সেরা

মোহিত কামাল
মোহিত কামাল মোহিত কামাল , কথাসাহিত্যিক, মনোচিকিৎসক
প্রকাশিত: ০১:৩৩ পিএম, ০৭ অক্টোবর ২০২৫

অতীত বলল, 'আমিই সেরা।'
বর্তমান বলল, 'অতীত ফিরে পাওয়া যায় না। আমিই সেরা। আমাকে যে যথাযথ ব্যবহার করবে সে অতীতের গ্লানি ভুলে যাবে আর তার বর্তমান হবে রঙিন।'

'তুমি কি ঠিক বলছো? বর্তমানের যেকোনো ঘটনা ভালোভাবে পরখ করে, বিশ্লেষণ করে তুমি যে সিদ্ধান্ত নেবে, প্রত্যক্ষভাবে সেখানে তুমি কি ব্যবহার করতে বাধ্য নও অতীত অভিজ্ঞতা? তুমি কি তোমার অহংকারী বর্তমানকে ব্যবহার করতে পারবে আমাকে ছাড়া? ফেলে আসা দিনের অভিজ্ঞতাকে ছুড়ে ফেলে কি সামনে এগোতে পারবে?'

অতীতের ধারালো প্রশ্ন শুনে থমকে গেল বর্তমান। কী বলবে ভাবতে লাগল। এমন সময় কাঁচাসোনা রোদমাখা সকালবেলায় তাদের মাঝে উদয় ঘটল ভবিষ্যতের। দীপ্ত কন্ঠে বলতে লাগল, ' শোনো ২৪ ঘন্টা পরেই তুমি অতীতের গর্ভে হারিয়ে যাবে, হে অহংকারী বর্তমান। অতীত আর বর্তমান মিলে ভবিষ্যতের সিঁড়ি নির্মিত হয়। ভবিষ্যৎ ছোঁয়ার জন্য মানুষ ব্যাকুল থাকে, লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তাদের ভেতরের শক্তি চালিত করে ভবিষ্যতের দিকে। সুতরাং লক্ষ্যস্থল হচ্ছি আমি। আমার ভেতরে তাদের লুকানো স্বপ্ন পূরণের জন্য তারা থাকে বেপরোয়া। তাহলে বলো, কে সেরা, আমি নই?'

নিজেকে চেনা, অহংকারী হয়ে নিজেকে বড়ো না ভাবা, নিজেকে সমালোচনা করা, নিজেকে মূল্যায়ন করা, নিজের দোষটা ধরা- তা সংশোধন করা, নিজের গুণটা ধরা- তা শাণিত করা, চারপাশকে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করা, শারীরিক সুস্থতার প্রতি নজর দেওয়া, মানসিক উন্নতির দিকে খেয়াল রাখা, মানবিক গুণাবলীর ধার বাড়ানো বর্তমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।'

অতীত এবার নড়ে ওঠে বলল, 'তুমি ঠিক বলেছো, বন্ধু ভবিষ্যত। তবে আর একটা তথ্য তোমাকে জানাচ্ছি- মানুষ ভবিষ্যতপানে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে আমার মানে মহাকালের অতীতগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে পা ফেলতে ফেলতে তাদের বয়স বাড়ে, তাদের ত্বকে ভাঁজ পড়ে, চুল সাদা হয়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ক্ষয়রোগ বাসা বাঁধে। তারপর সামর্থ্যবানগণ যা চলে যান হাসপাতালে সিসিইউ কিংবা আইসিইউতে। জীবনের সঙ্গে লড়াই করেতে করতে কেউ হয়তো থেকে যায় বর্তমানে, অধিকাংশ চলে যায় সাড়ে তিন হাত ভূমি কিংবা শ্মশানঘাটে। এই অলঙ্ঘনীয় বিধান কি তোমরা কেউ অস্বীকার করতে পারো?'

হঠাৎ করে শরীরের ভেতর থেকে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বা ডিফেন্স সিস্টেম কথা বলা শুরু করল, 'আমার দায়িত্ব মানব জাতিকে সুরক্ষা করা কিন্তু কখনো কখনো আমি ভুলক্রমে তাদের দেহকোষকেই শত্রু ভাবতে থাকি, সুরক্ষার বদলে আক্রমণ করি। মানুষের দেহে রোগ তৈরি করে
ফেলি। এজন্য বিজ্ঞানীরা আমার নাম দিয়েছে অটোইমিউন ডিজিজ।'

আকস্মিক সেখানে হাজির হলেন তিন বিজ্ঞানী-মেরি ব্রাঙ্কো, ফ্রেড রামসডেল, শিমন সাকাগুচি। এঁদের মধ্যে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর সিস্টেম বায়োলজির জ্যৈষ্ঠ প্রকল্প ব্যবস্থাপক মেরি ব্রাঙ্কোই বললেন, 'শোনো হে রোগ প্রতিরোধতন্ত্র বাবু, এখন আর তুমি ভুল করতে পারবে না। ভুল করে মানুষকে ঘরের শত্রু বিভীষণরূপে আক্রমণ করে আর রোগ সৃষ্টি করতে পারবে না। তোমার সে ভুলের খেসারত দিতে হবে না পৃথিবীর মানুষকে। এখন তুমি সঠিকভাবে দেহকোষ চিনতে পারবে, বন্ধুরূপে তাদের সুরক্ষা করতে পারবে।'

হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে 'বর্তমান' লাফিয়ে উঠে বলতে লাগল, "ইয়েস ! ইয়েস! আমিই সেরা। বর্তমানের সেরা নোবেলজয়ী আবিষ্কার হলো 'পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্স তথা শরীরের রোগ প্রতিরোধক কোন জীবাণুদের আক্রমণ করতে গিয়ে যেন নিজের টিস্যু বা অঙ্গকে আক্রমণ না করে সেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আবিষ্কার হয়ে গেছে এই তিন বিজ্ঞানের মহান গবেষণার ফলে।"

বর্তমানের উল্লাস আকস্মিক অতীতের কন্ঠ কেড়ে নিল, ভবিষ্যতেরও। তারপর হঠাৎ দেখা গেল আকাশে মেঘ জমে গেছে। মেঘে মেঘে ঘর্ষণে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। কণাতরঙ্গ থেকে বেরোতে লাগল শব্দধ্বনি, 'তোমরা কেউ-ই সেরা নও। কেউ বড় নও । সামনের বছর ট্যালেন্টেড বিজ্ঞানীরা আরও আরও অচিন্তনীয় কিছু আবিষ্কার করে ফেলবে। তখন এই আবিষ্কার চলে যাবে অতীতের গর্ভে, তবে নতুন তথ্য বর্তমানে ব্যবহৃত হবে, ভবিষ্যতেও। বর্তমান চলে যাবে অতীতের গর্ভে। অতীত আরও প্রশস্ত হবে, বর্তমান কিংবা ভবিষ্যত ধাপে ধাপে বিলীন হবে মহাকালের রহস্যময় সময়ের গভীর থেকে গভীরে।'

'তো করণীয় কী?' চিৎকার করে প্রশ্ন করল বর্তমান।
'নিজেকে চেনা, অহংকারী হয়ে নিজেকে বড়ো না ভাবা, নিজেকে সমালোচনা করা, নিজেকে মূল্যায়ন করা, নিজের দোষটা ধরা- তা সংশোধন করা, নিজের গুণটা ধরা- তা শাণিত করা, চারপাশকে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করা, শারীরিক সুস্থতার প্রতি নজর দেওয়া, মানসিক উন্নতির দিকে খেয়াল রাখা, মানবিক গুণাবলীর ধার বাড়ানো বর্তমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।'

লেখক : কথাসাহিত্যিক
সম্পাদক, শব্দঘর। মনোচিকিৎসা বিদ্যার অধ্যাপক।

এইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।