‘করোনা কেড়ে নিয়েছে ঈদের খুশি’
দূর থেকে ভেসে আসছে জোহরের নামাজের আজানের ধ্বনি। এ সময় সাইরেন বাজিয়ে রাজধানীর রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন কবরস্থানে প্রবেশ করে লাশবাহী একটি অ্যাম্বুলেন্স। প্রবেশ গেটের ডানে সোজা উত্তর দিকের ডি-ব্লকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সেটি।
এ সময় স্ট্রেচারে করে একটি মরদেহ নামিয়ে কাঁধে নেন স্বজনরা। সামনে এগুতেই চোখে পড়ে সারিবদ্ধভাবে খুঁড়ে রাখা আনুমানিক ২০ থেকে ৩০টি কবর। সবশেষ যাকে দাফন করা হয়েছিল তার পাশেই এই ব্যক্তিকে কবর দেয়া হলো। দাফন শেষে তাদেরই একজন মহান আল্লাহর দরবারে হাত তুলে বলেন, ‘আজ এই পবিত্র ঈদের দিনে শামসুদ্দিন সাহেব তোমার এই বান্দা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তাকে তুমি ক্ষমা করে দিও।’ এ সময় কয়েকজন ডুঁকরে কেঁদে উঠেন।
বুধবার (২১ জুলাই) মধ্যদুপুরে রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন কবরস্থানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতদের দাফনের জন্য নির্ধারিত ব্লকে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে মৃতের স্বজনরা জানান, আজ পবিত্র ঈদুল আজহার দিন সকাল ৮টায় মারা গেছেন রাজধানীর কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা ৭০ বছরের বৃদ্ধ মোহাম্মদ শামসুদ্দিন।
তার মেয়ের জামাই জানান, এই বৃদ্ধ কয়েকদিন ধরে জ্বর ও ঠান্ডা-কাশিতে ভুগছিলেন। চারদিন আগে হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। করোনাসহ অন্যান্য পরীক্ষা করে চিকিৎসা শুরুর আগেই আজ সকালে তিনি মারা যান।
এদিকে, এই বৃদ্ধের করোনা রিপোর্ট তখনো পাওয়া না গেলেও চিকিৎসকরা সব লক্ষণ-উপসর্গ দেখে জানিয়েছিলেন যে, তার করোনা আক্রান্ত হয়েই মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর এ জন্যই তাকে করোনায় মৃতদের জন্য নির্ধারিত কবরস্থানে দাফন করা হয়।
বৃদ্ধ শামসুদ্দিনের মেয়ের জামাই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আজ ঈদের দিন খুশির দিন। কিন্তু করোনা সেই খুশি কেড়ে নিয়েছে।’
সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, আজ ঈদের দিনে কেবল শামসুদ্দিনের স্বজনরাই নন, এর আগে বিভিন্ন সময় করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন তাদের সন্তানসহ অন্য স্বজনরা ঈদের নামাজ শেষে কবর জিয়ারত করতে এখানে এসেছেন। মৃতের সঙ্গে কাটানো স্মৃতি স্মরণ করে দোয়া ও মোনাজাত করছেন তারা।
নীলক্ষেতের একজন পুস্তক ব্যবসায়ী বাবার কবর জিয়ারত করতে এসেছেন। আলাপকালে তিনি জানালেন, গত বছর রমজানে তার বাবার মৃত্যু হয়। জ্বর নিয়ে বাংলাদেশে মেডিকেলে ভর্তির পর করোনা ধরা পড়ে। খরচ চালাতে না পেরে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যান। চারদিন পর সেখানে তিনি মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর তার অনুপস্থিতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা দুই ছেলেকে নিয়ে শ্বশুরের কবর জিয়ারত করতে এসেছেন। দুই-তিন বছর বয়সী ছোট ছেলেটি তার নানা কিভাবে মারা গেছেন তা এ প্রতিবেদককে বোঝানোর চেষ্টা করছিল।
দেশে করোনার সংক্রমণে গত বছরের ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। শুরুর দিকে রাজধানীতে করোনায় মৃতদের ব্যাপক সুরক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শুধু খিলগাঁও তালতলা কবরস্থানে দাফন করা হতো। অবশ্য সেখানে জায়গার সঙ্কট দেখা দেওয়ায় গত বছরের ২৭ এপ্রিল থেকে রায়েরবাজার কবরস্থানে করোনায় মৃতদের দাফন শুরু হয়। একজন গোরখোদক বলেন, সঠিক সংখ্যা না জানলেও এ কবরস্থানে প্রায় দেড় হাজার লাশ দাফন হয়েছে বলে তার ধারণা।
বর্তমান করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতিতে প্রতিদিনই লাশ দাফনের জন্য এখানে আনা হচ্ছে। তাই আগাম কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছে। যারাই আসেন তাদের মুখে শোনা যায়, আল্লাহ জানেন এ কবরগুলো কোনটি কার জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে।
এমইউ/এমআরআর/এমএস