ভালুকের থাবা থেকে বেঁচে দ্বিতীয় জীবনে সিতেশ বাবু

রাসেল মাহমুদ
রাসেল মাহমুদ রাসেল মাহমুদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:০৩ এএম, ০৭ অক্টোবর ২০২২

১৯৯১ সালের জানুয়ারি। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ধলই ভেলীর পাত্রখলা চা বাগানের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কিছু মানুষ আসেন সিতেশ রঞ্জন দেবের কাছে। বন্য শূকর তাদের জমির ফসল নষ্ট করে ফেলছে। শূকরের হাত থেকে ফসল রক্ষার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। এ কারণে শূকরের হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য দ্বারস্থ হন সিতেশ বাবুর। ঘটনা বিস্তারিত শুনে শূকরের উৎপাত থেকে ফসল রক্ষার সিদ্ধান্ত নেন সিতেশ বাবু।

১৪ জানুয়ারি ভোরবেলা ঘন কুয়াশায় ঢাকা পাত্রখলা চা বাগানের নলখাগড়ার বনে কাঁধে বন্ধুক নিয়ে ছুটে যান সিতেশ বাবু। চা বাগানের কয়েকজন শ্রমিককে সঙ্গে নিয়ে খুঁজতে থাকেন বন্য শূকর। প্রখর দৃষ্টি রেখে সামনে এগোতে এগোতে কখন যে শ্রমিকদের থেকে অনেক দূরে চলে যান টেরই পাননি তিনি। সমান্তরাল পথে চলতে চলতে হঠাৎ অনুভব করেন উঁচু কোনো কিছুতে পা ফেলেছেন। আর পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সেটি তাকে ফেলে দেয়। সেই মুহূর্তে হঠাৎ এক ভালুক সিতেশ বাবুর মুখের এক পাশে থাবা বসিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।

প্রাণে বাঁচতে তৎক্ষণাৎ এক হাতে থাকা বন্দুক দিয়ে ভালুকটি লক্ষ করে গুলি করেন গুরুতর আহত সিতেশ বাবু। গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ভালুকটি, একপর্যায়ে মৃতুও হয়। সেসময় সিতেশ বাবুর ওপর ভালুকের আক্রমণের খবর জানতে না পারলেও গুলির শব্দে তার সঙ্গে যাওয়া শ্রমিকরা ছুটে আসেন। মৃত ভালুকের পাশে গুরুতর আহত অবস্থায় তারা দেখতে পান সিতেশ বাবুকে। তার এক চোখ, নাক ও মুখের একাংশ পুরোটাই তুলে নেয় ভালুকটি।

পরে গুরুতর আহত সিতেশ বাবুকে পাত্রখলা চা বাগানের ব্যবস্থাপকের গাড়িতে হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থা বেশি গুরুতর হওয়ায় সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। পরে পঙ্গু হাসপাতাল থেকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হয়। এরপর নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের কলকাতায়।

চিকিৎসকদের প্রাণান্তকর চেষ্টা ও বন্ধুদের সহায়তায় প্রাণে বেঁচে যান সিতেশ বাবু। তবে ফিরে পাননি মুখের আগের অবয়ব। সাতবার অপারেশন আর মুখে প্লাস্টিক সার্জারি শেষে এখন এক চোখ, মুখে কৃত্রিম দাঁত ও নাকের একটু ছিদ্র দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে বেঁচে আছেন তিনি।

সম্প্রতি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার একমাত্র চিড়িয়াখানার প্রতিষ্ঠাতা সিতেশ রঞ্জন দেব শ্রীমঙ্গল শহরে নিজ বাড়ির বৈঠক ঘরে বসে জীবনের এমন রোমহর্ষক ঘটনার কথা জানান জাগো নিউজকে।

সিতেশ বাবু জানান, বাবা শ্রীশ দেব ছিলেন শৌখিন বন্যপ্রাণী সেবক। আহত ও অসুস্থ বিভিন্ন প্রাণী ধরে বাড়িতে নিয়ে আসতেন, সেগুলোর যত্ন করতেন। ১৯৬২ সাল থেকেই বাবা শ্রীশ দেব প্রাণীসেবা শুরু করেন। প্রাণীর প্রতি বাবার সেই ভালোবাসা ও সেবা দেখে ছোট সিতেশ বাবুর মধ্যেও বন্যপ্রাণীর প্রতি ভালোবাসার জন্ম হয়। সেই ভালোবাসা তার জীবনে বড় ক্ষতি নিয়ে এলেও এখনো প্রাণীসেবা করে যাচ্ছেন। ৭৪ বছর বয়সী সিতেশ বাবু নিজ উদ্যোগে অসুস্থ বন্যপ্রাণীর সেবা ও লালন-পালনের জন্য গড়ে তুলেছেন চিড়িয়াখানা। এসব প্রাণীর সেবা ও লালন-পালন শেষে আবার বনে অবমুক্ত করেন তিনি।

সিতেশ দেব জাগো নিউজকে বলেন, ভালুকের হাত থেকে বেঁচে দ্বিতীয় জীবন পেয়েছি। আরও ৩৩ বছর বাঁচবো, তা কেউ ভাবেনি। সবাই বলতো কিছুদিন বাঁচবো। ভালুকের আক্রমণের শিকার হয়েও প্রাণীর প্রতি এখনো এমন ভালোবাসা ও সেবার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি নিজে প্রাণীর কাছে গিয়েছি। তারা তো আমাকে এসে আক্রমণ করেনি। ভুলটা আমার হয়েছে। তাই আহত প্রাণীগুলোকে কেন আমি সেবা করবো না? যদি বন্ধই করে দিতাম তাহলে এতদিনে যেসব প্রাণী সেবা পেয়েছে, তারা সেটা পেতো না।

১৯৭১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গড়ে তোলা হয় সিতেশ রঞ্জন দেবের পশুপাখি সেবাশ্রম। হরিণ, ভালুক, হনুমান, বানরসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী সেবা দেওয়া হয় সেবাশ্রমটিতে। অনেক সময় নানা প্রজাতির পাখিরও ঠাঁই হয় সেখানে। একসময় লোকমুখে পরিচিতি পেয়ে যায় ‘সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা’ হিসেবে।

ভালুকের আক্রমণে আহত হওয়ার পর আর্থিক কারণে অর্থ সংকটে প্রাণীদের খাবার দিতে পারছিলেন না তার ছেলেরা। তাই এটা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু গণমাধ্যমে বন্ধের খবর প্রচার হলে এলাকার বিত্তবানরা কিছু সহযোগিতা করেন। পরে ২০০৯ সালে সেবাশ্রমটি শহর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সিতেশ রঞ্জন দেবের মৎস্য খামার ‘রূপসপুর খামারবাড়ি’তে স্থানান্তর করা হয়। ১ দশমিক ৮০ একর এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠে ‘সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা’।

সিতেশ বাবু বলেন, সেবাশ্রমটির খরচ অনেক বেড়ে গেছে। মানুষের কিছু সহযোগিতা পাই। কিন্তু সবকিছুর দাম বাড়ায় তা দিয়ে আর চলছে না। তাই স্থায়ী কোনো সহযোগিতা বা অনুদান না পেলে সেবাশ্রমটির কোনো ভবিষ্যৎ  দেখছি না। বন বিভাগকে সঙ্গে নিয়ে বনেই পশুপাখি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

আরএসএম/ইএ/এসএইচএস/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।