর ফলে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৮৯ শতাংশ চরম দরিদ্রে পরিণত হয়েছেন অর্থাৎ দারিদ্র্যরেখার নিম্নসীমার নিচে নেমে গেছেন। করোনাভাইরাসের পূর্বে আয়ের ভিত্তিতে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ২৪ শতাংশ ছিলেন দারিদ্র্যরেখার নিম্নসীমার নিচে এবং ৩৫ শতাংশ ছিলেন দারিদ্র্যরেখার ঊর্ধ্বসীমার নিচে। এতে বোঝা যায় চরম দারিদ্র্য আগের তুলনায় বর্তমানে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

করোনা মহামারির আগে জরিপে অংশ নেয়া ২ হাজার ৬৭৫ জনের গড় আয় ছিল ১৪ হাজার ৫৯৯ টাকা। যাদের মধ্যে ৯৩ শতাংশ জানিয়েছেন, এই করোনা প্রাদুর্ভাবের পর তাদের আয় কমেছে। মার্চ ২০২০-এ এসে তাদের গড় আয় দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৪২ টাকায়, অর্থাৎ তাদের পারিবারিক আয় ৭৫ শতাংশের মতো কমে এসেছে। চট্টগ্রাম (৮৪ শতাংশ), রংপুর (৮১ শতাংশ) এবং সিলেট বিভাগের (৮০ শতাংশ) মানুষের আয় কমেছে সবচেয়ে বেশি।

সরকারি ছুটি বা সামাজিক দূরত্বের কারণে ৭২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন অথবা তাদের কাজ কমে গেছে। ৮ শতাংশ মানুষের কাজ থাকলেও এখনো বেতন পাননি। কৃষিকাজে সম্পৃক্তদের (৬৫ শতাংশ) তুলনায় অ-কৃষিখাতের দিনমজুর বেশি (৭৭ শতাংশ) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ৫১ শতাংশ রিকশাচালক, ৫৮ শতাংশ কারখানা শ্রমিক, ৬২ শতাংশ দিনমজুর, ৬৬ শতাংশ হোটেল বা রেস্তোরাঁকর্মী জানান, চলতি মাসে তাদের আয় নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে কোনো খাবারই নেই। ২৯ শতাংশের ঘরে আছে ১ থেকে ৩ দিনের খাবার।

রোগ সম্পর্কে সচেতনতার মাত্রা
শতকরা ৯৯ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষই এই ভাইরাস সম্পর্কে শুনেছেন। যার মধ্যে ৬৬ শতাংশ মানুষ প্রথম বিষয়টি জেনেছেন টেলিভিশন থেকে। মাত্র ৪০ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশন করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাব্য উপায়।

করোনা আক্রান্ত হলে কোথায় যোগাযোগ করতে হবে এ বিষয়ে নারীদের (৩৮ শতাংশ) চেয়ে পুরুষদের (৬০ শতাংশ) ধারণা বেশি।

৪৮ শতাংশ মানুষ মনে করেন, সরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯-এর রোগীর চিকিৎসা হয় না। এছাড়া ৯ শতাংশ মানুষ জানেনই না এই অবস্থায় কী করা উচিত।

সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে জনগণের প্রতিক্রিয়া
৬৮ শতাংশ মানুষ করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের সাধারণ ছুটির ঘোষণাকে সমর্থন করেন, শতকরা ৭ শতাংশ সমর্থন করেন না। ছুটির বিষয়ে সাধারণ মতামত হলো, সরকারি ছুটি গড়ে ২২ দিন হতে পারে। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ মানুষ ১৪ দিনের বেশি ছুটির পক্ষে।

এই মহামারি ঠেকাতে সরকারের ভূমিকা যথেষ্ট বলে মনে করেন বেশির ভাগ মানুষ (৬৪ শতাংশ)। বাকিদের মধ্যে ৩১ শতাংশ গ্রামের মানুষ এবং ৪০ ভাগ শহরের মানুষ এই ধারণাকে সমর্থন করেননি। মাত্র ৪ শতাংশ মানুষ (যাদের বেশিরভাগের বাস শহরে) জরুরি ত্রাণ পেয়েছেন বলে জানান (৫ এপ্রিল পর্যন্ত) ।

৪৭ শতাংশ মানুষ মনে করেন এ পরিস্থিতিতে সরকারের খাদ্য সহায়তা জরুরি, যেখানে শতকরা ২০ শতাংশ চান নগদ অর্থ সহায়তা। শহরের মানুষের (৪৪ শতাংশ) চেয়ে গ্রামের মানুষেরাই (৫০ শতাংশ) খাদ্য সহায়তার পক্ষে বেশি মত দেন।

এই পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে করণীয়
৩৬ শতাংশ মানুষ জানেন না এই পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংকটের সাথে তারা কীভাবে মানিয়ে নেবেন। ২৩ শতাংশ আশা করেন (যার মধ্যে নারী ৩৮ শতাংশ) এই পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হলে সরকার তাদের সহায়তা করবে। শহরের মানুষ গ্রামের মানুষের চেয়ে সরকারি সহায়তার ব্যপারে বেশি আশাবাদী। যদি পরিস্থিতি খুব সহসাই স্বাভাবিক না হয়, তাহলে ধার-দেনার চিন্তা করছেন ১৯ শতাংশ মানুষ।

এমইউ/এইচএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।