প্রাদেশিক সরকার ও জাতীয় জীবনের সংকট মুক্তির পথ

বিদিশা সিদ্দিক
বিদিশা সিদ্দিক বিদিশা সিদ্দিক , রাজনীতিক
প্রকাশিত: ০৬:০৫ পিএম, ১৪ আগস্ট ২০১৮

জনগণ আর রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটির উন্নয়ন অসম্পূর্ণ থাকে। তাই জনগণের উন্নতি মানে রাষ্ট্রেরও উন্নতি। যেহেতু জনগণের কল্যাণ বা উন্নতির জন্যই রাষ্ট্র তাই রাষ্ট্রকে জনগণের কল্যাণে, তাদের চাহিদা অনুযায়ী সরাসরি সেবা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। এই সেবাদান একমাত্র সরকারের মাধ্যমেই সম্ভব।

তাই নাগরিক সেবা নির্ভর করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর। রাষ্ট্রব্যবস্থা দুই প্রকার, এককেন্দ্রিক ও ফেডারেল। এককেন্দ্রিক সরকার সেবা দেয় কেন্দ্র থেকে সরাসরি। সেখানে মধ্যবর্তী ক্ষমতা বণ্টনের কোনো সুযোগ নেই। আর ফেডারেল সরকার সেবা দেয় স্থানীয় এলাকা ও অঞ্চল ভিওিতে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এককেন্দ্রিক অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে সরাসরি শাসন কাজ পরিচালিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রচলিত এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা দেশের জনগণের মৌলিক চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে বরাবর। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৮ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার বাস। ভবিষ্যতে এ জনসংখ্যা আরও বাড়বে।

ব্রিটিশ আমলে এ ধরনের এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা ইংরেজরা চালু করেছিল আমাদের শাসন ও শোষণ করার জন্য, জনগণকে মানবিক সেবা দেওয়ার জন্য নয়। পাকিস্তান আমলেও এই শাসনব্যবস্থা জনগণকে শোষণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। এখনো সেই একই ঔপনিবেশিক পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থাতেই দেশ চলছে। এ ব্যবস্থায় একজন প্রধানমন্ত্রী ও তার কেবিনেটের পক্ষে কোনোভাবেই ১৮ কোটি মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান করে উপযুক্ত সেবা দেয়া সম্ভব নয়।

তদুপরি একজন প্রধানমন্ত্রীকে রাজনৈতিক নানান সমস্যার সমাধান করতে হয়। ভ্যাট ও ট্যাক্সের টাকার জমাকরণের মাধ্যমেই সরকারি তহবিল হয়। দেশের সবচেয়ে দরিদ্রতম নাগরিক রূপে চিহ্নিত একজন ভিক্ষুককেও তার ভিক্ষার টাকা দিয়ে চাল-ডাল, আলু-পিঁয়াজ, লবণ-কাপড়, ওষুধ-সাবান, কাপড়-স্যান্ডেল কিনতে হলে ভ্যাট/ট্যাক্স দিতে হয়।

সে তহবিল থেকেই দেশের বাজেট হয়। সেই বাজেটের প্রায় ৬৫% ব্যয় হয় রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক কর্মসূচিতেএবং ২০% বাণিজ্যিক ব্যয় হয় রাজধানী চট্টগ্রামকেন্দ্রিক কর্মসূচিতে। বাকি ১৫% বাজেট সমগ্র দেশের জন্য, যার এক সামান্য ভগ্নাংশ ব্যয় হয় পল্লী-গ্রামের জনগণের জন্য। তার মানে ব্রিটিশ আমলে এ দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় উন্নয়ন হতো ইংল্যান্ডের, পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানের; আর এখন হয় ঢাকা-চট্টগ্রামসহ শহরাঞ্চলের।

আঞ্চলিক বিভাজনের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীন দেশের প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থায় বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, সামাজিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী এবং ক্রীড়া ও খেলাধুলার ক্লাব গড়ে উঠবে,নতুন নতুন রেডিও, টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপিত হবে, গণ-মানুষের চিন্তা ও মননের জগৎ বিকশিত ও প্রশস্থ হবে। প্রদেশে অবস্থিত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, প্রযুক্তি ও পেশাগত প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষক-অধ্যাপক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক প্রমুখদের মধ্যে মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটবে যা আমাদের জাতীয় অগ্রযাত্রার জন্য সবচাইতে প্রয়োজনীয়।

সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থানান্তর হলে ঢাকার নানাবিধ সমস্যা বহুলাংশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমাধান হয়ে যাবে। যানযট নিরসন হবে, গাড়ি ও জনচাপ কমে যাবে, আবাসন সমস্যার সমাধান হবে, বাড়ি ভাড়া কমে যাবে, জনসাস্থ্য, পয়ঃনিষ্কাশন, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

বিকেন্দ্রীকরণ ও প্রাদেশিক কর্ম সংস্থানের ফলে গ্রামের জনগণ আবার গ্রামে নিজের ভিটায় ফিরে যেতে পারবে। ঢাকায় জনসংখ্যা কমে গেলে সেখানে অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পাবে, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি কমে যাবে। বিপুল জনসংখ্যার কারণে সৃষ্ট অসহনীয় যানজট সমস্যা খুব সহজেই এভাবে সমাধান করা সম্ভব। শহরে লোক কমে গেলে গাড়ি, রিকশা, বাস সবকিছুরই প্রয়োজন কমে যাবে।

আমাদের দেশে কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা ব্যতীত আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য-অভ্যাস জীবনধারা, ভাষা, সংস্কৃতি সবই এক। সুতরাং বাংলাদেশে প্রদেশ করা হলে রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও অখণ্ডতা ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বরং যদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ন্যায়সংগত দাবি দাওয়া মেনে নিয়ে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগণের জন্য বিশেষ আঞ্চলিক শাসন-এর ব্যবস্থা করা হয়, তবে রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও অখণ্ডতা সুদৃঢ় হবে।

প্রদেশ গঠন হলে ক্ষমতা ও প্রশাসন দুটোই বিকেন্দ্রীকৃত হয়; উন্নয়ন সহজতর হয়। প্রদেশ গঠনে প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুটা ব্যয়বহুল হলেও, নতুন করে শিল্পায়ন, পর্যটন খাত, যোগাযোগ, সেবাখাতসহ বিভিন্ন উৎস থেকে নতুন নতুন আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে। উপজেলা পরিষদ গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও আজকে সবাই স্বীকার করছেন উপজেলা সৃষ্টির ফলে অন্যান্য খাতে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে।

এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় শহরমুখী মানুষের মিছিল প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে, প্রদেশ ও উপজেলা ব্যবস্থাকে কার্যকর করে এই মিছিলের অবসান ঘটানো সম্ভব। আমাদের দেশের শহরাঞ্চল ছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, শিক্ষানুরাগী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী, সমাজচিন্তকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের মেধা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা ও শাসনব্যবস্থাকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলা সম্ভব।

একটি উদাহরণ হিসেবে যদি শুধু প্রবাসীদের অর্থায়নে ‘উপজেলা ও পৌর শিল্প এলাকা’ গঠন করা হয়, দেখা যায় প্রতিটি শিল্প এলাকায় ৩০০০/৫০০০ কোটি টাকা (প্রত্যেক বিনিয়োগ সক্ষম প্রবাসীর পক্ষ থেকে) বিনিয়োগ করে ৭/৮ লক্ষ (৭,০০,০০০/৮,০০,০০০) কোটি টাকা বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে। অনুমান করা যায় প্রায় ১০ লাখ প্রবাসীর বিনিয়োগ করার ক্ষমতা আছে। এর সাথে যুক্ত হবে স্থানীয় বিনিয়োগ, ফলে ৮/১০ বছরে ৫ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে আশা করা যায়।

প্রদেশ গঠনের ফলে এই কাজটি অনেকাংশে সহজতর হবে শিল্পাঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য যৌথ পুঁজির (দেশি ও বিদেশি ) প্রয়োজনীয়তা দেখা দিবে। তখন প্রাদেশিক সরকার নিজ নিজ সরকারের ভাবমূর্তি বৃদ্ধির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে। প্রদেশভিত্তিক শিল্প ও নগর গড়ে উঠার ফলে, এই সকল কলকারখানায় উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় ও কেন্দ্রের চাহিদা মিটিয়ে সরাসরি প্রদেশ থেকে বিদেশেও রফতানি করতে পারবে।

প্রাদেশিক সরকার উৎপাদিত কৃষি ও শিল্প পণ্য বিদেশে রফতানি বৃদ্ধির জন্য আধুনিক বিমানবন্দর কার্গো বিমানের সুবিধাসহ বিমানবন্দর গড়ে তুলবে। দেশি-বিদেশি ক্রেতা-বিক্রেতা নানাবিধ সুবিধা অতিদ্রুত ও সহজে পাবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিকেন্দ্রীকরণ বা প্রদেশে স্থানান্তরিত হওয়ার কারণে প্রবাসীরা নিজ এলাকা থেকে বিদেশে যাওয়া-আসা করতে পারবে।

মানবিক উন্নায়ন ও শিল্প উন্নয়নে আন্তঃপ্রাদেশিক সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা প্রয়োজন। তাই যত দ্রুত সম্ভব সংশ্লিষ্ট মহলের বোধোদয় প্রয়োজন এবং সময়োচিত অতি প্রয়োজনীয় বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ায় আঞ্চলিক বিভাজনের মাধ্যমে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা চালু করা দরকার।

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।