বাংলাদেশে করোনাভাইরাস : এ দায় কার?

মিলি সাহা
মিলি সাহা মিলি সাহা
প্রকাশিত: ১২:৩১ পিএম, ১৯ মার্চ ২০২০

যে মরণ ভাইরাসে গত দু’মাস যাবৎ গোটা বিশ্ব আক্রান্ত সেই করোনার উৎপত্তিস্থল ছিল চীনের উহান প্রদেশ; যেখানে অসংখ্য মৃত্যু কাঁদিয়েছে সবাইকে। সেই পথেই চলছে ইতালি। বলা হচ্ছে সেসব দেশে অভ্যন্তরীণ সংক্রমণের উৎস তৈরি হয়েছে। গবেষণা বলছে, ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম তাপমাত্রায় এই ভাইরাস ছড়ায় এবং ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভাইরাসটি মারা যায়।

দেশজুড়ে ক্ষীণ আশা ছিল, চীন যেহেতু উৎসটি বন্ধ করতে পেরেছে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় গ্রীষ্মকাল শুরু হয়েছে, হয়ত আমরা বড় কোনো ঝুঁকি এড়াতে পারবো। হয়েছেও তাই; গত দু'মাসে এদেশে উল্লেখযোগ্য কোনো সংক্রমণ ছিল না এবং চীন ফেরত উহান প্রদেশের বাঙালি প্রবাসী ও ছাত্র-ছাত্রীদের সরকার 'প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্গরোধ' বা 'ইনস্টিটিউশনাল কোয়ারেন্টিন' এর মাধ্যমে কঠোর ভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল।

যদিও সাধারণ মহলে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল এদেরকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে। মূলতঃ পশ্চিমা দেশগুলোতে, বিশেষ করে ইউরোপে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর পরই এদেশের সরকার চাপের মুখে পড়ে, যেহেতু সেসব দেশে অসংখ্য প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিক বা কর্মী রয়েছেন। অবশ্যই তারা এই সংকটে দেশে ফেরত আসতে পারেন বা নিরাপদে থাকার অধিকার রয়েছে তাদের। সরকারের দায়িত্ব তাদের প্রত্যেককে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করা। সেটিই করা হয়েছে যা অন্য সকল দেশই করেছে।

কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে যে সুবিধাটুকু আমরা পেয়েছিলাম, সেইটুকুকে কি আরো একটু বিস্তৃত করা যেত না? প্রত্যেক প্রবাসীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্গ-রোধ এবং গভীর-পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা কি করা যেত না? স্কুল-কলেজ বন্ধ করে হলেও জায়গা করা উচিত ছিল এবং তাতে করে কমিউনিটি-ট্রান্সমিশন আরো কমানো যেত। প্রয়োজনে আরো আগেই লক-ডাউন করা যেত। বিশেষ করে গত দু-সপ্তাহে যত জন প্রবাসী ফেরত এসেছেন, তারা সবাই ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়ে এসেছেন। এমনকি তাদের সঙ্গে-রোধের কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা করার সুযোগও হয় নি। যে কারণে করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনও সম্পূর্ণ ঢাকা কেন্দ্রিক, যেটি কোনো ভাবেই কাম্য নয়।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ, ঢাকার বাইরে বা ভেতরে এমন অনেক রোগী আছেন যারা করনার প্রাথমিক লক্ষণ সমূহ বহন করছেন, কিন্তু শুধু মাত্র আইইডিসিআর থেকে পরীক্ষা করতে হবে বলে করতে পারছেন না বা করছেন না! তাছাড়াও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর রোগীরা জানেনই না আইইডিসিআর কি বা কোথায়? স্থানীয় ও বেসরকারিভাবে এই রোগের সনাক্তকরণ এবং পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থাও করা যেত এতোদিনে। এটি একটি বড় দায়িত্ব ছিল সরকারের।

সবচে' বেশি যে বিষয়টি সাধারণ মানুষকে আতংকিত করছে তা হলো ঋতু পরিবর্তনের কারণে সাধারণ ঠাণ্ডা-জ্বর বা কাশি। এই জ্বরে আক্রান্ত অনেককেই ডাক্তার বা অন্যরা সাহায্য করছে না বা স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালগুলিও সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী চিকিৎসার দায়িত্ব নিচ্ছে না। এতে করে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে, সরকারি ব্যবস্থাপনায় আস্থা কমছে এবং আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। রয়েছে বিচ্ছিন্ন বা এক ঘরে হওয়ার ভয়। অথচ এসব প্রতিরোধ করার জন্য আমরা দু’টো মাস সময় পেয়েছিলাম।

এছাড়াও, করোনা সনাক্ত করণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্ভাবন বা বিপণনের যে ব্যবস্থার কথা আমরা এখন শুনছি, সেটি সরকারি অর্থায়নে আরো একমাস আগেই হতে পারতো যেহেতু সরকারের পরিকল্পনা ছিল ফিরতে ইচ্ছুক প্রায় সকল প্রবাসীকে সুযোগ দেয়া হবে, যেটি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত দেয়নি। তারা আমাদের আগেই লক-ডাউন করেছে এবং অনেক আগেই কয়েকটি রাজধানীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেছে। হতাশার বিষয়টি হলো লোক-ডাউন করার পর প্রায় দেড় হাজার প্রবাসী সরকারের কোনো প্রস্তুতি এবং অনেকটা অনুমতি ছাড়াই দেশে প্রবেশ করেছেন!

এবার আসি সাধারণ মানুষের কথায়। গত দু'দিন বিভিন্ন পত্রিকা আর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রধান আলোচ্য ছিল এই সংকট কালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সুযোগে লোকজনের ছুটির আমেজে সারা দেশের বিনোদন কেন্দ্রগুলিতে ছড়িয়ে পড়া। অনেকেই ভাবছেন এটি শুধু বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তি বা প্রবাসীদেরই সমস্যা। অথবা তাদের সংস্পর্শে না গেলেই চলবে! এই ভাইরাসের ভয়াবহতা ও প্রতিরোধ বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি প্রচারণা হাত-ধোয়া ও মাস্ক পরার মধ্যে সীমিত রাখার সুযোগ নেই।

সংক্রমণের মাধ্যম নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জোর চেষ্টা করতে হবে।এখনো ওয়াজ-মাহ্ফিল, দোয়া-মাহফিল হচ্ছে লাখো মানুষ নিয়ে। কি ভয়ঙ্কর! জড়িত স্থানীয় প্রশাসনকে অবশ্যই এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম গুলিতে সাধারণ মানুষে একে অন্যকে সচেতন করার চেষ্টা করছে, সেটি খুবই প্রশংসনীয়। এছাড়াও শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সমগ্র জাতি যার যার জায়গা থেকে এই সংকট কাটাতে যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে তা আশাব্যঞ্জক।

তবে যেটি বাকি সব কথার কারণ, তা হলো সদ্য ফেরত প্রবাসীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে হোম-কোয়ারেন্টিন মেনে চলার ক্ষেত্রে করা অনিয়ম। তাদেরকে অবশ্যই ভাবতে হবে এদেশে করোনার সংক্রমণ তারাই বয়ে নিয়ে এসেছেন এবং সেটি শুধু দেশ নয়, তার পরিবার এবং সমাজের জন্যও মারাত্মক হুমকি। বিভিন্ন কারণে এদেশের মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, দারিদ্র্রের কারণে অপুষ্টিতে ভোগেন, নেই স্বাস্থ্য-সচেতনতা ও সুব্যবস্থা। এমন একটি দেশে সরকারি নিষেধ অমান্য করে স্বার্থপরের মতো তারা যা করছেন, সেটি দেশের মানুষ কেন মেনে নিবে? হাসপাতাল থেকে পালাচ্ছেন, বিয়ে করছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন ইত্যাদি! তার ওপর রয়েছে ঔদ্ধত্য ও অসহযোগিতা।

তারা বারবারই বলছেন দেশের বাইরে তাদের পরীক্ষা করা হয়েছে কিন্তু ট্রানজিট থেকে আসার পথে যে তারা আক্রান্ত হবেন না বা সাথে বহনকৃত কোনো বস্তু থেকে যে তারা সংক্রমিত হবেন না, সেটি কে বলবে? এদেশের মানুষ ও চিকিৎসকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের সেবা করছে সেই বিমানবন্দর থেকে শুরু করে এই অব্দি, সেটি কি তারা চাইলেই এড়াতে পারতেন না? ইতোমধ্যে বেশ ক'জন ডাক্তার সংক্রমণ সন্দেহে কোয়ারেন্টিনে গিয়েছেন।

কোথায় প্রবাসীরা তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবে, উল্টো সবাইকে ভয়ঙ্কর ঝুঁকিতে ফেলছেন। এমনকি ইতালিতে আইন ভেঙে বাইরে আসার দায়ে কয়েকজন বাংলাদেশী আটক হয়েছেন। এ তো রীতিমতো অন্যায়! কি চাইছেন তারা? এখন পর্যন্ত দেশে যত জন আক্রান্ত হয়েছেন বা মৃত্যুবরণ করেছেন, সবাই হয় প্রবাসী না হয় তাদের মাধ্যমে সংক্রমিত। এমনকি স্কুলের শিশুরাও তাদের বাচ্চাদের মাধ্যমে আক্রান্ত হচ্ছেন। তারপরও কি দায় অস্বীকার করবেন?

প্রবাসীদের যেমন দেশে ফেরার অধিকার রয়েছে তেমনি দেশে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকেরও নিজস্ব স্বাস্থ্য-নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। তাই সরকারকে আর একটি মুহূর্তও নষ্ট না করে এখনই ভীষণ কঠোর হতে হবে প্রবাসী ও স্থানীয়দের অবাধ চলা-ফেরা ও জমায়েত বন্ধের ক্ষেত্রে। কয়েক স্তরে নজরদারি বাড়ানো হোক। কঠোর ভাবে অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ ও বহিঃগমণ বন্ধ করতে ঘবে; অফিস-আদালত বন্ধ করার উপযুক্ত সময় এখনই। প্রয়োজনে ১৪৪ ধারা জারি করা হোক।

চীন ও দক্ষিণ কোরিয়াকে দেখে আমাদের শেখা উচিত; মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে উহানকে বহির্বিশ্ব ও চীনের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে কত দ্রুত তারা সফল হয়েছে। তাই আরো বড় কোনো ক্ষতি হওয়ার আগেই দেশের প্রতিটি অঞ্চলে করোনা সনাক্ত করণ কেন্দ্র, জরুরি চিকিৎসা ও পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ১৬ কোটি মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য অধিকার নিয়ে বার বার গাফিলতি করার সুযোগ নেই।

সরকারের সকল পরিকল্পনার পাশাপাশি প্রতিটি স্থানীয় ও প্রবাসী বাংলাদেশির নিজেকে, পরিবারকে ও সমাজকে এই ভয়ঙ্কর ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। একটি জীবনও যেন কারো অবহেলায় নষ্ট না হয়, সে হোক সরকার, স্থানীয় বা প্রবাসী!

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।