‘দ্যাশে যামু হেই উপায় নাই, ঢাকায়ও টিকতে পারতেছি না’
প্রতিদিন ভোর হলেই রাস্তায় চলে আসেন তারা। কোদাল, কর্নি, টুকরি-তাগার, রঙের বালতি, হাতুড়ি-বাটাল সামনে রেখে রাস্তার পাশে বসে যান। দৃষ্টি মেলে রাখেন সামনে, নিজের শ্রম বিক্রির জন্য ক্রেতার আশায়। বেলা গড়িয়ে রুদ্র রোষে বৈশাখের বেলা যখন ছুটতে শুরু করে, তাদের সামনে তখন নিরাশার বালুচর। তখন জীবনযুদ্ধের এই যোদ্ধারা যেন খানিকটা মনমরা হয়ে রোদ মাথায় পা বাড়ান অনিশ্চয়তার পথে।
মহামারি করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকারের বিধিনিষেধে এমনই সঙ্কটে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া ব্রিজের (আন্ডার পাস) ঢালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম সড়কের মুখে এসব শ্রমিকের দেখা মেলে প্রতিদিন। তাদের কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ কাঠমিস্ত্রি, কেউ মাটিকাটা শ্রমিক, কেউ রঙমিস্ত্রি এবং কেউ ইট, বালি ও রড টানা শ্রমিক। প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত এখানে অবস্থান করেন তারা। যারা কাজ করাবেন তারা এসে দরদাম করে শ্রমিক নিয়ে যান।
প্রতিদিন ভোর হতেই কোদাল-হাতুড়ি-বাটাল নিয়ে চলে আসেন তারা
এই শ্রমিকরা দৈনিকভিত্তিতে কাজ করেন। রাজমিস্ত্রিদের দৈনিক মজুরি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, কাঠমিস্ত্রিদের ৮০০ থেকে ৯০০, রঙমিস্ত্রি ৭০০ থেকে ৮০০, মাটিকাটা ও ইট-বালি টানা শ্রমিকদের ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
শ্রমিকরা জানান, একদিকে করোনা মহামারি, লকডাউন, এর ওপর অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে রড-সিমেন্টের দাম। বাড়িঘরসহ অবকাঠামো নির্মাণকাজে স্থবিরতা নেমে এসেছে। শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। টুকটাক যে কাজ সেখানেও সমস্যা। মানুষ করোনার ভয়ে কাজের জন্য বাইরে থেকে বাড়িতে লোক নিতে চায় না। কষ্টে থাকলেও কোনো ধরনের সরকারি ত্রাণ কিংবা সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলেও জানিয়েছেন শ্রমিকরা।
করোনার ভয়ে বাসা-বাড়িতে কাজে নিতে চাচ্ছে না অনেকে
আব্দুল সালেকের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ। মাটিকাটা শ্রমিক তিনি। আব্দুল সালেক বলেন, ‘দিনকাল ভালো না। লকডাউনে কাম-কাজ নাই। গাড়ি চলে না, দ্যাশে যে চলে যামু হেই উপায় নাই, আবারও ঢাকায়ও টিকতে পারতাছি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগের মাসে ২৫ থেকে ২৮ দিন কামলা দিতাম। ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা রোজ পাইতাম। এখন ৮-১০ দিনের বেশি কাম হয় না। সরকারও আমাগো কোনো সাহায্য দেয় নাই। ধার-কর্জ করে দিন চালাইতাছি।’
চার সদস্যের পরিবার নিয়ে মাতুয়াইল এলাকায় থাকেন কালু হাওলাদার। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীতে। তিনি বলেন, ‘গত মাসে ১০ দিনও কাজ-কাম পাই নাই। কাজ অনেক কমে গেছে, খুব কষ্টে আছি। বাসা ভাড়া বাকি পড়ছে। ঘরের মহিলা (স্ত্রী) মানুষের বাসায় কাজ করে, যা আনে তা দিয়ে কোনোরকম টিইকা আছি।’
করোনায় কাজ না পাওয়ায় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন শ্রমিকরা
রফিকুল ইসলামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে। মা-বাবা, স্ত্রী ও সন্তানসহ তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৬ জন। তিনি বলেন, ‘আমি রায়েরবাগে ছোট দুইডা রুম নিয়া থাকি। মাসে ৩ হাজার টাকা ভাড়া। কামাই বলতে গেলে নাই। ভাড়া জমতে আছে। লঞ্চ চললে সবাইরে নিয়া দ্যাশে চইল্লা যাইতাম। ধান দাইয়াও (কাটা) কোনোরকম দিন চইলা যাইতো। এহানে থাইক্যা ঋণ বাড়তে আছে।’
ফুলমতি বেগম নামে এক শ্রমিক বলেন, ‘৭ দিন ধরে বইসা আছি। চলাফেরায় কষ্ট, কাম-কাজ নাই। অবস্থা এমন হইছে, আল্লাহ ছাড়া কেউর ধারে কইতেও পারি না, আবার সইতেও পারি না। বাচ্চা-পোলাপাইন অনেক সময় না খাইয়াও থাহে। হুনছি সরকার ত্রাণ দেয়, আমরা এত কষ্টে আছি, কিন্তু আমরা কোনো দিন কিছু পাই নাই।’
করোনায় নির্মাণ কাজে স্থবিরতা নেমে আসায় বিপদে শ্রমিকরা
ফুলমতি বেগমের পাশেই বসে ছিলেন আরেক শ্রমিক শিল্পী রানী। তিনি বলেন, ‘আমমার ৫ মেয়ে। পোত্যেক দিন আইয়া বইয়া থাকি, কেউ কামে নেয় না। মাইয়ারা কাম করে, হেইয়া দিয়েই চলতাছি।’
রাজমিস্ত্রির কাজ করেন বাচ্চু মিয়া। তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে মানুষ বাড়ি-ঘর বানাইতাছে না। রডের দামও নামি অনেক বাইড়া গেছে। আমরা বলতে গেলে বেকার হয়ে গেছি। ২ মাসের বাসা ভাড়া আটকাইয়া গেছে। বাড়ির মালিক চাপ দেয়।’
মেহেন্দীগঞ্জের আরেক শ্রমিক রাহেল হোসেন বলেন, ‘একদিন কাজ করি তিনদিন বইস্যা থাহি। প্যাট তো বইস্যা থাহে না। তারে তো খাওন দিতে অয়। ঋণ খালি বাড়তে আছে। বাসা-বাড়িতে টুকটাক লেবারের কাজও নাই, একবারে না ঠ্যাকলে করোনার ভয়ে কেউ বাড়িতে লেবার নেয় না।’
কষ্টে থাকলেও কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন না শ্রমিকরা
মাথায় হালকা চুল, দাড়ি সব পেকে গেছে পটুয়াখালীর আতাহার আলীর। বয়স তার ৬০ বছরের বেশি। এই বয়সেও শ্রম দেন তিনি। আতাহার বলেন, ‘করোনা লাগছে থেকে কাজ-কাম কম। আমরা কষ্টে আছি। কাম নাই বইলা লোক (শ্রমিকরা) আহে না এখানে। তারপরও আড়াই-তিনশ লোক আহে। তাগো মইধ্যে ৫০ জনেরও কাম হয় না। সবাই ফিরা যায়। এরা কেউ কোনো সরকারি সাহায্য পাইছে আমি হুনি নাই।’
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গত ১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে আটদিনের কঠোর লকডাউন (কঠোর বিধিনিষেধ) শুরু হয়। লকডাউনের মধ্যে পালনের জন্য ১৩টি নির্দেশনা দেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। পরে সাতদিন করে দুই দফা লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সেই মেয়াদ শেষ হয়েছে বুধবার (৫ মে) মধ্যরাতে। লকডাউনের মেয়াদ নতুন করে আরও ১১ দিন বাড়িয়ে আগামী ১৬ মে পর্যন্ত নেয়া হয়েছে।
আরএমএম/এমএসএইচ/জিকেএস