করোনা মোকাবিলায় সেনাবাহিনী

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ গত ১ এপ্রিল সচিবালয়ের একটি সভা শেষে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বুদ্ধিমান নেতৃত্বে সেনাবাহিনী যথাসম্ভব কাজ করছে।’ তার বাহিনী এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। তিনি আরও বলেন, ‘সেনাবাহিনী যতক্ষণ সরকার চাইবে ততক্ষণ নাগরিকসেবায় সহায়তা প্রদান করবে।’ করোনার ধাক্কায় গোটা বিশ্ব যখন দিশেহারা তখন বাংলাদেশ পরিস্থিতি সামলে চলেছে দৃঢ়চিত্তে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৩১ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ২৪ মার্চ থেকে দিনরাত কাজ করছেন। দেশের মানুষকে বাসায় ঢুকিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ সচেতনতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তারা।
বাংলাদেশে ৮ মার্চ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংবাদ পাওয়ার পর শেখ হাসিনা দ্রুত নানামুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি দেয়া, দেশের বিভিন্ন স্থান লকডাউন করা, তিনদফা সরকারি ছুটি বাড়িয়ে ১৪ এপ্রিল করা, করোনাভাইরাস আক্রান্তদের জন্য টেস্টের আওতা বৃদ্ধি, সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি, লোকজনকে নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করানো, কোয়ারেন্টাইনে রাখতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ- এসব পদক্ষেপ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে জরুরি ছিল। কিন্তু এসব ব্যবস্থার সঙ্গে ২৪ মার্চ থেকে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার জন্য সেনাবাহিনী নামানো ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেনাবাহিনীর প্রায় তিন হাজার এবং নৌবাহিনীর ৪০০ সদস্যকে মোতায়েন করা হয়েছে।
অন্যদিকে বিমানবাহিনী মেডিকেল এইডের কাজ করছে। সে সময় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) থেকে জানানো হয়, ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের সমন্বয়ে সেনাবাহিনী করোনাভাইরাস সংক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাব্যবস্থা, সন্দেহজনক ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা পর্যালোচনা করবে। বিশেষ করে বিদেশফেরত ব্যক্তিদের কেউ নির্ধারিত কোয়ারেন্টাইনের বাধ্যতামূলক সময় পালনে ত্রুটি/অবহেলা করছে কি-না, তা পর্যালোচনা করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা স্থানীয় আর্মি কমান্ডারের কাছে অবস্থা পর্যালোচনার জন্য আইন অনুসারে সেনাবাহিনীর কাছে অনুরোধ জানাবেন। নৌবাহিনী উপকূলীয় এলাকায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় কাজ করবে। বিমানবাহিনী হাসপাতালের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী ও জরুরি পরিবহন কাজে নিয়োজিত থাকবে।’
এর আগে আমরা মনে করতাম সশস্ত্র বাহিনী জনমনে ভীতি সৃষ্টি করে, মনে করতাম- তাদের কাজ যুদ্ধের মাঠে, শান্তি স্থাপনের জন্য কঠোর হস্তে বিশৃঙ্খলা দূর করা এবং বন্দুক উঁচিয়ে সবসময় জনগণকে শাসন করা। কিন্তু বিস্ময়করভাবে আমরা দেখতে পেলাম, সেনাবাহিনী ২৪ মার্চ থেকে গ্রামে-গঞ্জে, মাঠে-বাজারে মাইকিং করছেন জনগণকে করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করার জন্য, সাধারণ মানুষকে মাস্ক পরিয়ে সাহায্য করছেন। অস্ত্র উঁচিয়ে যুদ্ধের ময়দানে নয় বরং নিজের জীবন বাজি রেখে অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে মানুষের জীবন বাঁচাতে দায়িত্ব পালন করছেন।
অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাসদস্যরা মাঠে নামার আগে ১৯ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী সেনা পরিচালনায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের কথা জানিয়েছিলেন। ঢাকা বিমানবন্দর সংলগ্ন আশকোনা হজক্যাম্প ও উত্তরার পাশে দিয়াবাড়ীতে কোয়ারেন্টাইনের দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয় সেনাবাহিনীকে। তবে হাজি ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে এর আগেই ছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু বিদেশফেরতদের হোম কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক করার পরও বিভিন্ন জেলায় তাদের বাইরে বের হওয়া তথা জনসম্পৃক্ততা ঠেকানো যাচ্ছিল না। এ জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে মাঠ পর্যায়ের কাজে সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে সহায়তা প্রদান করা। অর্থাৎ বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টাইন শতভাগ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করেছে।
লেখাবাহুল্য, সেনাসদস্যরা সারাদেশেই করোনাভাইরাস সম্পর্কিত জনসচেতনতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছেন। প্রত্যন্ত এলাকায় উপস্থিত হয়ে যাদের হোম কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনে থাকার কথা তাদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখছেন। সামাজিক দূরত্ব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে মাঠে-ঘাটে সার্বক্ষণিক তদারকিতে আছেন। সাধারণ জনগোষ্ঠীকে মাইকিং করে নিয়মিত হাতধোয়া, মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ বিবিধ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অনুরোধ জানাচ্ছেন। কোনো এলাকায় রোগে আক্রান্তদের যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসাসেবা প্রদানে যেমন সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করে দিয়েছেন তেমনি পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার জন্য তাদের তরফ থেকে জীবাণুনাশক ছিটানো হচ্ছে।
আসলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী সেনাবাহিনী কেবল আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে দৃষ্টি দেননি তারা স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছেন। যেমন দুস্থদের ত্রাণকাজে অব্যবস্থাপনা দূর করার জন্য সহযোগিতা করছেন তেমনি কেউ নিয়ম ভঙ্গ করলে কিংবা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলে তা ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে তাৎক্ষণিক বিচার করে শাস্তি প্রদান করা হচ্ছে। চরাঞ্চল কিংবা পাহাড়ি উপত্যকায় বাজার চালু রাখা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা, গরিবদের মধ্যে খাবার বিতরণে সহায়তা করা, বিভিন্ন ধরনের গুজব ও অসত্য তথ্য যাতে বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখার কাজও তাদের করতে হচ্ছে।
১ এপ্রিল আইএসপিআর থেকে পুনরায় বলা হয়, সরকার প্রদত্ত নির্দেশাবলি অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ফলে ২ এপ্রিল থেকে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সেনাবাহিনী। আমাদের মধ্যে ৮৮ জন আক্রান্ত হওয়ায় করোনা পরিস্থিতির ব্যাপক বিস্তাররোধে কাজ করছে সেনাবাহিনী। আসলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার সঙ্গে জনসাধারণের আন্তরিক অংশগ্রহণকে সম্ভব করে তুলছেন সেনাসদস্যরা।
এ কথা সত্য সাধারণ মানুষের মাঝে সেনাসদস্যদের উপস্থিতি ও সহায়তার কারণে গণ-মনস্তত্ত্বে স্বস্তি এসেছে। কারণ করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ জুড়ে কাজ করায় আইন-শৃঙ্খলারও উন্নয়ন ঘটেছে। অন্যদিকে যাদের নিযুক্ত করা হয়েছে তারা প্রয়োজনে ও জরুরি পরিস্থিতিতে চিকিৎসাসেবা দিতে প্রস্তুত বলেই অনেক জায়গায় তাদের চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালনা করতে দেখা যাচ্ছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেমন চিকিৎসক, নার্সসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মী করোনা মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তেমনি সেনাসদস্যরা নিজেদের পরিবারকে পেছনে ফেলে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন।
জেনারেল আজিজ বলেছেন, সরকার যেদিন বলবে আমরা চলে আসব। আর যত প্রয়োজন তত সেনাসদস্য দেয়া হবে। অতিরিক্ত সেনাসদস্যের কার্যক্রমে মানুষের মধ্যে কোনো আতঙ্ক সৃষ্টির কারণ নেই।
ধন্যবাদ জেনারেল, পাশে থাকুন এভাবেই। আসলে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত এবং যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় পারঙ্গম আমাদের সেনাবাহিনী সময়োপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলেই দিশেহারা ইউরোপ-আমেরিকার তুলনায় এখনও অনেক ভালো অবস্থায় আছি আমরা।
লেখক : বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট
সাধারণ সম্পাদক, প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম
এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/বিএ/পিআর