শিশুদের এখনো ‘হেলিকপ্টার ট্রমা’, ঘুমাতে দেয় না ‘মিছিল-গুলি’
ঢাকার প্রগতি সরণি সংলগ্ন নদ্দায় থাকে শিশু রাফসান। বয়স ছয়। সাড়ে পাঁচতলা বাসা। তাদের ইউনিটের সামনে খোলা ছাদ। বিমানবন্দর খুব কাছে। একটু শব্দ পেলেই ছাদ বা জানালায় ছুটে যায় প্লেন-হেলিকপ্টারের ওড়াউড়ি দেখতে।
গত ৫ আগস্টের পরের চিত্র উল্টো। হেলিকপ্টারের আওয়াজ হলেই আঁতকে ওঠে সে। মায়ের আঁচলে মুখ লুকায়। বাবাকে বাইরে যেতে দেয় না। রীতিমতো পা ধরে কান্না করে। বলে, বাইরে গেলে ওরা তোমাকে গুলি করে দেবে।
রাফসানের বাবা আরিফ আহমেদ বেসরকারি চাকরিজীবী। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় অধিকাংশ দিন অফিস করতে হয়েছে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘নদ্দা, বসুন্ধরা এলাকা প্রতিদিন আন্দোলনে উত্তাল ছিল। বাড্ডায় আমার অফিস। আমার ছেলে গুলির মতো শব্দ পেলেই দরজা বন্ধ করে দিতো, এখনো শব্দ হলেই মনে করে গুলি হচ্ছে। আমাকেও বাইরে বের হতে দিতো না। মনে করতো আমাকে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলবে। আমরা টিভি-পত্রিকায় নিউজ দেখতাম। সেও দেখতো। এটা তার মনস্তত্ত্বে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।’
দেড় বছর বয়সী আবরার আওসাফ জাহিনের মানসিক অবস্থা আরও করুণ। কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় হেলিকপ্টার থেকে গুলির ঘটনা ভোলে না সে। ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে সে এখনো হেলিকপ্টার দেখলেই বলে, গুয়ি…গুয়ি..।
এমনভাবে গুলি এলো এবং একজন লোক পড়ে মারা গেলো তা চিন্তার বাইরে। ঘটনাটি আমার ও ছেলের চোখের সামনে যেন বারবার ভাসছিল। ঘুমের মধ্যে, খেতে গেলে কিংবা একা একা থাকলে ওই গুলি লাগার ঘটনা মনে পড়ে। একমাস পর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই আমরা।– চোখের সামনে মৃত্যু দেখা একজন মা
জাহিনের মা নাদিয়া শারমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আন্দোলন চলাকালীন একদিন বিকেলে জাহিনকে নিয়ে ছাদে যাই। হঠাৎ একটি হেলিকপ্টার থেকে চারদিকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। সেই থেকে আমার বাচ্চাটি ভয় পায়। ভয়ে সে হেলিকপ্টারের নাম কিংবা শব্দ শুনলেই ভয় পেয়ে আমার কাছে লুকাতে চায়। এমনকি টেলিভিশনে হেলিকপ্টার উড়তে দেখলেও ওর চোখেমুখে ভয় কাজ করে।’
আন্দোলন চলাচলে বাড্ডা এলাকায় হেলিকপ্টার উড়ছে/জাগো নিউজ
বাবার সঙ্গে বাইরে বের হয়ে আন্দোলনকারী ও পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া সাফওয়ান বিন সাইফ। আন্দোলন দমাতে পুলিশ মুহুর্মুহু গুলি চালায়। বাবার সঙ্গে গলিতে ঢুকে কোনোরকমে নিজেদের রক্ষা করে। সেই থেকে সাইফ পুলিশ দেখলে কিংবা পুলিশের কথা শুনলেই আঁতকে ওঠে। শেষমেশ ট্রমা কাটাতে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তার বাবা সাদ বারী।
- আরও পড়ুন
- গুলিবিদ্ধ রায়হানের অস্ত্রোপচার/মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল অক্ষমতা জানালেও সফল নিউরোসায়েন্স
- ছাত্র-আন্দোলন/কাউকে চিনতে পারছেন না কলেজছাত্র ইয়াশ
- ‘আমাকে আর কেউ চাকরি দেবে না, বলবে তোর পা নেই’
২০ জুলাই রাজধানীর রায়েরবাগে আটতলা ভবনের বারান্দা থেকে মা-বাবার সঙ্গে বিক্ষোভ দেখার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় চার বছর বয়সী আবদুল আহাদ। ২৪ জুলাই নারায়ণগঞ্জে বাসার ছাদে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় রিয়া গোপ (৬)। বাসায় এসব খবরের আলোচনা শুনে শিশুরা আরও আতঙ্কগ্রস্ত হয়। শুরুতে বাচ্চাদের সামনে এসব আলোচনা করলেও পরে বাবা-মা সচেতন হন।
আন্দোলনের সময় রেডজোন খ্যাত মধ্যবাড্ডা এলাকার পাঁচ বছরের শিশু সাজিদের বাবা শফিকুল হাওলাদার বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় এ এলাকায় কদিন থেমে থেমে গুলির শব্দ পাওয়া যেত। এর মধ্যে কয়েকটি শিশুর মৃত্যুর খবর এলো। আমরা আলোচনা ও সাবধানতা অবলম্বন না করায় ছেলেও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। পরে আমরা ওর সামনে আলোচনা করা এবং নিউজ দেখা বন্ধ করে দেই। এখনো সে পুলিশ দেখলে ভয় পায়। প্রথম প্রথম স্কুলেও যেতে চাইতো না।’
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সৃষ্ট সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরা রাজপথের দখল নেয়। মধ্য জুলাই থেকে শুরু করে ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলে কারফিউ, হামলা, হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ ও রাতের আঁধারে বাসা-বাড়িতে তল্লাশি। এসব ঘটনা বড়দের পাশাপাশি শিশুদের মনস্তত্ত্বে বড় প্রভাব ফেলে। আন্দোলন পরবর্তীসময়ে শিশুদের এ অবস্থার কারণে অনেক অভিভাবক এখনো দুশ্চিন্তায়।
মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসারত শিশুদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে তারা স্বাভাবিক কাজ করতে গেলে ভয় কিংবা আতঙ্কগ্রস্ত থাকছে। পড়াশোনায় আগের মতো মনোযোগ দিতে পারছে না। পড়াশোনা করতে বসলেই জুলাই-আগস্টের বিভিন্ন গোলাগুলি কিংবা সহপাঠী মারা যাওয়ার বিষয়টি সামনে আসছে।- জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার ডা. গোলাম মোস্তফা মিলন
মানসিক চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে অস্থিরতা দেখা দিলে, সহিংসতার বিস্তার হলে নানা ধরনের অনিশ্চয়তার জন্ম হয়। এর প্রভাব শিশুদের ওপরও পড়ে, সেটা যেন সবার নজর এড়িয়ে না যায়। এমন সময়ে কীভাবে নিজেদের সন্তানদের সহায়তা করা যায়, তা বোঝাটা বাবা-মায়ের জন্য অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, তারা নিজেরাও ট্রমার মধ্যে থাকেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে হামলা, নির্যাতন ও মামলা শিক্ষার্থীদের মনের ওপর চাপ তৈরি করেছে। আন্দোলনে জড়িত না হয়েও বিপুলসংখ্যক হতাহতের ঘটনা সম্পর্কে জেনে অনেক শিশুশিক্ষার্থীও মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছে। শিশুরা সরাসরি ঘটনাস্থলে থেকে সহিংসতা দেখেছে, কারও কাছ থেকে ভীতিকর অভিজ্ঞতা শুনেছে, গণমাধ্যম থেকে খবর জেনে সেসব চিত্র কল্পনা করেছে, গুরুতর আঘাত ও মৃত্যুর কথা ভেবেছে। ফলে তাদের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক, দুঃখবোধ, অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা, চমকে ওঠা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, অসহায়ত্ববোধ করার মতো আচরণিক প্রকাশ দেখা গেছে।
জাগো নিউজ গ্রাফিক্স
রাজধানীর মগবাজার এলাকায় গত ৪ আগস্ট স্কুলপড়ুয়া নাফিস হাসান সৈকত বাসার নিচে হাঁটছিল। বাসার বারান্দায় ছিলেন তার মা। হঠাৎ তার পাশে একজন মধ্যবয়সী লোকের মাথায় গুলি লেগে সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যান। গুলি লাগার দৃশ্যটি মা-ছেলে দেখে ভীত হয়ে পড়েন। পরে মানসিক সমস্যা দেখা দেওয়ায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
সৈকতের মা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এমনভাবে গুলি এলো এবং একজন লোক পড়ে মারা গেলো তা চিন্তার বাইরে। ঘটনাটি আমার ও ছেলের চোখের সামনে যেন বারবার ভাসছিল। ঘুমের মধ্যে, খেতে গেলে কিংবা একা একা থাকলে ওই গুলি লাগার ঘটনা মনে পড়ে। স্বাভাবিক কাজ করতে পারছিলাম না। একমাস পর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই আমরা। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলছি এখন।’
শুধু সৈকত ও তার মা নন, আরও অনেক শিশু-কিশোর এখনো জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে।
সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, কেবিনে মন ভার করে শুয়ে আছে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী রিয়াদ হাসান (১৭)। সংবাদকর্মী পরিচয় দিতেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে জাগো নিউজকে বলে, ‘গত ৪ আগস্ট সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার সামনে সারা শরীরে গুলি লাগে ১৬টি। এর মধ্যে বাম চোখেই লেগেছিল তিনটি গুলি, যা গত সাড়ে তিন মাসেও বের করা হয়নি। এরই মধ্যে দুটি অপারেশন হয়েছে, সামনে আরেকটি অপারেশন আছে।’
‘সব সময় মাথার ভেতর ব্যথা করে। ঘুম হয় না। গুলি লাগার পর ভয়ে হার্টের সমস্যা ধরা পড়েছে। শরীরের এই ক্ষত সারছে না কিন্তু মানসিক সমস্যা লেগেই আছে। ভালোভাবে ঘুম, খাওয়া-দাওয়া কিংবা অন্য কাজ করতে পারি না।’ বলছিল রিয়াদ।
আন্দোলনে আহত শিশু-কিশোররা সবাই এক ধরনের ট্রমার মধ্যে আছে। ট্রমা এক ধরনের মনোদৈহিক চাপজনিত বিষয়। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়াবহ ঘটনার অভিজ্ঞতা যা প্রত্যক্ষদর্শীর মনে চাপ সৃষ্টি করতে পারে কিংবা তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হতে পারে। অন্যের ট্রমার গল্প শুনেও আরেকজন ট্রমাটাইজ হতে পারে।
- আরও পড়ুন
- আন্দোলনে হাত-পা হারানো তরুণরা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায়
- পুলিশ ৬টা গুলি করে, এরপর ৩ তলায় পড়ে যাই
- যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন চোখে গুলি লেগে আহতরা
চিকিৎসকদের মতে, কেউ ট্রমায় ভুগলে আবেগ খুব বেশি ওঠা-নামা করবে। মানসিক অনুভূতি নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয়। নিজের আন্তঃসম্পর্ক বজায় রাখতে সমস্যা হয়। ঘুমের ব্যাঘাত, শ্বাস নিতে কষ্ট, মস্তিষ্কের পরিবর্তন, ইচ্ছা করলেও নিজেকে ঠিক রেখে স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যেতে পারছে না এমন হতে পারে। প্যানিক অ্যাটাক ও কিছুক্ষণ পর পর চমকে ওঠার ঘটনাও ঘটে।
আন্দোলনচলাকালীন আহত এক শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে/সংগৃহীত
গুলিবিদ্ধ শিশু-কিশোররা ঘুমের সমস্যা-বিষণ্নতায় ভুগছেন
আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের নিয়ে সম্প্রতি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সংক্রান্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সুপার স্পেশাল হাসপাতাল একটি গবেষণা চালিয়েছে। ২৬ জন রোগীর ওপর গবেষণাটি চালানো হয়। এদের সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। বয়স ১২-৩৩ বছরের মধ্যে। প্রাইমারিতে পড়াশোনা ১৩ জন, মাধ্যমিকে ১০ জন ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করা দুজন।
একসঙ্গে আমরা দুজন পড়াশোনা করছিলাম টেবিলে। হঠাৎ একটি গুলি আমার কাঁধে লেগে সামিরের মাথায় ঢুকলে মারা যায় সে। এরপর থেকে আমার ওই টেবিলে পড়াশোনা করতে ভয় লাগে। মনে হয় আবার যদি গুলি এসে আমি মারা যাই!- নিহত ভাতিজার সঙ্গে একই গুলিতে আহত মশিউর
গবেষণায় দেখা যায়, ৪২ শতাংশ রোগী দুশ্চিন্তাগত, ৫৩ শতাংশের ঘুমের সমস্যা, বিষণ্নতায় ভুগছেন ১১ শতাংশ এবং ১১ শতাংশ রোগীর খিটখিটে মেজাজ।
৮৯ শতাংশ শিশুর মৃত্যু গুলিতে
দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনের সময় ৬৫ জনেরও বেশি শিশুর মৃত্যু হওয়ার তথ্য দেয় জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফ।
৫ আগস্ট পরবর্তীসময়ে এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানান শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতাবিষয়ক জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি নাজাত মাল্লা মজিদ।
বিবৃতিতে নাজাত মাল্লা মজিদ বলেন, সবশেষ যাচাই করা তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের ‘শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ’ দমনে ৬৫ জনেরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের তরুণ ও শিশুরা সাম্প্রতিক বিক্ষোভের অগ্রভাগে ছিল। তারা অনেক কিছু অর্জন করেছে কিন্তু এজন্য তারা বিশাল মূল্যও দিয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব এবং মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কাছে তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সহিংসতার সব ধরনের ঘটনার পূর্ণ, স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের দাবি রেখেছেন।
দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি তথ্য বলছে, নিহত ৬৫ জন শিশুর মধ্যে ০-১০ বছর বয়সী ৫ জন, ১১-১৫ বছর বয়সী ২৩ জন ও ১৬-১৭ বছর বয়সী ৩৭ জন।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ সম্প্রতি জানান, জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে মোট ১০৫ জন শিশু মারা গেছে।
তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেন, গণ অভ্যুত্থানে ১০৫ জন শিশু মারা গেছে। এটি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ চূড়ান্ত করেছে, আমরা সেখান থেকে তথ্য নিয়ে এসেছি। শিশু হিসেবে ১৮ বছর পর্যন্ত বয়স ধরে এ তালিকা করা হয়েছে।
আন্দোলনে আহত এক কিশোর এখনো মানসিক ও শারীরিক চিকিৎসা নিচ্ছে হাসপাতালে/জাগো নিউজ
শিশু আইন ২০১৩ অনুসারে, ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু বলা হয়। হাসপাতালের নথি ও স্বজনদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৭৯ জন শিশু-কিশোরের শরীরে ছররা ও প্রাণঘাতী গুলির চিহ্ন ছিল। স্থাপনা ও যানবাহনে দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা গেছে ৯ শিশু-কিশোর। একটি শিশুর মৃত্যু সাউন্ড গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে হয়েছে।
নিহত শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী শিশুটির নাম আবদুল আহাদ, যার বয়স ছিল চার বছর। ২০ জুলাই রাজধানীর রায়েরবাগে আটতলা ভবনের বারান্দা থেকে মা-বাবার সঙ্গে বিক্ষোভ দেখার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় শিশুটি। নিহত শিশু-কিশোরদের মধ্যে দুটি মেয়েশিশুও রয়েছে। তারা হলো- নারায়ণগঞ্জের রিয়া গোপ (৬) ও উত্তরার নাঈমা সুলতানা (১৫)। রিয়া বাসার ছাদে ও নাঈমা বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন সময়ে শিশুকে নিরাপদ রাখতে শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা এবং নিরাপদ পরিবেশের নিশ্চয়তা দিতে হবে শিশুদের (১০ বছরের কম বয়সী)। যে কোনো পরিস্থিতি ছোট করে সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা জরুরি। বাইরে কী ঘটছে জানতে চাইলে, কিছু না বলে এড়িয়ে না গিয়ে বলা দরকার- বাইরে কিছু মানুষ দুষ্টুদের ওপর রেগে গেছে, রাগ কমলে আমরা বের হবো।
মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসকের মতে, আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীদের ‘একিউট স্ট্রেস ডিজ-অর্ডার’ এবং পরবর্তীসময়ে ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডার’ বা ‘পিটিএসডি’ হতে পারে। সহিংসতার ভয়ংকর স্মৃতি ফিরে ফিরে আসতে পারে।
আন্দোলনে নিহতদের ভাই-বোন-প্রতিবেশীরাও ট্রমায়
গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুর-১৪ নম্বর স্টাফ কোয়ার্টারে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে সাফকাত সামির (১১) ও তার চাচা মশিউর রহমান (১৬) বাসার বেডরুমে জানালার পাশে টেবিলে বসে পড়াশোনা করছিল। এ সময় দুষ্কৃতকারীর একটি গুলি মশিউরের ডান কাঁধ ভেদ করে সামিরের ডান চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। সামিরকে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আর মশিউরকে ১৪টি সেলাই দেওয়া হয়।
- আরও পড়ুন
- ফুসফুসে ক্ষত, হাসপাতালে ধুঁকছেন আহতরা
- পরিচয়পত্রটি তার পকেটে ছিল রক্তে ভেজা
- ১৭ জুলাই সাঈদের ছবি পোস্ট, দুদিন পর নিজেই গুলিতে নিহত হন মামুন
একই গুলিতে আহত মশিউর জাগো নিউজকে বলে, ‘একসঙ্গে আমরা দুজন পড়াশোনা করছিলাম টেবিলে। হঠাৎ একটি গুলি আমার কাঁধে লেগে সামিরের মাথায় ঢুকলে মারা যায় সে। এরপর থেকে আমার ওই টেবিলে পড়াশোনা করতে ভয় লাগে। মনে হয় আবার যদি গুলি এসে আমি মারা যাই!’
এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি স্নিগ্ধা-স্বচ্ছ
১২ বছর বয়সী স্নিগ্ধা (ছদ্মনাম)। সেদিন ছিল ছুটির দিন। মা-বাবার সঙ্গে ছোট ভাইকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল তার। কিছু বই কিনবে নিজের জন্য আর ছোট ভাইটির জন্য। কিন্তু শুক্রবার দুপুরে যা শুরু হলো, তাতে বেড়াতে যাওয়া তো দূরের কথা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলো দুই ভাই-বোন। চারদিকে গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, হইচই আর ভাঙচুরের শব্দ।
সংবাদ মাধ্যমে খবর দেখছেন বাবা-মা। মোবাইলেও নেটওয়ার্ক নেই। ফুফাতো ভাইয়ের এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়েছে। সব স্কুল-কলেজ বন্ধ। সব মিলিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত এক ভয়ানক পরিস্থিতি। খবর এলো পাশের বাসার এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়া একজন মারা গেছে পুলিশের গুলিতে।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে আহত শিশুদের শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। অন্যথায় শারীরিক ক্ষত সেরে উঠে বাসায় গেলে অনেকেই স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরতে পারবে না। নতুন করে যাতে কোনো জটিলতা তৈরি না হয় তাই আগে থেকেই চিকিৎসারত শিশুদের প্রয়োজন অনুযায়ী মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া দরকার।- শিক্ষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক
বাবা-মায়ের সঙ্গে এসব ঘটনার সাক্ষী স্নিগ্ধা-স্বচ্ছ। এ ঘটনার পর থেকে তারা বাইরে যাওয়ার কথা বলতেও ভয় পায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাদের বাবা জাগো নিউজকে বলেন, জুলাইয়ের ২০-২১ তারিখের দিকে বাসার পাশের গোলাগুলি, মিছিল, হইচই আর ভাঙচুরের ঘটনা এখনো ভুলতে পারেনি দুই ভাই-বোন। মৃত্যুর খবর তাদের আরও বেশি আতঙ্কিত করেছিল। এর পর থেকে তারা বাইরে যাওয়ার কথা বলে না। কোনো ভিড়ের মধ্যে যেতে চায় না। টিভিতে নিউজ দেখতে গেলেও সরিয়ে দিতে বলে। তাদের ট্রমা এখনো কাটেনি।
টেলিভিশন-ফেসবুকে ভিডিও দেখেও অনেকে ট্রমাটাইজড
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার ডা. গোলাম মোস্তফা মিলন জাগো নিউজকে বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা ট্রমাটাইজড ছিলেন। আমাদের হাসপাতালে এমন কিছু রোগী এখনো চিকিৎসা নিতে আসেন যারা মুক্তিযোদ্ধা। ৫৩ বছর পরেও এই মুক্তিযোদ্ধারা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডারের রোগী। ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডার’ বা ‘পিটিএসডি’ কয়েক মাস থেকে শুরু করে কয়েক বছর এমনকি অনেক বছর গ্যাপের পরেও শুরু হতে পারে। এটি ভয়ংকর একটি বিষয়।’
‘এটি শিশু ও নারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার জন্য আলাদা ইউনিট রয়েছে আমাদের হাসপাতালে। সরাসরি হামলার ঘটনা না দেখলেও মানুষের কাছ থেকে, শুনে কিংবা টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সহিংসতার ভিডিও দেখেও অনেকে ট্রমার মধ্যে রয়েছে। এমন রোগীও পেয়েছি আমরা। এদের মধ্যে বড় একটি অংশ ১৮ বছরের কম বয়সী বা শিশু-কিশোর।’
তিনি বলেন, ‘পিটিএসডিতে আক্রান্ত রোগীরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হন- আতঙ্কগ্রস্ত হওয়া, চমকে ওঠা, ফ্ল্যাশব্যাক, ঘুমের মধ্যে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখা, ভীতিকর অবস্থা এমনকি আত্মহত্যার চেষ্টাও করতে পারে কেউ কেউ। ধীরে ধীরে এই রোগীর সংখ্যা বাড়বে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতরা শারীরিকভাবে অসুস্থতার পাশাপাশি মানসিকভাবেও বেশ অসুস্থ। পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডারে (পিটিএসডি) বয়স্করা আক্রান্ত হলে তারা বোঝাতে পারবে তার কী কী সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু শিশুরা এ রোগে আক্রান্ত হলে ভয় পাওয়া, ভয়ংকর স্বপ্ন দেখা, কষ্ট পাওয়া, মন খারাপ অথবা আক্রমণাত্মক আচরণ- এসব বোঝাতে পারে না। শিশুদের আচরণগত পরিবর্তনে প্রকাশ পায়।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার ডা. গোলাম মোস্তফা মিলন বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ভয়াবহতা পর্যবেক্ষণ করে মানসিক ট্রমার শিকার হয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩০ জন। চারজন এখনো চিকিৎসাধীন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একটি টিম অন্য হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের কাউন্সেলিং করছে। কয়েকদিন ধরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন এবং জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে একটি টিম শিশুদের কাউন্সেলিং শুরু করেছে।
আন্দোলনে আহত এক কিশোর এখনো মানসিক ও শারীরিক চিকিৎসা নিচ্ছে হাসপাতালে/জাগো নিউজ
কী ধরনের সমস্যা পাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসারত শিশুদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে তারা স্বাভাবিক কাজ করতে গেলে ভয় কিংবা আতঙ্কগ্রস্ত থাকছে। অর্থাৎ তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্ন ঘটছে। এছাড়া আরেকটি সমস্যা হচ্ছে পড়াশোনায় আগের মতো মনোযোগ দিতে পারছে না। পড়াশোনা করতে বসলেই জুলাই-আগস্টের বিভিন্ন গোলাগুলি কিংবা সহপাঠী মারা যাওয়ার বিষয়টি সামনে আসছে।’
তিনি বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পাবনা মানসিক হাসপাতালসহ জেলা পর্যায়ের চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোয় বেশকিছু রোগী রয়েছেন, যারা অভ্যুত্থানে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন।
মাথার ভেতরে মাইক্রো চিপ, মনে করে ৭ম শ্রেণি পড়ুয়া কিশোর
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জোবায়ের মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘আন্দোলনে আহত অনেক শিক্ষার্থী শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও এখনো মানসিক ট্রমায় ভুগছেন। আমি একজন কিশোরকে চিকিৎসা দিয়েছি, যার শরীর থেকে গুলি বের করা হলেও সে মনে করে তার শরীরে গুলির মাধ্যমে একটি মাইক্রো চিপ প্রবেশ করেছে, যার মাধ্যমে তাকে ট্র্যাক করা হচ্ছে। যদিও বিষয়টি ভিত্তিহীন। সে মানসিক সমস্যায় ভুগছে। আমরা তাকে সহযোগিতা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তার মতো আহতদের মানসিক স্বাস্থ্য হুমকির মুখে। তারা মিছিলের আওয়াজ শোনে, ঘুমাতে পারে না, ভয় পায়। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০১৮-১৯ এর জরিপ বলছে, লঘু থেকে গুরুতর মাত্রার মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা (প্রাপ্তবয়স্ক) ১৭ শতাংশ। এর মধ্যে নারী ১৯ ও পুরুষ ১৫ শতাংশ। এছাড়া ১৮ বছরের নিচের জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। বিপরীতে মনোচিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী ও অন্য প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর সংখ্যা এক হাজারের নিচে। ফলে সব বয়সীর ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশের বেশি ট্রিটমেন্ট গ্যাপ রয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বাইরে দেশের ৯২ শতাংশ মানুষ
দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন আছে এমন মানুষের ৯২ শতাংশই এই সেবার বাইরে। মাত্র আট শতাংশ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছেন। বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সোসাইটির (বিসিপিএস) সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার এ তথ্য জানান।
এছাড়া শিশু-তরুণদের মধ্যে মাত্র ছয় শতাংশ মানসিক চিকিৎসা নিতে পারছেন বলেও জানান তিনি।
ড. মুহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘বাংলাদেশে যারা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন তাদের সেবা দেওয়া জরুরি। আমরা দেখতে পাই মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন আছে এমন মানুষের মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ সেবা নিতে পারছেন, ৯২ শতাংশই মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বাইরে। একইসঙ্গে যদি শিশু-তরুণদের চিত্র দেখি তাদের মধ্যে চিকিৎসা ঘাটতির পরিমাণ ৯৪ শতাংশ, মাত্র ৬ শতাংশ চিকিৎসা নিতে পারছেন।’
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার রোগীর বাজেট মাত্র ০.৫ শতাংশ
নিউরোসাইকোলজি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এমএম জালাল উদ্দীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার রোগী সার্বিক স্বাস্থ্যখাতের ১৩-১৪ শতাংশ। অথচ এর বিপরীতে বাজেট মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। সুতরাং আমাদের রিসোর্সের যেমন ঘাটতি আছে আমাদের বাজেটেরও ঘাটতি আছে।
প্রয়োজন ৫০ হাজারের অধিক সাইকোলজিস্ট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও বিসিপিএসের সাধারণ সম্পাদক ড. মো. শাহানূর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে ১৮ দশমিক ১৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আছে। এছাড়া ১২ দশমিক ৬ শতাংশ শিশু-কিশোর মানসিক সমস্যায় ভুগছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৫০০-৬০০ জন সাইকোলজিস্ট আছেন যারা কাজ করছেন, যেখানে প্রয়োজন ৫০ হাজারের অধিক।’
আতঙ্ক আতঙ্ক বাড়ায়, সাহস বাড়ায় সাহস
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের যে নৃশংসতা তাতে শিশুসহ যে কোনো বয়সের মানুষের মধ্যে ট্রমা আসতে পারে। শিশুদের মনে তাৎক্ষণিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শিশুদের মানসিক চাপ, হতাশা, ভীতি ও আতঙ্ক তৈরি হয়। এছাড়া ঘুমের সমস্যা, বিছানায় প্রস্রাব করা।’
জুলাই-আগস্টে শহীদের পরিবারের জন্য পাঁচ লাখ টাকা ও আহতদের জন্য এক লাখ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। আহত শিশু যারা আছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্যও আমাদের ফাউন্ডেশন কাজ করছে। শাহবাগে ফরম জমা নেওয়া শেষ হলে আহত শিশুদের মধ্যে বাছাই করে বিশেষভাবে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার দিকে নজর দেওয়া হবে।- জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের মিডিয়া অ্যান্ড পিআর এক্সিকিউটিভ জাহিদ হোসাইন
‘দীর্ঘ যে প্রতিক্রিয়া তা হলো পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডার (পিটিএসডি)। এটি ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে, দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্ণতা এবং দীর্ঘমেয়াদি একজন শিশুকে নিরাপত্তাহীনতার দিকে ধাবিত করে। এই সময়ের মধ্যে কোনো শিশুর মধ্যে ট্রমা রিলেটেড লক্ষণ দেখা দিলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া উচিত। পারিবারিকভাবে, স্কুলভিত্তিক ও সমাজভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে এখন পরিস্থিতি নিরাপদ, স্বাভাবিক কাজ করো। অর্থাৎ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।’
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলন/জাগো নিউজ
- আরও পড়ুন
- ‘দুষ্কৃতকারীর গুলিতে’ পড়ার টেবিলেই লুটিয়ে পড়ে ছোট্ট সামির
- মায়ের গর্ভ থেকেই বৈষম্যের শিকার কন্যাশিশুরা
- কর্মক্ষেত্রে প্রতি পাঁচজনে একজনের মানসিক সমস্যা
আতঙ্ক আতঙ্ক বাড়ায়, সাহস সাহস বাড়ায়। অভিভাবকরা আতঙ্কিত হওয়ায় সেটা শিশুদের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে উল্লেখ করে ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘শিশুরা অভিভাবকদের আতঙ্কের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছে। এই এক মাসে তারা এমন অনেক শব্দ শুনেছে, যেগুলোর সঙ্গে তার নতুন পরিচয় হলো। সে জায়গা থেকে তাকে বের করে আনতে হবে। তাকে তার আগের জায়গা ফিরিয়ে দিতে হবে। দীর্ঘসময় আতঙ্ক নিয়ে ঘরে বসে থাকায় শিশুর ভয় বেড়েছে। এখন সময়-সুযোগ হলেই তাদের বাইরের পরিবেশে নিয়ে স্বাভাবিকীকরণ করতে হবে।’
ট্রমা থেকে উত্তরণের উপায়
ঢাকা আহছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য সেক্টরের সিনিয়র সাইকোলজিস্ট রাখী গাঙ্গুলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে বেশিরভাগ শিশু ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি নিহত পরিবারে থাকা শিশুদের একটি বড় অংশ এই ট্রমার মধ্যে আছে। একই ঘটনা সমানভাবে সবার প্রভাব ফেলবে তা নয়। ঘটনার চেয়ে ঘটনার প্রভাব ব্যক্তি কীভাবে প্রত্যক্ষ করছে সেটা বুঝতে হবে। সবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এক নয়। বয়স্কদের চেয়ে শিশুদের ট্রমা বেশি প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে শিশুটির মা-বাবা এবং আশপাশের মানুষগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
তিনি বলেন, ‘শিশুকে কথা বলার সুযোগ দিন। তারা কী অনুভব করছে, তাদের কষ্টগুলো কী, তা শোনার চেষ্টা করুন। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে পেশাদার মনোবিজ্ঞানীর সহায়তা নিন। তারা শিশুদের ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করতে পারবেন। শিশুদের জন্য একটি নিয়মিত রুটিন তৈরি করুন। এটি তাদের নিরাপত্তার অনুভূতি বাড়িয়ে তুলতে পারে। পরিবারকে একসঙ্গে সময় কাটাতে এবং একে অপরকে সহায়তা করতে উৎসাহিত করুন। এটি শিশুর মনের ভার লাঘব করতে সাহায্য করবে।’
ঢাকা আহছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য সেক্টরের সিনিয়র সাইকোলজিস্ট রাখী গাঙ্গুলী
‘শিশুরা খেলা এবং বিনোদনের মাধ্যমে তাদের আবেগ প্রকাশ করতে পারে। তাদের খেলা ও সৃজনশীল কাজে উৎসাহিত করুন। ট্রমা থেকে সুস্থ হওয়া একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। ধৈর্য ধরে শিশুর পাশে থাকুন এবং তাদের বুঝতে সাহায্য করুন। শিশুর অতীত অভিজ্ঞতা ভুলিয়ে স্মৃতিতে নতুন আনন্দময় অভিজ্ঞতার সংযোজন ঘটাতে হবে। আমাদের প্রাণের স্পন্দন, আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের শিশুরা। তাদের প্রতি সদয় হই, আগামীর বাংলাদেশ হোক শিশুবান্ধব বাংলাদেশ।’
সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে
কেয়ার বাংলাদেশের নারী ও কন্যাশিশু ক্ষমতায়ন কর্মসূচির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক রওনক জাহান জাগো নিউজকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে মানসিক রোগে আক্রান্ত শিশুদের সাইকো সোশ্যাল সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে। এই ট্রমার তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে। একজন শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। এক্ষেত্রে সরকার, বেসরকারি সংগঠন, সমাজ ও অভিভাকদের এগিয়ে আসা উচিত। বাসায় এক্ষেত্রে সুস্থ-সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং তাদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে আহত শিশুদের শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। অন্যথায় শারীরিক ক্ষত সেরে উঠে বাসায় গেলে অনেকেই স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরতে পারবে না। নতুন করে যাতে কোনো জটিলতা তৈরি না হয় তাই আগে থেকেই চিকিৎসারত শিশুদের প্রয়োজন অনুযায়ী মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া দরকার।’
পাঠ্যসূচিতে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অধ্যায় সংযোজনের প্রস্তাব
মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানো ও ধারণা দিতে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর একটি অধ্যায় সংযোজনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইক্রিয়াট্রির (বিএপি) আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. আব্দুল মোত্তালিব জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ধারণা দিতে একটি অধ্যায় সংযোজনের প্রস্তাব করছি। তাহলে ক্রমবর্ধমান এ সমস্যার কার্যকর সমাধানে আশানুরূপ ফল আসবে। সেটা যে কোনো দুর্যোগের কারণে ঘটা বিষয়ে।
গুলিতে ঝাঁঝরা সিঁড়ির রেলিং/সংগৃহীত
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. কামরুল হাসান বলেন, ‘সুন্দর আগামী গড়ে তুলতে আন্দোলনে আহত ও স্বজনদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কাউন্সেলিং চালাতে হবে।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের বিশেষ সহকারী মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘শিশু-কিশোরসহ অন্য আহতদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরির অন্যতম কারণ মানসিক ট্রমা (আঘাত)। এই মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি এ পর্যন্ত খুব ভালোভাবে দেখা হয়েছে বলে আমরা মনে করছি না। আমরা স্বীকার করছি, বিষয়টি আমরা যথেষ্ট সফলতার সঙ্গে পেরে উঠিনি। এজন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের পাশাপাশি দেশের সরকারি-বেসরকারি যারা এই সেবার সঙ্গে আছেন, তাদের যুক্ত করে একটি নেটওয়ার্ক করা হবে।’
শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষ নজর দেওয়া হবে
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের মিডিয়া অ্যান্ড পিআর এক্সিকিউটিভ জাহিদ হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে শহীদের পরিবারের জন্য পাঁচ লাখ টাকা ও আহতদের জন্য এক লাখ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। আহত শিশু যারা আছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্যও আমাদের ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে। শাহবাগে ফাউন্ডেশন স্পেশাল সেলের একটি অফিস আছে সেখানে আহতদের ফরম জমা হচ্ছে। ফরম জমা নেওয়া শেষ হলে আহত শিশুদের মধ্যে বাছাই করে বিশেষভাবে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার দিকে নজর দেওয়া হবে।’
শিশুদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেওয়া উচিত
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক সঞ্জয় উইজে সেকেরা বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার, ইউনিসেফের অংশীদার ও তরুণদের জন্য কাজ করছে, এমন সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে শিশুদের একত্র হওয়া ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। শিশু ও তরুণরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তারা যখন কোনো কিছু নিয়ে সোচ্চার হন, তখন তাদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেওয়া উচিত বলে মনে করে ইউনিসেফ।’
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক সঞ্জয় উইজে সেকেরা
ইউনিসেফের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশে জুলাই মাসে বিক্ষোভের সময় শিশুদের এমন মৃত্যু ভয়ানক ক্ষতি। তাছাড়া অনেক শিশু আহত হয়েছে। অনেককে আটক করা হয়েছে। ইউনিসেফ সব ধরনের সহিংসতার নিন্দা জানাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, বাংলাদেশের স্বাক্ষর করা জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ ও আটক করা হলে শিশুদের ওপর যে প্রভাব পড়ে, তা নিয়ে গবেষণার ভিত্তিতে ইউনিসেফ শিশুদের যে কোনো ধরনের আটক বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে। যার অর্থ হলো- কোনো স্থানে শিশুদের অংশগ্রহণ বা তাদের আগের ইতিহাস, ধর্ম ও তাদের পরিবারের কর্মকাণ্ড বা মতাদর্শের জন্য শিশুদের গ্রেফতার বা আটক করা যাবে না।’
আন্দোলন চলাকালে গত ২৭ জুলাই ইউনিসেফ তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করেছিল, ‘দেশে সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় শিশুদের সুস্থতা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বিগত কয়েক দিনে ইউনিসেফ সমর্থিত শিশু হেল্পলাইন ১০৯৮ নম্বরে কল সংখ্যা শতকরা ২৫০ শতাংশ বেড়েছে। একইসঙ্গে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে শিশুদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ায় ইউনিসেফের প্রশিক্ষিত ৩০০ সমাজকর্মীকে ধন্যবাদ জানাই।’
টিটি/এএসএ/এএসএম