অর্থ সংকটে বন্ধের পথে সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা

রাসেল মাহমুদ
রাসেল মাহমুদ রাসেল মাহমুদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৩৫ এএম, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২

১৯৬২ সাল থেকে শখের বশে বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ শুরু করেন সিতেশ রঞ্জন দেবের বাবা শ্রীশ দেব। বিভিন্ন প্রাণী ধরে এনে বাড়িতে সেবা করতেন তিনি। প্রাণী ধরার কৌশল এবং তাদের প্রতি বাবার এমন মমত্ববোধ দেখে সিতেশ দেবও তা শেখেন। তার মধ্যেও জন্ম হয় প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা। বাবার সঙ্গে তিনিও প্রাণীর সেবা করতেন। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় নিজ বাড়িতে গড়ে তোলেন পশুপাখি সেবাশ্রম।

বন উজাড় ও অপরিকল্পিত শিল্প বিকাশের এই যুগে ঝোঁপঝাড় বিপন্ন হওয়ায় প্রাণীগুলো লোকালয়ে এসে যখন মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়ে তখন সিতেশ দেব সেগুলো ধরে সেবা দিয়ে অবমুক্ত করেন জঙ্গলে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রাণীর সদ্যজাত বাচ্চা বড় করে ছেড়ে দেন জঙ্গলে। মানুষের সহযোগিতায় ও নিজের খরচে প্রায় ৫০ বছর ধরে পশুপাখির সেবা করে চলা ‘সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা’ খ্যাত সেই সেবাশ্রম এখন বন্ধের শঙ্কায়।

১৯৭১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গড়ে তোলা হয় সিতেশ রঞ্জন দেবের পশুপাখি সেবাশ্রম। হরিণ, ভালুক, হনুমান, বানরসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী সেবা দেওয়া হয় সেবাশ্রমটিতে। অনেক সময় নানা প্রজাতির পাখিরও ঠাঁই হয় সেখানে। একসময় লোকমুখে পরিচিতি পেয়ে যায় ‘সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা’ হিসেবে। বাড়ির মধ্যে গড়ে তোলা সেবাশ্রমটির পরিসর দিন দিন বাড়তে থাকে আর প্রাণীগুলোর খাবার জোগান দিতে সিতেশ বাবুকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। প্রতিদিনই প্রাণীর খাবারের সন্ধানে তাকে পোকামাকড়, ইঁদুর ধরতে ছুটে যেতে হয়। আর ফল, সবজিভোজী ও মাংশাসী প্রাণীর জন্য তার একমাত্র আয়ের অবলম্বন পোলট্রি ও মাছের খামার।

jagonews24অর্থ সংকটে পড়েছে সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা

১৯৯১ সালে শূকরের হাত থেকে আদিবাসীদের ফসল রক্ষা করতে গিয়ে ভালুকের আক্রমণে এক চোখ, মুখ ও নাকে মারাত্মক আগাত পান সিতেশ রঞ্জন দেব। অসুস্থ হওয়ার পর আর্থিক কারণে অর্থ সংকটে প্রাণীদের খাবার দিতে পারছিলেন না তার ছেলেরা। তাই এটা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু গণমাধ্যমে সেটি বন্ধের খবর প্রচার হলে এলাকার বিত্তবানরা সহযোগিতা করেন। পরে ২০০৯ সালে সেবাশ্রমটি শহর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সিতেশ রঞ্জন দেবের মৎস্য খামার ‘রূপসপুর খামারবাড়ি’তে স্থানান্তর করা হয়। ১ দশমিক ৮০ একর এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠে ‘সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা’।

আরও পড়ুন: বন্ধ হচ্ছে কুমিল্লা চিড়িয়াখানা 

মৃত্যুর পথ থেকে বেঁচে ফেরা সিতেশ রঞ্জন বন্যপ্রাণীর সেবা চালিয়ে যান। অথনৈতিক টানাপোড়েনে তার দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। তার এই মিনি চিড়িয়াখানার কথা জানতে পারেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. আতিউর রহমান। তিনি সিতেশ রঞ্জনকে ২০১১ সালে একটি বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন গড়ে দেন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে করে দেন সীমানাপ্রাচীর। এতে বন্যপ্রাণী উদ্ধার ও সেবা-যত্নের পরিমাণ বেড়ে যায়, বাড়তে থাকে কাজের চাপ। বছরের পর বছর এসব কাজ করতে করতে ৭৪ বছর বয়সী সিতেশ বাবু এখন বয়সের ভারে অনেকটাই ক্লান্ত। তাই সেবাশ্রমটি এখন দেখভাল করেন সিতেশ রঞ্জন দেবের দুই ছেলে স্বপন দেব স্বজল ও সঞ্জিত দেব। পরম স্নেহে যত্ন করেন সীতেশ দেবের সহধর্মিণী ও মেয়েরাও।

সিতেশ রঞ্জন দেবের ছেলে সঞ্জিত দেব জাগো নিউজকে বলেন, আমরা বন্যপ্রাণীর সঙ্গে মিশে গেছি। এলাকায় কোনো বন্যপ্রাণী দেখলে কিংবা বিষাক্ত সাপ দেখলে বন বিভাগের কাউকে না বলে অনেকে আমাদেরই ফোন দেন। সকাল, সন্ধ্যা, রাত যেকোনো সময় ফোন দেন। আমরা প্রাণী ধরে নিয়ে এসে বন বিভাগকে খবর দেই।

jagonews24নানা জাতের পাখিও দেখা যায় সেবাশ্রমটিতে

বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, পশু-পাখি সেবাশ্রমটিতে বর্তমানে চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, সোনালি বাঘ, মেছো বাঘ, ভালুক, হনুমান, বানর, সাপসহ প্রায় ৩৩ প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার এই পশুপাখি সেবাশ্রম থেকে ২০১২ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ১০ বছরে ৪৮৬টি বন্যপ্রাণী জঙ্গলে অবমুক্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এসব প্রাণী অবমুক্তের সময় উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, শিক্ষকসহ সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিরা।

আরও পড়ুন: রাজশাহী চিড়িয়াখানায় থাকছে না পশু 

সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানায় দুর্লভ ও বিলুপ্তপ্রায় নানা প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। এরই মধ্যে সেখানে অসংখ্য প্রাণী বংশবিস্তারও করেছে। প্রাণীগুলো সেবা-শুশ্রূষায় সুস্থ হয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ফিরছে বনে।

সিতেশ রঞ্জন দেব জাগো নিউজকে বলেন, কোনো প্রাণী যখন কেউ ধরে, তখন অধিকাংশ সময়ই জখম হয়। এসব প্রাণী এনে প্রথমে এখানে চিকিৎসা দেই। মাসখানেক তাদের দেখভালের পর পুরোপুরি সুস্থ হলে সেগুলো আমরা জেলা পরিষদের মাধ্যমে আবার বনে অবমুক্ত করি।

জানা গেছে, সেবাশ্রমটিতে থাকা প্রাণীদের রক্ষার জন্য প্রয়োজন অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও জনবল। সেই সঙ্গে নিয়মিত চিকিৎসা ও খাদ্য সরবরাহে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়। প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে সেবাশ্রমটি। ২০ টাকার টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হয়। প্রতিদিন গড়ে ১০০ জন দর্শনার্থী আসেন। মাসে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা ব্যয় হয় সেবাশ্রমটিতে। মাঝে মাঝে সরকারি-বেসরকারি অনুদান ও টিকিট বিক্রিতে যে আয় হয় তা দিয়ে এক-তৃতীয়াংশ ব্যয় মেটে। বাকি খরচ বহন করতে হয় সিতেশ রঞ্জন দেবের পরিবার থেকেই। এ অবস্থায় অর্থ সংকটে সেবাশ্রমটির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় সিতেশ রঞ্জন দেব ও তার দুই ছেলে।

jagonews24২০ টাকার টিকিট কেটে ঢুকতে হয় সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানায়

ছেলে সঞ্জিত দেব জাগো নিউজকে বলেন, বাৎসরিক কোনো অনুদান আমরা পাই না। মানুষের স্বেচ্ছায় দেওয়া অনুদান এবং নিজেদের অর্থেই চলে পশুপাখির সেবাশ্রমটি। প্রতি মাসে সর্বনিম্ন দেড় লাখ টাকা খরচ হয়। ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশই আমাদের পরিবার থেকে দিচ্ছি। এভাবে যতদিন চালানোর সামর্থ্য থাকবে ততদিন চালাবো। যখন চালাতে পারবো না বন্ধ করে দিতে হবে।

প্রাণী ধরাসহ বৃদ্ধ সিতেশ রঞ্জন দেবের অধিকাংশ কাজ এখন ছেলে স্বপন দেব সজল করেন। ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজের বিষয়ে স্বজন দেব জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এলাকায় অনেক সাপ আছে। এগুলো অনেক সময় ধরতে যেতে হয়। কিন্তু জেলায় সাপের কোনো ভ্যাকসিন নেই। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ থাকবে না।

বাবার গড়ে তোলা পশুপাখির সেবাশ্রমটির ভবিষ্যৎ বিষয়ে তিনি বলেন, ২০ বছর ধরে প্রাণীর সেবা করছি। এখন প্রাণীগুলোর সেবা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আর্থিক সংকটই বড় সমস্যা। যতদিন আমরা চালাতে পারি চালাবো। মানুষই বা কতদিন দেবে। সরকার যদি আর্থিক সহযোগিতা না দেয় তবে চালানো সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন: অবৈধ করাতকলে উজাড় হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল 

এই পশুপাখি সেবাশ্রম পরিচালনা ছাড়াও একটি পরিচয় আছে সিতেশ রঞ্জন দেবের। তিনি বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান।

jagonews24সাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর জায়গা হয় সেখানে

সিতেশ বাবু জাগো নিউজকে বলেন, এক সময় এই এলাকায় অনুমতি নিয়ে প্রাণীদ শিকার করা হতো। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে একজন ১৫টি পাখি শিকার করতে পারতেন। ধীরে ধীরে মানুষ বাড়ছে, বন কমে গেছে, প্রাণীও কমে গেছে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে এখন প্রয়োজন সংরক্ষণের। তবে সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। প্রাণীদের খাবার নেই। আবার মানুষের চেয়ে প্রাণীদের খাবার বেশি লাগে।

তিনি বলেন, সেবাশ্রমটির খরচ অনেক বেড়েছে। মানুষের কিছু সহযোগিতা পাই। কিন্তু সবকিছুর দাম বাড়ায় তা দিয়ে আর চলছে না। তাই স্থায়ী কোনো সহযোগিতা বা অনুদান না পেলে সেবাশ্রমটির কোনো ভবিষ্যৎ দেখছি না। বন বিভাগকে সঙ্গে নিয়ে বনেই পশুপাখি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

আরএসএম/ইএ/এসএইচএস/জিকেএস

এক সময় এই এলাকায় অনুমতি নিয়ে প্রাণীদের শিকার করা হতো। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে একজন ১৫টি পাখি শিকার করতে পারতেন। ধীরে ধীরে মানুষ বাড়ছে, বন কমে গেছে, প্রাণীও কমে গেছে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে এখন প্রয়োজন সংরক্ষণের।

আমাদের এলাকায় অনেক সাপ আছে। এগুলো অনেক সময় ধরতে যেতে হয়। কিন্তু জেলায় সাপের কোনো ভ্যাকসিন নেই। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ থাকবে না।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।