বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:৩৪ এএম, ১৮ আগস্ট ২০২০

মর্তুজা হাসান সৈকত

বাংলাদেশের ইতিহাসে ফেব্রুয়ারি, মার্চ, ডিসেম্বর যেমন অশেষ গৌরবের তেমনই আগস্ট হচ্ছে অমোচনীয় কলঙ্ক আর শোকের। ৪৫ বছর আগে এ মাসের ১৫ তারিখ ভোরে সুপরিকল্পিত দেশি বিদেশি চক্রান্তের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

চলতি বছরে উদযাপিত হচ্ছে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত এই নেতার জন্মশতবার্ষিকী। করোনা মহামারিকালে সীমিত আকারে চলমান এই উদযাপনের মধ্যেই এলো শোকের মাস আগস্ট। তাছাড়া এই মাসেই নারকীয় হামলা হয়েছে তারই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। বাঙালি জাতির ইতিহাসের অধ্যায়ে আগস্ট তাই শোকের চাদরে ঢাকা।

একটি মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ককে পরিবারের সকল সদস্যসহ নৃশংসভাবে যেভাবে হত্যা করা হলো এবং এর পরের ঘটনাপ্রবাহ গুলো বিশ্লেষণ করলেই পরিষ্কার হয়ে যায়, কতটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফসল ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড। হত্যাকাণ্ডের মাত্র কয়েক ঘন্টা পরে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার ওয়াশিংটনকে জানান, 'বেলা ১১টা পর্যন্ত অভ্যুত্থানের ঘটনাপ্রবাহ সাফল্যের সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে, ঢাকা বা বাইরে কোথাও কোনো গোলযোগ হয়নি। তবুও আমরা কিছু প্রতিরোধের আশঙ্কা এখনই নাকচ করে দিচ্ছি না।

সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। বেতার মাধ্যমে সেনা, নৌ, বিমান, বিডিআর ও পুলিশ প্রধানরা সরকারের প্রতি অনুগত থাকতে বিবৃতি প্রচার করেছেন।' উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরটিও ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ভয়েস অব আমেরিকা থেকে প্রথম প্রচার করা হয়। অথচ তখনও বঙ্গবন্ধু জীবিত। এর কিছুক্ষণ পর ৬টার কিছু আগে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার প্রায় ত্রিশ মিনিট আগেই মৃত্যুর খবর প্রচার করা হয়। তাহলে কি ভয়েস অফ আমেরিকা আগে থেকেই জানতো ভোর সাড়ে ৫টায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হবে?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরিকল্পনায় আমেরিকা এবং পাকিস্তানের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ছিল বলেই মনে করতেন ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও। আমেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হেনরী কিসিঞ্জারের প্রাক্তন স্টাফ অ্যাসিসটেন্ট রজার মরিসও এ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তিনি ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকে ড. কিসিঞ্জার ও মার্কিন বৈদেশিক নীতি সম্পর্কিত একটি গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্যে কিসিঞ্জারের একজন বিশ্বস্ত প্রবীণ সহকারীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। উক্ত প্রবীণ সহকারী তখন তাকে বলেন, ‘কিসিঞ্জারের আমলে মার্কিন বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে তিনটি ‘নেমেসেস’ (প্রতিহিংসার অধিষ্ঠাত্রী দেবী) ছিল। ড. কিসিঞ্জারের ভাষায় বিদেশি শত্রুর তালিকায় যারা ছিলেন ‘সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি।’ এই তিনজন হলেন চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দে, ভিয়েতনামের থিউ এবং বাংলাদেশের শেখ মুজিব। এরা কিসিঞ্জারের পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিয়েছেন। মরিসের মতে, ‘অপর দুজনের তুলনায় শেখ মুজিব ভিন্ন পর্যায়ে পড়েন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে কিসিঞ্জার তার ব্যক্তিগত পরাজয়ের শামিল ছিল বলে মনে করেন। ’

মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরি ভারতীয় সাংবাদিক পরেশ সাহাকে এক সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, ঘাতক চক্রের সঙ্গে সিআইএর যোগাযোগটা এত ভালো ছিল যে, অভ্যুত্থানের খবর পেয়ে তারা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে পেরেছিলেন। ফিলিপ চেরি স্বীকার করেন যে, তিনি যখন যুক্তরাষ্ট্রে খবর পাঠান, তখনও ঢাকায় অভ্যুত্থান চলছিল। ফিলিপ চেরি অপর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ব্যাপারটা তিনি খুব ভালোভাবেই জানতেন। কিন্তু... চেরি তার কথা শেষ করেননি। সম্ভবত তিনি বলতে চেয়েছিলেন, যা ঘটেছে সে সম্পর্কে সব কিছুই তার আগে থেকেই জানা ছিল। কিন্তু সরকারি গোপনীয়তা রক্ষার জন্য সেসব কথা বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এদিকে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস হত্যাকাণ্ডের তিন দিন আগেই পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট ছুটির দিন ঘোষণা করেছিল। যে ছুটি ছিল তালিকা বহির্ভূত। আর ওই দিনই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।

হত্যাকাণ্ডের দিন হিসেবে ১৫ আগস্ট তারিখটিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল পাকিস্থান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর অনুমোদনক্রমে। কারণ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব আর ভারতের সহযোগিতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জয়লাভকে তারা লজ্জাজনক পরাজয় হিসেবেই নিয়েছিলেন। তাই ভারতের স্বাধীনতা দিবসকেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য নির্ধারণ করা হয় প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে। এর পাশাপাশি তারা ভারতকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছিল। সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক অরুণ ব্যানার্জি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নির্দিষ্ট করে এই ১৫ আগস্ট তারিখটা বেছেই নেওয়া হয়েছিল খুব সচেতনভাবে। ভারতের স্বাধীনতা দিবস ওটা, আর ক্যুর ষড়যন্ত্রকারীরা ভারতকেই একটা মেসেজ দিতে চেয়েছিল।

বার্তাটা ছিল এমন, তোমাদের এত খাতিরের লোক- আর তোমাদের বিশেষ দিনে দেখো এই তার অবস্থা। তাছাড়া তাদের আশঙ্কা ছিল, অন্য কোনো দিনে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে, ভারত-বাংলাদেশের পঁচিশ বছরের শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। ভারত সামরিক অভিযান চালালে তা সামাল দেয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কিন্তু ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতের সরকার, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক বাহিনী ব্যস্ত থাকবে। এমন একটি দিনে তারা প্রতিবেশী দেশে সামরিক অভিযান চালাবে না। তাই কৌশলগত কারণেই এই দিনটিকে চক্রান্তকারীরা বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন হিসেবে বেছে নেয়।

এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র হয়েছিল কলকাতার আমেরিকান কনস্যুলেট হো চি মিন সরণিতে বসেও। যদিও এই ষড়যন্ত্রের সদর দপ্তর ছিল ওয়াশিংটন ও রাওয়ালপিন্ডিতে। সরকারের বিরুদ্ধে এসব দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা বিভিন্ন সময়ে জানানো হলেও বঙ্গবন্ধু এসবে তেমন একটা গুরুত্ব দেননি। তিনি বিশ্বাস করেন নি, কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে। এমনকি হত্যাকাণ্ডের আগের দিনও 'র' এর পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত ২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট দৈনিক কালেরকণ্ঠে প্রকাশিত এক লেখায় উল্লেখ করেন, বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধী ও তাঁর স্ত্রী মেনকা গান্ধীর সাথে ১৯৭৭ সালে তার কথা হয়েছিল। তাঁরা সুখরঞ্জন দাশগুপ্তকে জানিয়েছিলেন, হত্যাকাণ্ডের খবর যখন আসে ইন্দিরা গান্ধী তখনও রাতের পোশাকে। এর মধ্যেই ঘর থেকে বেরিয়ে তিনি লনে ছোটাছুটি করছিলেন আর কাঁদছিলেন। আমাদের দেখে জড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, এখনই ধাওয়ানকে ডাকো, মন্ত্রীদের ডাকো। তাঁকে তখন আমরা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছি; কিন্তু তিনি আমাদের সরিয়ে দিয়ে শুধু বলছিলেন, মুজিব ভাই নেই, মুজিব ভাই নেই। আর বলছিলেন, মুজিব ভাইকে বারবার সতর্ক করেছিলাম, উনি আমার কথা শোনেননি। কিন্তু তাঁকে আমরা থামাতে পারছিলাম না। মুজিব ভাই নেই, মুজিব ভাই নেই— একই কথা বারবার বলে যাচ্ছিলেন।

কিছুক্ষণ পর ধাওয়ান এসে পৌঁছালেন। এলেন বিদেশসচিব জগৎ মেহতা, এলেন সামরিক বাহিনীর প্রধান শ্যাম মানেকশ। ইন্দিরা গান্ধী তাদের বললেন, আপনারা কী করেছেন? আপনারা তো জানতেন, এ ধরনের একটা খবর আমাদের কাছে ছিলো। এলেন ‘র’-এর প্রধান রামনাথ কাউ। কাউকে ইন্দিরা গান্ধী ধমক দিয়ে বললেন, তোমরা কী করেছো? কাউ উত্তরে বললেন, ‘আমরা গতকালও বঙ্গবন্ধুকে বার্তা দিয়েছিলাম। তাঁকে ওই বাড়ি ছাড়তে বলেছিলাম, তিনি আমাদের কথা শোনেননি।’ যা-ই হোক, কেউ তাঁকে থামাতে পারছিলেন না। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেনো তাঁর সহোদর ভাইকে হত্যা করা হয়েছে।

আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছি প্রবীণ মন্ত্রীরা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তখন বিদেশমন্ত্রী ছিলেন ওয়াই বি চ্যাবন। তিনি ইন্দিরাকে বললেন, ‘কয়েক মাস আগে ঢাকায় গিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করে এসেছিলাম। কিন্তু তিনি এতই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে আমাকে বলেছিলেন, জনগণ আমাকে জাতির পিতা হিসেবে মানে এবং শ্রদ্ধা করে, আমাকে কেউ মারবে না, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। তাঁকে মারার জন্য জিয়া-খন্দকার জুটি আমেরিকা ও পাকিস্তানের সঙ্গে সব রকম নীলনকশা তৈরি করেছিলেন। এ কথাও আপনাকে ও বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়েছিলো।’

এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সাথে আন্তর্জাতিক যোগসাজশের আরও একটি অকাট্য প্রমাণ মেলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কিছু সময় পরে ওয়াশিংটন সময় সকাল ৮টায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়ে তড়িৎ সভায় বসায়। নিকট প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আথারটন সভায় বাংলাদেশের ঘটনাবলি সম্পর্কে বলেন, ‘এটা হচ্ছে সুপরিকল্পিত ও নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করা অভ্যুত্থান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেন, ‘আমি ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ (আইএনআর) থেকে আরও ভালো খবর পেয়েছি। তিনি ওই কর্মকর্তার সঙ্গে ওয়াশিংটনে আগেই কথা বলেছিলেন।

কিসিঞ্জারের ভালো খবর হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর। তাছাড়া স্ট্যানলি উলপার্ট তার গ্রন্থে মুজিব হত্যা-ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর জড়িত থাকার দলিলপত্রও হাজির করেছেন। ১৯৭৫ এর জুনে কাকুলের পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে ভুট্টো বলেন, ‘এ অঞ্চলে শিগগিরই কিছু পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।’ স্ট্যানলি উলপার্ট আরও লিখেছেন, দু’বছর যাবৎ ভুট্টো বাংলাদেশের কয়েকটি মুজিববিরোধী দলকে তার গোপন ‘স্বেচ্ছাধীন তহবিল’ থেকে অর্থ সাহায্য অব্যাহত রাখেন এবং আগস্ট মাস (১৯৭৫) শেষ হওয়ার আগেই তিনি তার বিনিয়োগের ফল লাভ করেন। এ হত্যাকাণ্ডটি মূলত ছিলো, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের একটি ধারাবাহিকতার সাফল্য।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নিয়ে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা করেছেন মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ। লিফশুলজ ১৫ আগস্টের হত্যা ষড়যন্ত্র বিষয়ে ‘An Unfinished Revolution’ নামে একটি তথ্যসমৃদ্ধ বইও লিখেছেন। লিফশুলজ এই গ্রন্থে বহু দলিলপত্র ভিত্তিক তথ্য প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে, লেডিস ক্লাবের তুচ্ছ ঘটনার জের হিসেবে শেখ মুজিব নিহত হননি। তিনি প্রমাণ করেছেন, বহু আগেই মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর প্রতিনিধিদের সঙ্গে মুজিব হত্যাকারীরা যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। ঐ গ্রন্থে তিনি তুলে ধরেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজনদের ভেতরে মাহবুবুল আলম চাষী, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, এবিএস সফদার ছিলেন তখন মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর মুখ্য এজেন্ট। সফদার যুক্তরাষ্ট্রে সিআইএর পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত বিভিন্ন স্কুলে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। খন্দকার মোশতাককে বিভিন্ন সময়ে তারা প্রলুব্ধ করেছেন।

লিফশুলজ ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সিআইএর তত্ত্বাবধানে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে প্রধান ভূমিকা পালন করেন জিয়া। জিয়ার সহযোগিতা ছাড়া ওই হত্যাকাণ্ড ঘটতোই না। জিয়া অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কর্নেল রশীদের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেন এবং রশীদকে সব সময় আশ্বস্ত করেন যে, তিনি তাদের সঙ্গে আছেন।’ ১৯৭৭ সালে ইউরোপের একটি শহরে অভ্যুত্থানের আগে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব যোগাযোগ সম্পর্কে লিফশুলজকে লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশীদ বলেন, জিয়াই আমাদের আশ্বস্ত করেছে যে, আমেরিকা আমাদের সঙ্গে আছে এবং অন্য কোনো তরফ থেকেও কোন বাঁধা আসবে না। এসব বিষয় জিয়াই দেখবেন বলে জানান রশীদ। কিসের ভিত্তিতে জিয়া তাদের আশ্বস্ত করেন, এ প্রশ্নের জবাবে রশীদ বলেন, তিনি পরিষ্কার জানতে পেরেছিলেন যে, মার্কিন কর্তৃপক্ষের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাথে জিয়ার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। তবে তিনি ওই কর্মকর্তার নাম জানেন না।

এছাড়াও লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশীদ ১৯৭৬ সালে ইংল্যান্ডের আইটিভি টেলিভিশনে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনাকালে সে সময়ের উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়ে তারা হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করলে জিয়া তাদের এগিয়ে যেতে বলেন এবং তাদের উৎসাহিত করে বলেন, তারা সফল হলে জিয়া তাদের সঙ্গেই থাকবেন। সাক্ষাৎকারের এ অনুষ্ঠানটি যুক্তরাজ্য এবং বাইরে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। সাক্ষাতকারটি নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক নেভিলে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। সেই সাক্ষাৎকারে মাসকারেনহাসকে তারা বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনায় উপরের সহযোগিতা পেতে একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার আশ্রয় এবং দিকনির্দেশনা দরকার ছিলো তাদের। তাই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া জুনিয়র অফিসাররা তৎকালীন আর্মির উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বেছে নেয়। এ বিষয়ে অন্যতম খুনি কর্নেল ফারুক মাসকারেনহাসকে ভিডিও সাক্ষাৎকারে আরও বলেন, 'আমাদের লীড করার জন্য জেনারেল জিয়াই ছিল মতাদর্শগত ভাবে যোগ্যতম ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি'।

হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জিয়ার সাথে ফারুক-রশীদের সাক্ষাৎ এবং আলোচনা যে বহুবার হয়েছে তার প্রমাণ মেলে রশীদের স্ত্রী জোবায়দা রশীদের একটি বক্তব্য থেকেও। তিনি বলেন, 'একদিন রাতে ফারুক জিয়ার বাসা থেকে ফিরে আমার স্বামীকে (রশীদ) জানায় যে, সরকার পরিবর্তন হলে জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চায়। শুধু তাই নয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে জিয়া আরও বলেন- এটি যদি সফল হয় তবে আমার কাছে এসো, আর যদি ব্যর্থ হয় তবে আমাকে জড়িত করো না'।

হত্যাকাণ্ডের সাথে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর সম্পৃক্ততার আরেকটি প্রমাণ মেলে হত্যাকাণ্ডের মাত্র সপ্তাহখানেক আগে ঢাকার একটি বাসায় সিআইএ স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরির সাথে জিয়াউর রহমানের বৈঠকের মাধ্যমে। চেরির বিশেষ আগ্রহে তৃতীয় পক্ষের একজনের বাড়িতে হয় সেই বৈঠকটি। সেখানে একমাত্র আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন সস্ত্রীক জিয়াউর রহমান। উপরমহলের কারো সম্মতি না থাকলে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীদের কারও সঙ্গে ওই সময়ে চেরির বৈঠকে বসা কিংবা কথা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। চেরি নিশ্চয়ই ওয়াশিংটন কিংবা ল্যাংলিতে সিআইএ সদরদপ্তরের নির্দেশমতো কাজ করছিলো তখন। ওই দিনের ঘটনার বিবরণের ভিত্তিতে লিফশুলজ দাবি করেন, জিয়া এবং চেরি একে অপরকে আগে থেকেই চেনেন বলে মনে হচ্ছিল।

তার ভাষ্য মতে, সেই রাতে ডিনারের আগে এবং পরে দীর্ঘ সময় ধরে চেরি-জিয়ার মাঝে নিমন্ত্রণকর্তার বাসার বাগানে বসে আলাদাভাবে কথোপকথন চলে। ওইসময়ে তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু কী হতে পারে তা নিশ্চয়ই একজন সচেতন মানুষের বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কারণ, জিয়া-চেরির সেই ডিনার কোনো সামাজিকতা সৌজন্যতামূলক সাক্ষাৎ ছিলো না। চেরি ভালো করেই বুঝেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে হলে জিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। লিফশুলজ তার অনুসন্ধানের ভিত্তিতে মন্তব্য করেন যে, প্রমাণ ক্রমবর্ধমানভাবে এই ইঙ্গিত দেয় যে জিয়া অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান স্থপতি ছিলেন এবং খোন্দকার মোশতাক আহমেদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।

সোজা কথায়, হাজার হাজার মাইলের পথ দূর থেকে কিসিঞ্জার-ভুট্টো আর ঢাকা থেকে রাষ্ট্রদূত বোষ্টার এবং সিআইএ স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরি মুজিব হত্যাকাণ্ড সরাসরি তদারকি করেছেন। এই আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীর দল তাদের এ দেশীয় ক্রীতদাসদের মাধ্যমে ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক, সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনাটি মঞ্চস্থ করেছিল। এদের সহায়তায় কৌশলে পেছন থেকে মূল ভূমিকাটা পালন করে গিয়েছিলেন জেনারেল জিয়া। তিনি বিরোধিতা করলে এই অভ্যুত্থান ঘটানো সম্ভবই ছিলো না কোনোদিন। তা না করে উল্টো তিনি অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া অফিসারদের বিভিন্ন সময়ে দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। প্রকাশ্যে কিছু না করলেও মূলত তিনিই ছিলেই নাটের গুরু। বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ থেকেও বোঝা যায়, অভ্যুত্থানের এ দেশীয় মূল কারিগরদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জিয়া। খন্দকার মুশতাকের চেয়ে তার ভূমিকা ছিল অনেক বড়।

লেখক : কবি।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।