মেয়েদের জিনস পরার কারণেই নাকি ভূমিকম্প হচ্ছে!
ঢাকায় ভূমিকম্প হয়েছে, টের পাইনি। ভূমিকম্প যে সময় হয়েছে, সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে, আমি তখন ছুটছি বাইরে কাজের প্রয়োজনে। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৩। মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প। তাই হয়তো কম্পন অতটা অনুভূত হয়নি।
তবে ভূমিকম্পের চেয়েও যার কথায় রীতিমত কেঁপে উঠেছি, তিনি মাওলানা ফজলুর রহমান। যিনি ‘জামিয়াত উলেমা-ই- ইসলামি ফজল’ এর মুখপাত্র। পাকিস্তানভিত্তিক মৌলবাদী সংঘ এটি। তিনি রীতিমত সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, ‘মেয়েদের জিনস পরাই ভূমিকম্পের মতো বিপর্যয়ের কারণ’। শুধু তাই নয় তিনি দাবি করেছেন, পাকিস্তান সরকার যেন সশস্ত্রবাহিনীর মাধ্যমে এখনই একটি মিলিটারি অপারেশন করে সে দেশে মহিলাদের জিনস পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এমনকি পাকিস্তানের বিদ্যুৎ সঙ্কট, নিরাপত্তা ধ্বংস এমনকি বেলুচিস্তানের সমস্যার পেছনেও মেয়েদের অশোভন, খোলামেলা আচরণকে দায়ী করেছেন তিনি।
ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়। যার সাথে সম্পর্ক ভূ-প্রকৃতির, কোনভাবেই সম্পর্ক নেই নারী বা পরুষের। মাওলানা ফজলুর রহমানকে মৌলবাদী বলতে বাধ্য হচ্ছি। তিনি নিশ্চিতই ধর্মীয় মৌলবাদী। ধর্ম যা কখনও বলেনি, তা ধর্মের নামে প্রচার করা, মিথ্যে বলাটাইতো ধর্মীয় মৌলবাদিতা।
এই ফজলুর রহমানরা যুগ যুগ ধরে আছেন। আসলে তাদের কোনো ধর্ম নেই, লেবাস আছে ধর্মের। সব ধর্মেই এরা ছিলেন, আছেন। গীর্জার পাদ্রী, মন্দিরের পুরোহিত, ইসলামের মাওলানা’র ছদ্দবেশে। এরা তথ্য দেয় মনগড়া, জারি করে ফতোয়া। জুলুম অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নের মধ্যে রাখতে চায় মানুষকে।
এইসব ফজলুর রহমানরাই সতীদাহ প্রথার নামে জীবন্ত মেয়েদের সহমরণে বাধ্য করেছিল। ‘সতী’ উপাধি দিয়ে একটা জীবন্ত মানুষকে চিতায় তুলে দিত আগুনে পুড়িয়ে মারতে। এরাই এক সময় ইংল্যান্ডের গীর্জা থেকে বেরিয়ে এসে ‘শ্যামা মেয়েদের’ শুধুমাত্র কালো হবার কারণে ‘ডাইনি’ উপাধি দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে দিনের পর দিন। এরাই এক সময় ইউরোপে মেয়েদের ঋতুকালীন সময়ে ‘অশুচি’ বলে সাতদিন ঘোড়ার আস্তাবলে থাকতে বাধ্য করেছিল। এখনও এখানে ওয়াজের নামে গ্রামে গ্রামে মাইকে চিৎকার করে চলে নারীবিদ্বেষ, বিষোদগার, ভুল মিথ্যে যৌনতথ্য।
এক সময় এই ‘তথাকথিত মাওলানা’রা টেলিভিশনকে ‘শয়তানের বাক্স’ বলেছেন। প্রতিবাদে, আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছেন। অথচ এখন এই মাওলানারাই টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করেন। তাদের কারো কারো রয়েছে ‘ইউটিউব চ্যানেল’। উপার্জনও করছেন ভালো। তারাই এক সময় পরিবার পরিকল্পনা আর জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ঘোর বিরোধিতা করেছেন।
আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। গ্রাম থেকে দলে দলে আসা যে মেয়েরা গামের্ন্টসে বিশাল শ্রমঘন ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলেছে এরা তাদেরও বিরোধিতা করেছে। পাপী, নষ্টা, নালায়েক বলেছেন। এরাই এক সময় দাঁড়িয়েছিল ইসলামে ‘নারী নেতৃত্ব’ নিষিদ্ধ বলে। অথচ ইসলামে এমন কিছুই বলা হয়নি।
ধর্মীয় মৌলবাদীরা নারীবিদ্বেষী, ব্যক্তিগত আর বাণিজ্যিক স্বার্থে। এর সঙ্গে তাদের লাভ আর লোভের সম্পর্ক, ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। মিথ্যে ফতোয়া, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতায় এদের বাণিজ্যিক লাভ রয়েছে। ধর্মের কিছু নেই। পাকিস্তানি ধর্মীয় মৌলবাদী আর এদেশের ধর্মীয় মৌলবাদীদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। মূলত তারা একই। এরাই এদেশের স্বাধীনতা চায়নি। তারা নারী স্বাধীনতাকে ভয় পায়। উপড়ে ফেলতে চায় নারীর অধিকার। তাই কখনো নারীর পোশাকে, চলনে, ঋতুমুখী হওয়ার দোষ খুঁজে বেড়ায়। ভৌগোলিক দূরত্ব যাই হোক এরা আসলে একই।
ধর্ম আর ধর্মান্ধতা এক নয়। ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারকে সুযোগ দিলে ধর্মেরই ক্ষতি। এরা ধর্মের কেউ নয়, ধর্মের নামে মিথ্যে বয়ানকারী। আর তাই এরা অবলীলায় বলতে পারে ভূমিকম্পের জন্যে দায়ী নারী! শস্যহীনতা, খরা, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য নারীকে দায়ী করে।
এইসব কুসংস্কারাচ্ছন্ন মৌলবাদীদের অন্যরা ব্যবহার করে তাদের ক্ষমতা আর বাণিজ্যিক স্বার্থে। এরাও চায় ক্ষমতার অংশ হতে। প্রকৃত ইসলাম চায় না। এদের চাওয়া দীন নয়, দুনিয়া। এই মৌলবাদীরাও ভালোভাবে জানে, লোকে প্রকৃত ইসলাম জানলে তাদের আর কোন স্থান নেই সমাজে, তারা নিক্ষিপ্ত হবে নর্দমায়, আস্তাকুঁড়ে। তাই যতদিন লোকে ধর্ম জানবে না, ততদিনই লাভ তাদের। ততদিনই তারা সত্যের মত করে মিথ্যে বয়ান চালিয়ে যেতে থাকবে, পারবে।
চাই প্রকৃত ইসলাম লোকে জানুক, মানুক, চর্চা করুক জীবনে, তবেই এসব ধর্মীয় মৌলবাদীদের অপচর্চা বন্ধ হবে দুনিয়াজুড়ে।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/এমএস