কেবল পুরুষরাই কি পুরুষতন্ত্রকে চাপিয়ে দিচ্ছেন?
ভীষণ পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে ‘নারীবাদ’ একটা ছোটখাটো গালি।‘সন্ত্রাস’ যেমন একটা নেগেটিভ ওয়ার্ড, নারীবাদের চর্চা করতে গিয়ে দেখবেন এটাও পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে গালি হিসেবেই বেশিরভাগ উচ্চারিত হয়। এদেশের মোটামুটি সাহিত্য অঙ্গনের মানুষজনকেও ইন্টারভিউতে বলতে শুনেছি, ‘এই দেশে তো নারীবাদ বলতে ছোট্ট একটা বিষয় তারা (নারীবাদী) তাদের নিজেদের মতো করে নিয়েছে’। তাহলে বৃহত্তর অর্থে নারীবাদ কি ? সেটা কি আমাদের দেশে চর্চার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে ? আগে তো সাম্য হোক, তারপর না সমতা ? নারীর টুঁটি চেপে ধরতে ধরতে, নারীর সামাজিক অবস্থান, শ্রম ও মেধাকে এই সমাজ অস্বীকার করে। এখন নিশ্চই কথা আসতে পারে, ওই যে অমুক নারী? সে তো খুব স্বাধীন ! তার পরিবারও তাকে সাপোর্ট করে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু জানবেন, সেই নারীর সংখ্যা হাজারে একজন, তিনি সমাজে প্রতি পদক্ষেপে বৈষম্যের শিকার নারীর প্রতিনিধিত্ব করেন না।
কুতর্ক কখন আসে? যখন কোনো বৈষম্য দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, তবু লোকে সেটাকে স্বীকার করতে চায় না, তখন কুতর্ক করতে থাকে। নারীবাদ সেই কুতর্কে সজোরে চপেটাঘাত করে বলেই নারীবাদ অসহ্য। আমরা নারীবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু নারীবাদ কি পুরুষ বিদ্বেষ? কেবল পুরুষরাই কি পুরুষতন্ত্রকে চাপিয়ে দিচ্ছেন? আসলে ব্যাপারটি তা নয়। একজন নারীও ভীষণ রকম পুরুষতান্ত্রিক হতে পারেন, একজন পুরুষও শিকার হন পুরুষতন্ত্রের।
যে পুরুষ ভয়াবহ নিষ্পেষণের শিকার, হোক পরিবারে বা কাজের জায়গায়, অলিখিত নিয়ম, তিনি মন খারাপ করতে পারবেন না, কাঁদলে তো তার পৌরুষত্বই আর থাকে না! কিন্তু এমনটা কেনো হবে ? তিনি কি পুরুষতন্ত্রের শিকার নন? সমাজ ঠিক করে দিয়েছে, পুরুষ কাঁদবে না, ‘মেয়েদের মতো করে কাঁদবে না’। কান্না কেবল নারীর, এটা কি পুরুষতন্ত্র নয় ? নারীবাদ একটি আন্দোলন, যা পুরুষ ও নারীকে মানুষের কাতারে দাঁড় করায়। সমান ভাবতে শেখায়। নারীর শ্রম অবমূল্যায়ন করাকে চ্যালেঞ্জ করে নারীবাদ। সংসার ও কর্মক্ষেত্রে দুটো ব্যালান্স করতে নারীর যে অমানবিক যুদ্ধ, সে যুদ্ধে নারীর ত্যাগ ও অবদমনকে সামনে নিয়ে আসে নারীবাদ। রাষ্ট্রে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্তগ্রহণে সমভূমিকা রাখার ক্ষেত্র তৈরি করে নারীবাদ।
রোজকার কথা যদি বলি, ভোর হওয়ার আগেই কোন টেনশানে আপনার ঘুম ভেঙে যায় বারবার? বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাতে হবে, নাস্তা রেডি করতে হবে, তাইতো? আপনার বর এই টেনশান কয়দিন করেছে? যতই আপনার সারারাত ঘুম না হোক, আপনি ভীষণ অসুস্থ হোন, দায় কিন্তু আপনার। এটা আপনার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। সারাদিন আপনি ও আপনার বর অফিস করে বাড়ি ফিরলেন, বাসায় ঢুকে শুনবেন, আপনার বর খুব ক্লান্ত! সারাদিন অফিসে অনেক কাজের চাপ ছিলো, তাড়াতাড়ি চা-নাস্তা বানাতে বসে যাবেন। আর আপনি তো সারাদিন ফুরফুরে বাতসে বাইরে ঘুরে এলেন। নারীর কাজ স্ট্রেইট ওয়েতে ডাবল। তবু আপনি চাকরিজীবী নারী, আপনি সারাক্ষণ বাইরে থাকেন, একথা আপনাকে শুনতেই হবে। বাচ্চা স্কুলে রেজাল্ট খারাপ করছে? দায় কার? আপনার। আপনি যে সারাক্ষণ ‘বাইরে’ থাকেন, বাচ্চাকে সময় দিতে পারেন না।
এখানে আপনার বরকে নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। আরও বড় প্রহসনের কথা বলি, ধরেন আপনার ঘরে অসুস্থ শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন, আপনি অবশ্যই তাদের দেখভাল করবেন। কিন্তু পারিবারিকভাবে সবসময় আপনাকে একটা চাপে রাখা হবে, বলা হবে আপনি শ্বশুর-শাশুড়িকে ঠিকমতো দেখেন না। অথচ তারা যার বাবা-মা সে যদি ঠিকমতো নিজের বাবা-মায়ের দেখভাল করে, তাহলে কিন্তু প্রথমত সেই বাবা-মা দারুণ যত্নে থাকেন, আর তার পাশাপাশি আপনি তো আছেনই। কিন্তু দেখবেন অতি সুকৌশলে বহুযুগ ধরে এই দায় পুরোটা আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে এই শ্রেণি নির্ভার ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আপনার দোষত্রুটি বিচার করছে। নিজের বাবা-মায়ের দায়টুকুও নেয়ার জন্য এই সমাজ তাদের অভ্যস্থ করেনি। আর তাইতো সমাজে বৃদ্ধাশ্রমের এত ছড়াছড়ি।
আপনি বন্ধুর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলেন, ঘোরতর অপরাধ করেছেন, আপনার বন্ধু থাকবে কেনো? বা সেখানে কতোটা সময় দিলেন, সব আপনার বরের রেজিস্টারে লেখা থাকবে। কিন্তু আপনার বর হাজার বান্ধবী নিয়ে ঘুরে বেড়াক, তাদের সাথে এখানে সেখানে বেড়াতে যাক, যতই তুমুল প্রশংসা বা গল্প জমুক, ওখানে উঁকি দেয়া মানা। ওসব নিয়ে প্রশ্ন করবেন? তখন ওই বন্ধুরা সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত, আর আপনি কে? গেঁয়ো ভূত, ছোট মানসিকতার। তাদের বন্ধুত্বের সব রকম প্রকাশ আপনাকে হজম করতে হবে, নইলে আপনি কিসের আধুনিক? সংসারে যেমন কন্যাটির আগে আপনি পুত্রটির কথা ভাবেন।
পুত্রের সব বিষয়ে ‘হ্যাঁ’ আর কন্যার সব বিষয়ে সেন্সর দেন এটাই পুরুষতন্ত্র। কন্যা সন্তানটিকে স্থবির জীবনে অভ্যস্ত করে কঠিন কোড অব কন্ডাক্টে যখন বেঁধে ফেলেন, সেটাই পুরুষতন্ত্র। যা আপনি আমি আমাদের চারপাশ সযত্নে লালন করছি নিজের ভেতর। এই যে নারীকে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়, এগিয়ে যাওয়া নারীকে ধারণ করার ক্ষেত্র কি তৈরি হয়েছে? এগিয়ে যাওয়া নারীকে সহ্য করতে আপনারও রক্তের মধ্যে জ্বলে। এটাই পুরুষতন্ত্র। তাই নারীবাদটাকে তারা গালির মতো করে উচ্চারণ করেন।
বস্তুত নারীবাদ হচ্ছে, আপনার মায়ের সম্মানজনক জীবন, আপনার বোনের আত্মমর্যাদার সাথে বেঁচে থাকা, আপনার স্ত্রী বা বন্ধুর সাথে আপনার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার যে জীবন, খুব সহজ অর্থে সেটাই কিন্তু নারীবাদ।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
এইচআর/এমকেএইচ