মহাকাব্যের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

অধ্যাপক মেরিনা জাহান কবিতা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যার নামের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির আত্মপরিচয়। তিনি সেই মহান পুরুষ যাকে নিয়ে বাঙালির অহংকার কোনদিন শেষ হবে না। এমনই বিশাল ব্যক্তিত্ব তিনি মৃত্যুর চার দশক পরও তাঁকে আবিষ্কার করতে হয় নতুনভাবে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। নতুন সূর্যালোকে সূর্যের মতো চির ভাস্বর উজ্জ্বল নেতা ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে। মহানভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকে বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের প্রতিটি আন্দোলনে শেখ মুজিব ছিলেন অগ্রনায়ক। বাঙালির জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় একাত্তর, শ্রেষ্ঠ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ আর শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতির আত্মমর্যদার স্বীকৃতি, বাংলা ভাষার সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি এবং বাঙালি সংস্কৃতির উদ্বোধনের সংগ্রাম। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন মন্তব্য করেন “বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির বন্ধু ও অধিনায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবজাতির পথ-প্রদর্শক ও মহান নেতা- বিশ্ব শান্তিরপ্রতীক।” বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞা শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা, সব মানুষের মানবাধিকারের স্বীকৃতি।
বাংলাদেশের মাটিতে মৌলবাদ বা পাকিস্তানিদের অপতৎপরতা যত বাড়বে তত দ্রুত বাঙালিকে আশ্রয় খুঁজতে হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে। সেই সঙ্গে আশ্রয় খুঁজতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছে- যে মুক্তিযুদ্ধকে আমরা অন্তরে ধারণ করেছি পরম মমতা ও অহংকারে। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আমরা আমাদের শোকের সান্তনা ও সংগ্রামের সাহস পাই। তাই বাঙালিকে জানতে হলে, বাঙালির হাসি-কান্না আনন্দ বেদনাকে উপলব্ধি করতে হলে- আমাদের বার বার ফিরে যেতে হবে শেখ মুজিবের কাছে। এই মহানপ্রাণকে শ্রদ্ধা জানাতে বিশেষ কোন দলভুক্ত হবার প্রয়োজন আছে বলে, আমি মনে করিনা। হৃদয়ে যার বাংলাদেশ, যে বাঙালির হৃদয়ে দাসত্ব নেই, পরাধীনতা আর উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনা নেই-সেই বাঙালির কাছে বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর অহংকারের।
তিনি আজ আমাদের প্রত্যাহিকতায় মিশে আছেন- মিশে থাকবেন জাতির অগ্রযাত্রার প্রতিটি অনুভবে-সাহস, শক্তি ও অনুপ্রেরণা হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের ইতিহাসে অনির্বাণ শিখার মত। এই ভাষণ ঘরকুনো নিতান্ত ছাপোষা বাঙালিকে রূপান্তরিত করেছিল বীরের জাতিতে। পশ্চিমা দেশের পর্যবেক্ষকরা তাঁকে চিত্রিত করেন ‘পোয়েট অব পলিট্রিক্স’ তবে শেখ মুজিব একই সঙ্গে ছিলেন ‘পোয়েট অব হিউমোনিটি অ্যান্ড জাস্টিস’। রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা, ব্যক্তিত্বের সম্মোহনী শক্তি, ত্যাগ ও আদর্শ তাঁকে পরিণত করেছে ইতিহাসের অপ্রতিরোধ্য বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ কিংবদন্তিতে।
কলকাতার ছাত্র জীবনে শেখ মুজিব থাকতেন ইসলামিয়া হোস্টেলে। সেই হোস্টেল সুপার, দর্শণ শাস্ত্রের অধ্যাপক এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকা জগন্নাথ কলেজের বিখ্যাত অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান স্মতিকথামূলক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ছাত্র জীবনের একটি ঘটনার অভিযুক্ত মুজিব দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর সামনে। কিন্তু কৃতকর্মের সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা ও সরল স্বীকারোক্তি প্রদানের ব্যাপারে শেখ মুজিবের সৎসাহস ও ঋজুতা তাঁকে অভিভূত করেছিল। শেখ মুজিবের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও স্পষ্টবাদিতা বহুদর্শী অধ্যক্ষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের তরুণ বয়সের চারিত্রিক অবস্থান ও আত্মবিশ্বাসের কথা।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান আইন পরিষদে ঘোষণা করেন, পূর্ব পাকিস্তানীরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকেই মেনে নেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ মুজিব তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ কওে রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বিভিন্ন দাবি আদায়ের ধর্মঘট আন্দোলনের নেতৃত্বে যুক্ত হয়েছিলেন শেখ মুজিব। শাস্তি হিসেবে এ ব্যাপারে জড়িত ছাত্রদের কে জরিমানা করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অনেকেই জরিমানার শাস্তি মেনে নিয়ে ছাত্রত্ব বজায় রেখেছিলেন, কিন্তু শেখ মুজিব তীব্র প্রতিবাদে এ আদেশ প্রত্যাখান করায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।
১৯৫৫ সালে পাক- শাসকচক্রের ষড়যন্ত্রে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। তখনই পাকিস্তান গণপরিষদে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সেই পাকিস্তানি মনোবৃত্তির বিরোধিতা করে বলেছিলেন, “বাংলা শব্দটার একটা ইতিহাস আছে, আছে বাংলার ঐতিহ্য। এই নাম পরিবর্তন করতে চাইলে, সেখানকার জনগণের কাছে জিজ্ঞাসা করতে হবে, তারা নাম পরিবর্তনকে মেনে নেবে কিনা”। এরই অবিচল ধারাবাহিকতায়, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনাধীন অবস্থাতেও সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী সবাই ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯ এ শেখ মুজিব বলেছিলেন, “জনগনের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।”
বঙ্গবন্ধু নারীর প্রতি আস্থা ও সম্মান দেখিয়েছেন সবসময়। ১৯৭২, ২৬ মার্চ আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ের মহিলা ক্রীড়া সংস্থা অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, “ভাইরা আমার আপনারা যারা সংগ্রাম করে নেতা হন অথবা দেশের কর্ণধার হন- তাদেও মনে রাখা উচিত এর পেছনে মহিলাদের অবদান রয়েছে যথেষ্ট, তাই নারীদের যথাযথ সম্মান দিন”।
শেখ মুজিবের জীবনে সাফল্যের অন্তরালে বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিবের অবদান অতুলনীয়। বঙ্গবন্ধু বলতেন ‘আমার স্ত্রীর মতো সাহসী মেয়ে কমই দেখা যায়। আমাকে যখন‘পিন্ডির ফৌজ বা পুলিশ এসে জেলে নিয়ে যায়, আমার উপর নানা অত্যাচার করে, আমি কবে ছাড়া পেয়ে ফিওে আসবো তার কিছু ঠিক থাকেনা- কিন্তু আমার স্ত্রী কখনই ভেঙ্গে না পড়ে সবসময়ই দৃঢ় মনোবল নিয়ে সব কিছু সামাল দিয়েছে’।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গ্রন্থের প্রণেতা প্রফেসর মযহারুল ইসলাম তাঁর গ্রন্থটি লিখবার সময় বহুবার তাকে জাতির পিতার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে হয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু লেখককে বলেন, ‘আমার জীবনের দুটি বৃহৎ অবলম্বন আছে, একটি আমার আত্মবিশ্বাস, অপরটি বলুনতো কি? হঠাৎ এরকম প্রশ্নে লেখক বেশ হতচকিত হয়ে যান। তখন বঙ্গবন্ধু মৃদু হেসে বললেন, ‘অপরটি আমার স্ত্রী, আমার অকৈশোর গৃহিণী।’একজন সংগ্রামী রাজনৈতিক নেতার জীবনে এরকম স্ত্রী যে কত বড় আশীর্বাদ তা সহজেই অনুমেয়। বঙ্গবন্ধুর সাফল্যের বহুল অংশ এই গরীয়সী মহিলার প্রাপ্য। প্রতিবারই জেলে যাবার সময় বঙ্গবন্ধু ‘সঞ্চয়িতা’টা হাতে তুলে নিতেন। বইটার গায়ে পড়েছিল জেলের সেন্সরের অনেকগুলি সীল। রবীন্দ্র-নজরুলের প্রতি অনুরাগ সৌখিনতা নয়- এটা তার ব্যক্তি জীবনের খোরাক, মানসিক শক্তির উৎস। তাঁর যে জীবন রাজনৈতিক চেতনায় অভিষিক্ত, সে চেতনারই অভিব্যক্তি প্রকাশের প্রেরণা রবীন্দ্র-নজরুলের সাহিত্য।
পাকিস্তানিরা যে মুজিবকে হত্যা করতে পারেনি, তাঁকেই হত্যা করেছিল ষড়যন্ত্রে জড়িত কিছু বাঙালি বিপথগামী সেনারা। ঘাতকের উদ্যত বন্দুকের সামনে, অনিবার্য মৃত্যুর মুখেও সাহসী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন মুজিব। অবশ্যই বলা দরকার, পিঠে নয়, ঘাতকের গুলি লেগেছিল মুজিবের বুকেই। তবে নৃশংস প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতকেরা জানতো না, তাদের অস্ত্র কখনো বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠকে স্তব্ধ করতে পারবে না। তাঁর বজ্রকণ্ঠ চিরকাল ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হবে, বাঙালির হৃদয়ে, হৃদয়ে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন শোষিত-বঞ্চিত মানুষের প্রাণের গহীনে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন আমাদের লাল-সবুজ পতাকার ক্যানভাস জুড়ে, প্রতিটি বাঙালির মানস পিতা- জাতির পিতা হয়ে। সংগ্রামী কবি সিকান্দার আবু জাফর তাঁর কবিতায় লেখেন-
“মুক্তিকামী মানুষের শুভেচ্ছার পথে
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমান
ফিরে আসছেন বাংলাদেশে
করতালি মুখরিত পথে।”
বঙ্গবন্ধুর সবুজ বাংলা, বঙ্গবন্ধু কন্যার সুনীল বাংলা, এই সবুজে সুনীলেই আজ আমাদের সোনার বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অগ্রসরমান বাংলাদেশের ইতিহাস এখন ‘নতুনদিনের ভোরে’।
লেখক : সদস্য, কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী সংসদ, বাংলাদেশ আাওয়ামী লীগ ও সাবেক অধ্যক্ষ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, ঢাকা।
এইচআর/এমএস