জাঁদরেল চোর ও সিঁধেল সাংবাদিক

করোনার কারণে সাধারণ মানুষের জীবন দিনকে দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আয় নেই, রোজগার নেই। রুটি-রুজির ব্যবস্থাও নেই। তারা দিন আনে দিন খায়। এই ঢাকার বুকেই কয়েক লাখ দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষ কিছু না কিছু একটা কাজ করে রুটি রুজির ব্যবস্থা করত। তাদের কোনো আনুষ্ঠানিক কাজ নেই, নেই কোনো নিয়োগপত্র, বোনাস, উৎসবভাতা ইত্যাদি। এরা সবাই ভ্রাম্যমাণ কর্মজীবী। এখন সবই বন্ধ।
কথায় আছে, বিপদ কখনো এক আসে না, আরও বালা-মুসিবত সঙ্গে করে নিয়ে আসে। আর সেই বিপদ যদি হয় মহামারির বিপদ তাহলে তো কথাই নেই। বর্তমানে বিশ্বে যে মহামারি হানা দিয়েছে সেটি কোনো মামুলি রোগ-বালাই নয়। এটা বৈশ্বিক মহামারি। পুরো বিশ্বেই একসঙ্গে আক্রমণ চালাচ্ছে। এটি একটি অতি মহামারি।
মহামারি দীর্ঘ হলে এর সঙ্গে যোগ হয় ক্ষুধা। কাজেই মহামারি দুধারি তলোয়ার। রোগে মারে, ভাতেও মারে। মহামারি যে কাউকেই আক্রমণ করতে পারে। কেউ কাবু হয়, কেউ হয় না। কেউ মারা পড়ে, কেউ বা সুস্থ হয়ে জীবন পায়। মহামারির কাছে ধনী-গরিব সবাই সমান। কিন্তু মহামারি পাশাপাশি সমাজের একটি শ্রেণির পেটেও লাথি মারে। এই আক্রমণের প্রথম শিকার হয় দিনমজুর, নিম্নবিত্ত মানুষ। ধনী-টাকাওয়ালারা এই ধরনের আক্রমণের বাইরে থাকেন। তবে দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভিক্ষে ধীরে ধীরে সমাজের ওপরওলারাও আক্রান্ত হন।
আমাদের দেশে এখনও শুধু নিম্নবিত্ত ও মুটে-মজুর শ্রেণিটিই ক্ষুধার এই প্রাথমিক পর্যায়ের আক্রমণের শিকার হয়েছে। এদের এখন কোনো কাজ নেই, পকেটে পয়সা নেই, ঘরে খাবার নেই। এরা এখন ত্রাণের জন্য ধরনা দিচ্ছে স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার ও কাউন্সিলরদের কাছে। সেখানেও প্রশ্ন- এরা কি ভোটার? প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর এখন ভোটার না হলেও ত্রাণ পাবে। এছাড়াও সমাজের আরেকটি শ্রেণি আছে যারা কারও কাছে হাত পাততে পারেন না। এরা এখন লোকলজ্জার ভয়ে ঘরেই অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন।
মহামারি যেমন সঙ্গে নিয়ে আসে ক্ষুধা। তেমনি মহামারি সময় সমাজে নতুন একটি শ্রেণিরও উদ্ভব হয়। আসলে উদ্ভব হয় না, এরা সমাজে সুপ্তাবস্থায় থাকে। মহামারির সময় এরা কেবল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সরকার মহামারিরোধে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে, মানুষের ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাদ্যেরও ব্যবস্থা করে। ত্রাণ দিয়ে সরকার মানুষের পাশে দাঁড়ায়। ঠিক এমন সময়েই এই শ্রেণিটির আবির্ভাব হয়। তারা সরকারি ত্রাণ- চাল, তেল, নুন চুরির মচ্ছবে মেতে ওঠে। এরা সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১০ টাকা কেজির চাল গরিব মানুষকে না দিয়ে নিজের গুদামে মজুত করে রাখে। এই ত্রাণ যাদের হাত দিয়ে মানুষের হাতে পৌঁছে দেয়ার কথা, সরকার যাদের হাতে এই আমানত তুলে দিয়েছে, সেই আমানতের খেয়ানত করতে এদের একটুও কসুর নেই। গণমাধ্যমে প্রকাশ, এ পর্যন্ত প্রায় ১০ জন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ১২ জন সদস্যকে এই ত্রাণ চুরির অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
আমাদের সম্পদ সীমিত, কিন্তু জনসংখ্যা বেশ। ভাইরাসের মতো মহামারি খুব সহজেই আমাদের কাবু করতে পারে। যদিও আশার কথা আমেরিকা বা ইউরোপের মতো খারাপ অবস্থা আমাদের এখনও হয়নি। বেশি জনসংখ্যা বলে দুর্ভিক্ষের সময় এত মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়াও কঠিন। কিন্তু তারপরও সরকার পিছপা হয়নি। রাষ্ট্র তার ত্রাণভাণ্ডার খুলে দিয়েছে। লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ দুস্থ মানুষের জন্য রেশনকার্ড করে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিদ্যমান ৫০ লাখের বাইরে এ হিসাব। আর এ সুযোগেই চোরদের বাড়বাড়ন্ত। তাদের চৌকির তলা তেলে, বৈঠকখানা চালে সয়লাব।
প্রধানমন্ত্রী এই চোরদের ধরতে বলছেন। হুঁশিয়ার করেছেন। তিনি বলেছেন, যার অবস্থা খারাপ, যিনি দুস্থ, যার ঘরে খাবার নেই, তার ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে হবে। এই কঠিন সময়ে এর চেয়ে ভালো, স্বস্তির কথা আর কী হতে পারে। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী।
সরকারের জন্য এ এক কঠিন সময়। একদিকে সরকারকে রোগের মহামারি রোধ করতে হচ্ছে, খাদ্যের সংস্থান করতে হচ্ছে আবার একইসঙ্গে চুরির মহামারিও ঠেকাতে হচ্ছে। ওদের চুরি-চামারি থামাতে না পারলে এখনও যারা গর্ত থেকে বের হয়নি তারাও চোরের খাতায় নাম লেখাবে। কাজেই চালের বস্তা ঠিকঠাক রাখতে ইঁদুরকে গর্ত থেকে বের হতে দেয়া যাবে না। আর যেগুলো বের হয়ে গেছে, চালের বস্তার আশে ঘোরাঘুরি করছে, সেগুলোর জন্য ইঁদুর মারার কলই ওষুধ। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকলে ইঁদুর পালাবে।
‘চোরের মায়ের বড় গলা’ বলে একটা কথা প্রচলিত ছিল আমাদের সমাজে। এদেশে এখন আর চোরের মা-বাপ নেই। সাফাই গাওয়ার জন্য নিজের গলাই যথেষ্ট। চুরিরও মা-বাপ নেই। যা খুশি তাই চুরি করা যায়। সব হজম হয়। রাষ্ট্রের মাল, গরিবের হক হলে তো কথাই নেই। এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই। কিন্তু চুরির কথা রাষ্ট্র হলেই গোস্বা। ফলে চুরি ও আত্মসাতের খবর প্রকাশ করতে গিয়ে সংবাদকর্মীরাই হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হন। সম্পাদকই হন সবচেয়ে বড় বিবাদী। কথায় বলে, ‘ভালোবেসে আমি অপরাধী/ তুমি বাদী, আমি বিবাদী’।
বহুদিন আগের কথা। গৃহস্থের বাড়িতে রাতে চুরি হয়েছে। পরদিন সকালে ইউনিয়ন পরিষদের মাঠে সালিশ। চেয়ারম্যান পেয়াদাকে দিয়ে গৃহস্থকে খবর দিলেন। খবর পেয়ে গৃহস্থ তো মহাখুশি। যাক, এইবার বুঝি চোর ধরা পড়েছে। গৃহস্থ তড়িঘড়ি করে সালিশে উপস্থিত। গিয়ে দেখেন সন্দেহভাজন চোর আগে থেকেই হাজির। কারণ, গ্রামে চোরদের কমবেশি সবাই চেনে। ঘুরে ফিরে ওরাই চুরি করে। গৃহস্থ চোর দেখে আরও খুশি। প্যাদানি খেলে বেটা সুরসুর করে সব মাল বের করে দেবে!
কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব চোরকেই জিজ্ঞেস করলেন, বল তোর কী অভিযোগ? গৃহস্থের তো মাথায় হাত। চোরের আবার কী অভিযোগ? কই দু-চার ঘা ব্যাটার জায়গা মতো দেবে, তা না করে বলে চোরের কী অভিযোগ।
চোর বললো, ‘হুজুর, রাতে ওনার বাড়িতে চুরি করতে গেছিলাম। সব ঠিকঠাকই ছিল। মাল লইয়া আসার সময় খিড়কির দরজা দিয়া বাইর হইতেই দুয়ারে রাখা বদনায় আমি উষ্টা খাই। আমার পায়ে লাইগা বদনা থেকে থেকে পানি পড়ে জায়গা ভিজে যায়। আর আমি পিছলা খাইয়া পইড়া যাই। এই দেখেন হুজুর, আমার পায়ে বুড়া আঙুলটা কী অবস্থা।’
চেয়ারম্যান দেখলেন, ‘আসলেই তো, আহ্হারে কী হাল হয়েছে বেচারা বুড়া আঙুলটার। তোমার মিয়ার আর আক্কেল পছন্দ অইলো না। এভাবে কেউ খিড়কির দরজায় বদনা রাখে!’
সালিশে গৃহস্বামীর কী সাজা হয়েছিল জানা নেই। সে বহুদিন আগের কথা। আগে সবকিছুই ছিল অ্যানালগ। আইনও অ্যানালগ, সাজাও অ্যানালগ। এখন সবকিছুই ডিজিটাল। আগে ছিল জাঁদরেল সাংবাদিক, সিঁধেল চোর। আর এখন জাঁদরেল চোর ও সিঁধেল সাংবাদিক।
লেখক : কলামিস্ট
এইচআর/বিএ/এমএস