জামায়াত কি তাহলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পাচ্ছে?

আমীন আল রশীদ
আমীন আল রশীদ আমীন আল রশীদ , সাংবাদিক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১০:৪২ এএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ঢাকা সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশনের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল জামায়াতে ইসলামীর আমিরের কাছে জানতে চেয়েছে, জামায়াত যদি আগামীতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব পায়, তাহলে তাদের মূল এজেন্ডা কী হবে?

রবিবার এই বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সাংবাদিকদের বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলকে জামায়াতের আমির তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলো ১. দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে নৈতিকতা, উৎপাদনমুখী, কারিগরি দক্ষতা, বৈষয়িক ও মানবিক করে গড়ে তোলা; ২. দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন এবং ৩. সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

প্রশ্ন হলো, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল কি নিতান্তই সৌজন্যের খাতিরে জামায়াতের রাষ্ট্রচিন্তা বা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিয়ে তাদের ভাবনা জানার জন্য দলের আমিরকে এই প্রশ্ন করেছিল, নাকি সত্যিই এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে যাতে আগামীতে জামায়াত রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসবে, অর্থাৎ সরকার গঠন করবে?

প্রসঙ্গত, প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তো বটেই, সরকারের সঙ্গেও বৈঠক করে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার ঢাকা সফররত প্রতিনিধিদলটি এরইমধ্যে বিএনপির সঙ্গেও বৈঠক করেছে। নিশ্চয়ই তারা বিএনপিকেও এই প্রশ্ন করেছে যে, সরকার গঠন করলে তাদের মূল এজেন্ডা বা অগ্রাধিকার কী হবে।

আগামী জাতীয় নির্বাচন কবে হবে এবং নির্বাচনে জয়ী হয়ে কারা ক্ষমতায় আসবে, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত ধোঁয়াশা আছে। অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পরপর যেমনটা মনে করা হচ্ছিলো যে, একটি অবাধ-সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে বিএনপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করবে—সেই অবস্থার যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে বলেই মনে হয়। অর্থাৎ বিএনপির জন্য নির্বাচনি মাঠ খুব কুসুমাস্তীর্ণ নেই। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তাদের সরকার গঠনের বিষয়টি এখন আর খুব সহজ নয় বলেই মনে হয়। বরং আগামী নির্বাচন বিএনপির জন্যই যে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে, এরইমধ্যে তার নানা ইঙ্গিত মিলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচনও হয়তো তার সামান্য ইঙ্গিত। তারওপর বিএনপিবিরোধী জোট, বিশেষ করে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অন্যান্য ধর্মীয় দলগুলো মিলে এটি বৃহত্তর  প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুললে সেটি যে ভোটের মাঠে বিএনপিকে ভীষণ চাপে রাখবে, তাতে সন্দেহ নেই। অন্যদিকে আগামী নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিও বিরাট ফ্যাক্টর হবে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। তারা এখনও নিবন্ধিত দল নয় বা আকারে হয়তো বিএনপি ও জামায়াতের চেয়ে ছোট দল, কিন্তু নানা কারণেই এই দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা দেশের বর্তমান রাজনীতিতে যেমন ফ্যাক্টর, তেমনি আগামী নির্বাচনে তাদের ভূমিকা যে বিএনপির বিপক্ষে থাকবে, তারও লক্ষণ স্পষ্ট। তার মানে বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে একাধিক বৃহৎ শক্তির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হবে।

অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তাদের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টি যদি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, তাহলে এই দুটি দলের ভোট বিএনপি পাবে কি না, তা নিয়েও সংশয় তৈরি হচ্ছে। কেননা, মাঠ পর্যায়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল (কোথাও পুনরুদ্ধার), হামলা, ভাঙচুর, আগুন এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে বাড়িছাড়া করার ঘটনায় প্রধানত নাম আসছে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের। হাটবাজারে চাঁদাবাজি, দখলদারি এমনকি ক্ষমতার দ্বন্দ্বে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও খুনোখুনির কারণেও মাঠ পর্যায়ে বিএনপির ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষুণ্ন হয়েছে। এসব কারণে সুইং ভোটার এবং আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সমর্থকদের ভোট বিএনপি যদি না পায়, তাহলে তাদের জন্য নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন বেশ কঠিন হবে। বরং তখন বিএনপিবিরোধী এক বা একাধিক জোট মিলে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হতে পারে বলেও অনেকে মনে করছেন। যদি সেরকম কিছু ঘটে তাহলে সেই সরকারের প্রধান স্টেকহোল্ডার হয়তো জামায়াতই হবে। ভোটের এই অঙ্ক বিদেশিদের না জানার কথা নয়। সে কারণেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন জামায়াতের আমিরের কাছে তাদের অগ্রাধিকার জানতে চাইলো কি না—সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

দেশ স্বাধীন হওয়ার অর্ধ শতাব্দী পরে যদি সত্যিই জামায়াতে ইসলামী বা কোনো ধর্মীয় দল বা জোট সরকার গঠন করে, তাহলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ দেশের অন্য সকল দল কীভাবে সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে এবং তারা কী করে নিজেদের রাজনীতি সমুন্নত রাখবে, সেটি নিয়ে দলগুলোর এখনই চিন্তা-ভাবনা শুরু করা দরকার।   

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা এবং পকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে হত্যাসহ মানবতাবিরোধী নানা অপরাধে অভিযুক্ত দলটি যদি দেশ স্বাধীন হওয়ার অর্ধ শতাব্দী পরে সত্যি সত্যিই রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে, তাহলে এর দায় প্রত্যেকটি দলের ওপরেই বর্তাবে। বিশেষ করে এই দায় বর্তাবে বিএনপির ওপর। কেননা তারাই জামায়াতকে প্রথম ক্ষমতার অংশীদার করেছে। জামায়াত দীর্ঘদিন বিএনপির জোটসঙ্গী ছিল। আবার জামায়াত যদি সত্যিই সরকার গঠন করতে পারে, সেই দায় আওয়ামী লীগের ওপরেও বর্তাবে। কেননা, তারাও জামায়াতকে রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে মোকাবিলার পথে না গিয়ে তাদের নির্মূল করার পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দলের এটি না জানার কথা নয় যে, আদর্শভিত্তিক কোনো দলকে চাইলেই নির্মূল করা যায় না। বরং নির্মূলকরণের প্রক্রিয়ার ভেতরেই ওই দলটি শক্তিশালী হতে থাকে। তারা নানা কায়দায় পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে নিজেদের শক্তিশালী করতে থাকে।

জামায়াত যে গত ১৫ বছরে কীভাবে নিজেদের শক্তিশালী করেছে, তার প্রমাণ জুলাই অভ্যুত্থান এবং তার পরবর্তী রাজনীতি। সুতরাং জামায়াতকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি বলে গালিগালাজ করে তাদের প্রশাসনিকভাবে নানা কৌশলে নির্মূল করার পথে না গিয়ে আওয়ামী লীগ যদি তাদের আদর্শিকভাবে মোকাবিলা করতো এবং জামায়াত, বিএনপিসহ অন্য যেকোনো দলের চেয়ে উত্তম রাজনীতি করতো; উন্নয়নের দোহাই দিয়ে মানুষকে  সুশাসন ও গণতন্ত্রবঞ্চিত না করতো—তাহলে হয়তো চব্বিশের অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন হতো না। বরং ২০১৪ থেকে পরপর তিনটি নির্বাচনের মধ্যে একটি বা দুটিতে আওয়ামী লীগ হেরে যেতো এবং যখন আওয়ামী লীগ হেরে যেতা তখন বিএনপির মতো একটি মধ্যপন্থী দল ক্ষতায় আসতো। জামায়াত তাদের সঙ্গে হয়তো ক্ষমতার অংশীদার হতো। কিন্তু এককভাবে কিংবা অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতো না।

আগামী নির্বাচন সত্যিই কবে হবে আর সেই নির্বাচনে আসলেই জামায়াত সরকার গঠনের মতো আসন পাবে কি না, তা এখন পর্যন্ত নানা অঙ্কের হিসাবে বন্দি। কিন্তু আগামী নির্বাচন যে অতীতের কোনো নির্বাচনের মতো হবে না, সেটি চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। সেইসাথে ‘জামায়াত স্বাধীনতাবিরোধীদের দল’—শুধু এই কথা বলেও জামায়াতের ভোট কতখানি কমানো যাবে, সে ব্যাপারেও সন্দেহ আছে। কেননা মানুষ গত ৫৪ বছরে তিনটি বড় দলের শাসন দেখেছে এবং কোনো সরকারই যে দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র, সুশাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি, বরং প্রতিটি সরকারের বিরুদ্ধেই লাগামহীন অনিয়ম দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে—ফলে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশই হয়তো এবার নতুন কিছু ভাববে। তারা হয়তো নতু্ন কাউকে ভোট দিতে চাইবে। কিন্তু সেই নতুন কারা, জামায়াত নাকি এনসিপি নাকি অন্য কেউ—তা বলা মুশকিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রচলিত রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে বলেই অভ্যুত্থানের মুখে একটি সরকারের পতন হয়েছে। সেখানে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব যতই থাকুক না কেন, দেশের মানুষ যে বিগত সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল, জনগণের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরত্ব বাড়তে বাড়তে যে সেটি একটি বিরাট বিচ্ছিন্নতায় পর্যবসিত হয়েছিল, এই নির্মম সত্যটি আওয়ামী লীগকে উপলব্ধি করতে হবে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার অর্ধ শতাব্দী পরে যদি সত্যিই জামায়াতে ইসলামী বা কোনো ধর্মীয় দল বা জোট সরকার গঠন করে, তাহলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ দেশের অন্য সকল দল কীভাবে সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে এবং তারা কী করে নিজেদের রাজনীতি সমুন্নত রাখবে, সেটি নিয়ে দলগুলোর এখনই চিন্তা-ভাবনা শুরু করা দরকার।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।