রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করতে সংস্কার জরুরি

ইয়াহিয়া নয়ন
ইয়াহিয়া নয়ন ইয়াহিয়া নয়ন , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:০৩ এএম, ০৮ অক্টোবর ২০২৫

বর্তমানে দেশে নতুন বিনিয়োগ কার্যত থমকে গেছে। শিল্প ও ব্যবসা খাতে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ না আসায় সামগ্রিক অর্থনীতিও এখন বেশ স্থবির। রুটিন কর্মকাণ্ডের বাইরে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে যাচ্ছে না সরকার। নতুন শিল্প স্থাপন কিংবা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেই বেসরকারি খাতেও। এ পরিস্থিতিতে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ঋণের চাহিদা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। আবার পুঁজিবাজারেও কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে না।

অর্থনৈতিক স্থবিরতার পাশাপাশি দেশের বেসরকারি খাতে চলছে নজিরবিহীন ঋণ খরা। ঋণ বিতরণ তো দূরের কথা, বেসরকারি অনেক ব্যাংক গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতেও হিমশিম খাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তাদের জন্য শেষ ভরসা হওয়ার কথা ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক অর্থাৎ সোনালি, জনতা, অগ্রণী ও রুপালি ব্যাংকের। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থাও খুবই নাজুক। ঋণ বিতরণ আগের মতো বেড়ে না গিয়ে কমেছে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে, খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণেও ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকগুলো।

প্রশাসনে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর শীর্ষ কর্মকর্তাদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে ব্যাংকগুলোয় এক ধরনের অচলাবস্থা বিরাজ করছে। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে যখন বেসরকারি কিছু দুর্বল ব্যাংক উদ্ধারে ব্যস্ত সরকার, তখন ভেতর থেকেই ভেঙে পড়ছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এ ব্যাংকগুলো সংস্কারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। যদি এখনই এ ব্যাংকগুলোর পুনর্গঠন, একীভূতকরণ ও কার্যকর সংস্কার শুরু না হয়, তবে এসব ব্যাংক অর্থনীতিকে সহায়তা করার পরিবর্তে একসময় অর্থনীতির জন্য আরো বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

চীনের ব্যাংকিং মডেল অনুসরণ করে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করা যেতে পারে। চীনের মডেল মূলত শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, কার্যকর প্রশাসনিক শৃঙ্খলা এবং কেন্দ্রীভূত তদারকির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীর সেরা চারটি ব্যাংক হচ্ছে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। প্রত্যেকটি ব্যাংক তার নির্দিষ্ট কার্যক্ষেত্রেই ঋণ দিয়ে থাকে। এখনই যদি সংস্কার শুরু না হয়, তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আরো অবনতি ঘটবে,যার দায় শেষ পর্যন্ত পুরো অর্থনীতিকেই বইতে হবে। সংস্কার শুরুর এখনই সময়।

আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক তথা সোনালি, জনতা, অগ্রণী ও রুপালি ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৩ লাখ ১২ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন শেষে চার ব্যাংকের ঋণ স্থিতি নেমে এসেছে ৩ লাখ ৪ হাজার ২২৬ কোটি টাকায়। গত ছয় মাসে তা না বেড়ে উল্টো ৮ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা কমেছে। কেবল ঋণ বিতরণে হতাশাজনক চিত্রই নয়, বরং গত ছয় মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকগুলোর অন্য সব আর্থিক সূচকেও অবনমন হয়েছে।

জুন শেষে চার ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ঠেকেছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬১ কোটি টাকায়। বিতরণকৃত ঋণের ৪৮ দশমিক ১০ শতাংশই এখন খেলাপি। বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেকের কাছাকাছি খেলাপি হওয়ায় সেটি ব্যাংকের মূলধন ও আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতিও যথাযথভাবে রাখা হচ্ছে না। এটি ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার প্রমাণ। এতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক নিরাপত্তা দুর্বল হয়ে পড়েছে। সঞ্চিতি ঘাটতি এবং ঋণ বিতরণের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি প্রমাণ করে যে এ ব্যাংকগুলো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল করার পরিবর্তে এখন নিজেরাই টিকে থাকার লড়াই করছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কেবল আর্থিক সূচকেই নেতিবাচক নয়। প্রশাসনিক শৃঙ্খলাও ভেঙে পড়েছে। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার তোয়াক্কা না করে ব্যবস্থাপনায় আনা হয়েছে নতুন নেতৃত্ব। শীর্ষ কর্মকর্তারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বরং কর্মকর্তাদের চাপের মুখে প্রায় আট হাজার জনকে সুপার নিউমারারি (পদ ছাড়াই পদায়ন) পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর অর্গানোগ্রাম বা জনবল কাঠামোকে ভেঙে নজিরবিহীন পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর প্রশাসনিক কাঠামোয় বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। একইভাবে ইনসেনটিভ বোনাস নিয়েও চলছে অযৌক্তিক দাবিদাওয়া।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী তিনটির বেশি বোনাস দেয়ার সুযোগ নেই। তবু আটটি বোনাস দাবিতে সোনালি ব্যাংকের এমডিকে কর্মকর্তারা অবরোধ করে রাখেন। যদিও সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতি বাগিয়ে নেয়া অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই গত ১৫ বছর নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। কেউ কেউ প্রভাবশালী ব্যবসায়ী তথা অলিগার্কদের লুণ্ঠনের সহযোগীও ছিলেন। চেয়ারম্যান, পরিচালক ও শীর্ষ নির্বাহীর আশীর্বাদ পেতে ব্যাংকিংয়ের রীতিনীতি না মেনেই তারা বেনামি ঋণের নথিপত্র তৈরি করেছেন।

বর্তমান বিশৃঙ্খলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গত দেড় দশকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে পরিকল্পিতভাবে লুণ্ঠন হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে জনতা ব্যাংক। জনতা ব্যাংক থেকেই একাধিক গ্রুপ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছে। একই সময়ে যারা দুর্নীতির সহযোগী ছিলেন, তারাও পদোন্নতি পেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসেছেন। অর্থাৎ অনিয়ম ও দুর্নীতি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কোনো কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত বা আইনের মুখোমুখি হননি। ফলে অনিয়ম-দুর্নীতির যথাযথ বিচার না হওয়ায় নতুন নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠছে।

জানা যাচ্ছে, আমানতের বিপুল পরিমাণ অর্থ থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সোনালি ব্যাংকের ঋণ স্থিতি না বেড়ে উল্টো ৯ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা কমেছে। এ ব্যাংকটি উদ্যোক্তা ও উৎপাদন খাতকে ঋণ না দিয়ে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগের ওপর বেশি নির্ভরশীল হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলো সাময়িক মুনাফা দেখাতে পারছে ঠিকই, কিন্তু তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে গতিশীল করার পরিবর্তে কেবল সরকারি ঋণ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখছে।

অন্যদিকে জনতা ব্যাংকের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। ব্যাংকটির ৭৬ শতাংশের বেশি ঋণই খেলাপি। ব্যাংকটির সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ ৪৫ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকায় ঠেকেছে। অর্থ সংকটে থাকা জনতা ব্যাংক এখন ১১-১৩ শতাংশ সুদেও মেয়াদি আমানত নিচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক খাতকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলবে। অগ্রণী ব্যাংক ও রুপালি ব্যাংকও একইভাবে খেলাপি ঋণ ও সঞ্চিতি ঘাটতি রয়েছে।

গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলো সংস্কার ও একীভূতকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের ১১টি ব্যাংকে ফরেনসিক অডিট চলমান রয়েছে। এ বাস্তবতার মধ্যেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঘিরে কোনো সংস্কার উদ্যোগই নেয়া হয়নি। এ ব্যাংকগুলোয় সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতি উদ্ঘাটন ও ঋণের প্রকৃত মান নির্ণয়ে অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর) করা যেত। এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো উদ্যোগও দেখা যায়নি।

রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ছাড়াও বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের অবস্থা আরো নাজুক। বিগত সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে বেসিক ব্যাংক। দেশের ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করতে হলে একীভূতকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি সরকারকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা দূর করতে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত করা জরুরি। সুপার নিউমারারি পদোন্নতি সংস্কৃতি বন্ধ করা দরকার। অতীতের দুর্নীতি ও লুণ্ঠনে দায়ীদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। দায়মুক্তির সংস্কৃতি ভাঙা ছাড়া কোনো সংস্কার কার্যকর হবে না। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক বাস্তবতা বিবেচনা করতে হবে—শুধু সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ নয়, বরং উৎপাদনশীল ও এসএমই খাতে ঋণপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।

এক্ষেত্রে চীনের ব্যাংকিং মডেল অনুসরণ করে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করা যেতে পারে। চীনের মডেল মূলত শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, কার্যকর প্রশাসনিক শৃঙ্খলা এবং কেন্দ্রীভূত তদারকির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীর সেরা চারটি ব্যাংক হচ্ছে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। প্রত্যেকটি ব্যাংক তার নির্দিষ্ট কার্যক্ষেত্রেই ঋণ দিয়ে থাকে। এখনই যদি সংস্কার শুরু না হয়, তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আরো অবনতি ঘটবে,যার দায় শেষ পর্যন্ত পুরো অর্থনীতিকেই বইতে হবে। সংস্কার শুরুর এখনই সময়।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।