ইমোশনাল ইগনোরেন্স হচ্ছে আর্থিক বিপর্যয়ের নীরব খলনায়ক

সাইফুল হোসেন
সাইফুল হোসেন সাইফুল হোসেন
প্রকাশিত: ০৯:৩৬ এএম, ০৫ জুলাই ২০২৫

মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধগুলোর একটি হলো নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা। অনেকেই মনে করেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য শুধু আয় বাড়ানোই যথেষ্ট। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আপনি যতই উপার্জন করুন না কেন, যদি আবেগ নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে সেই অর্থ ধরে রাখাও কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণেই বলা হয়—আবেগজনিত অজ্ঞতা বা “ইমোশনাল ইগনোরেন্স” আর্থিক স্থিতিশীলতার এক নম্বর শত্রু।

আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি প্রতিদিন—কখন কী কিনবো, কোথায় ব্যয় করবো, কীভাবে বিনিয়োগ করবো। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তগুলো কতটা আবেগ দ্বারা চালিত আর কতটা যুক্তিবাদীভাবে চিন্তা করে নেওয়া—সেই ফারাকটাই নির্ধারণ করে দেয় আমাদের আর্থিক ভবিষ্যৎ। অনেকেই অযথা প্রতিযোগিতার কারণে ব্যয় করে ফেলেন এমন কিছু জিনিসে, যেগুলোর প্রয়োজন হয়তো ছিল না। আবার অনেকেই একটুখানি মনের খুশির জন্য ঋণে ডুবে যান, যেটা পরবর্তীতে হয় বড় একটা বোঝা।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই চিত্র আরও স্পষ্ট। ফেসবুকে বন্ধুদের নতুন গ্যাজেট, ঘুরতে যাওয়ার ছবি বা ফ্যাশনেবল পোশাক দেখে অনেকেই নিজেদের মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেন। “ও করেছে, আমাকেও করতে হবে”—এই সামাজিক চাপের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা ভুলে যাই নিজের প্রয়োজন আর সামর্থ্য। এই আবেগজনিত সিদ্ধান্তের ফল হয় ভয়াবহ—ব্যালান্স শেষ হয়ে যায় মাসের মাঝামাঝি, সঞ্চয় বলে কিছু থাকে না, আর ধীরে ধীরে বাড়ে মানসিক চাপ।

আবেগের কারণে আর্থিক অস্থিরতা শুধু খরচে সীমাবদ্ধ থাকে না। বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও আবেগ ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনে। অনেকেই বাজারের গুজব শুনে হঠাৎ করে শেয়ার কিনে ফেলেন বা বিক্রি করে দেন, লাভের আশায় ক্রিপ্টোতে ঢুকে সর্বস্ব হারান, কিংবা বন্ধু-বান্ধবের প্ররোচনায় সন্দেহজনক স্কিমে টাকা ঢালেন। এসব সিদ্ধান্ত আবেগ দ্বারা চালিত হলেও এর পরিণাম হয় যুক্তির চেয়ে অনেক কঠিন।

আবেগের আরেকটি দিক হলো—অপরিণামদর্শিতা। অনেকে ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা না করেই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। যেমন, বিয়ের জন্য বিশাল খরচ, সন্তানের জন্মের আগে আর্থিক প্রস্তুতি ছাড়া পরিবার শুরু করা, বা হঠাৎ চাকরি ছেড়ে দেওয়া—এই সিদ্ধান্তগুলো অনেক সময় শুধু মনের তাড়নায় নেওয়া হয়। পরবর্তীতে সেগুলোর ভার বহন করতে হয় বছরের পর বছর।

আমরা যদি একটু ভেবে দেখি, তাহলে বুঝতে পারি যে আর্থিক স্থিতিশীলতা মূলত আত্মনিয়ন্ত্রণের ফসল। যারা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানে, তারা জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারে। কিন্তু যারা নিজের আবেগকে চিনতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, তারা যতই আয় করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত তারা অর্থনৈতিকভাবে অস্থিরই থেকে যায়।

আবেগজনিত অজ্ঞতা অনেক সময় পরিবার থেকে শিখে আসে। ছোটবেলায় বাবা-মা যদি শেখায়নি যে টাকা মানে দায়িত্ব, তাহলে বড় হয়েও আমরা সেটি বুঝে উঠতে পারি না। আবার অনেক সময় সমাজ আমাদের শিখিয়ে দেয়—“দেখাতে হবে”, “চাকচিক্য চাই”, “পিছিয়ে থাকলে চলবে না”। এই সামাজিক মূল্যবোধগুলো আমাদের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বিকৃত করে দেয়।

এই আবেগজনিত দুর্বলতা থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম পদক্ষেপ হলো—স্ব-মূল্যায়ন। নিজের খরচের ধরন বুঝতে হবে, কী কারণে আমরা ইমপালসিভলি খরচ করি সেটা শনাক্ত করতে হবে। অনেক সময় একটা ছোট্ট নোটবুক বা খরচের অ্যাপ এই ব্যাপারে চোখ খুলে দেয়। এরপর দরকার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ—তিন মাসে কতটা সঞ্চয় করব, ছয় মাসে কী কিনব, এক বছরে কোন কোর্স করব—এইসব স্পষ্ট লক্ষ্যে আবেগের দোলাচল অনেক কমে যায়।

দ্বিতীয় ধাপ হলো নিজেকে বোঝানো—আপনি আপনার আশেপাশের মানুষের মতো হতে বাধ্য নন। কারও প্রোফাইল দেখে আপনি যা দেখছেন, সেটা বাস্তব জীবনের ১০ ভাগও নয়। অন্যদের সাথে তুলনা কমিয়ে নিজেকে ভালোবাসতে শিখুন। একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ আবেগের শিকার কম হন এবং আর্থিক সিদ্ধান্তগুলো অনেক বেশি যুক্তিভিত্তিক নেন।

তৃতীয় ধাপ হলো শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া। অর্থনৈতিক শিক্ষা যত বেশি হবে, আবেগ তত কম কাজ করবে। যে জানে কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট কীভাবে কাজ করে, সে কখনোই হঠাৎ করে সঞ্চয় ফুরিয়ে ফেলবে না। যে জানে বাজেটিং কী, সে মাসের শেষে ঋণের জন্য হাহাকার করবে না। নিজের অর্থনৈতিক শিক্ষাকে যত দৃঢ় করা যাবে, আবেগের জায়গা তত সংকুচিত হবে।

চতুর্থ ধাপ হলো—মনের স্বাস্থ্য বজায় রাখা। অনেকে দুঃখ, হতাশা, অবসাদ থেকে বের হতে খরচকে আশ্রয় করেন। নতুন কিছু কিনলে সাময়িক সুখ হয় ঠিকই, কিন্তু মূল সমস্যার সমাধান হয় না। এই জায়গায় কাউন্সেলিং, মেডিটেশন, বা আত্মোপলব্ধির চর্চা অনেক বেশি কার্যকর। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন মানেই দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন।

সবশেষে, আমরা সবাই ভুল করি। কেউ কেউ আবেগে পড়ে বিপদে পড়েছেন, কেউ বা নতুন শিখছেন কীভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কিন্তু আশার কথা হলো—পরিবর্তন সম্ভব। আপনি যেকোনো মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন—আমি আজ থেকে আবেগের দাস থাকব না, আমি নিজের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিজেই গড়ে তুলব। এই চেতনা দিয়েই শুরু হয় স্থিতিশীলতার পথচলা।

আমাদের সমাজে যারা অর্থনৈতিকভাবে সফল, তাদের জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে—তারা প্রতিদিন নিজের আবেগকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তারা শুধু টাকা আয় করেই থেমে যাননি, তারা আয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, সংরক্ষণ করেছেন, বাড়িয়েছেন। তারা জানেন কখন খরচ করতে হয়, কখন থামতে হয়। তারা আবেগ দিয়ে নয়, চিন্তা দিয়ে চালায় নিজের জীবন।

তাই, আজ আপনার সামনে দুটি পথ—একটি হলো আবেগের হাত ধরে চলা, যেটা সাময়িক আনন্দ দিলেও দীর্ঘমেয়াদে অনিশ্চয়তা বাড়ায়। আরেকটি হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ ও জ্ঞানের হাত ধরে চলা, যা সাময়িকভাবে কঠিন হলেও ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ ও সমৃদ্ধ।

নতুন পথটি বেছে নিন। আপনার অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ আপনিই নির্মাণ করুন। আবেগের নয়, জ্ঞানের শক্তিতে ভর করে। কারণ, আবেগ যদি ভুল পথে চালায়, তাহলে জ্ঞানই পারে আপনাকে স্থিরতার পথে ফেরাতে।

লেখক : কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট অ্যান্ড সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।

এইচআর/এমএস

ফেসবুকে বন্ধুদের নতুন গ্যাজেট, ঘুরতে যাওয়ার ছবি বা ফ্যাশনেবল পোশাক দেখে অনেকেই নিজেদের মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেন। ‘ও করেছে, আমাকেও করতে হবে’—এই সামাজিক চাপের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা ভুলে যাই নিজের প্রয়োজন আর সামর্থ্য। এই আবেগজনিত সিদ্ধান্তের ফল হয় ভয়াবহ—ব্যালান্স শেষ হয়ে যায় মাসের মাঝামাঝি, সঞ্চয় বলে কিছু থাকে না, আর ধীরে ধীরে বাড়ে মানসিক চাপ।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।