মায়ের জন্য ভালোবাসা অকৃত্রিম

মাহমুদ আহমদ
মাহমুদ আহমদ মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০১:২৭ পিএম, ০৯ মে ২০২১

মহামারি করোনার কারণে পুরো বিশ্ব এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। এই দিনগুলোতে আমরা অনেকে আমাদের প্রিয় মাকে হারিয়েছি। অনেকে চাকুরির সুবাদে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছি কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও প্রিয় মায়ের সান্নিধ্য লাভ করতে পারছি না। প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্তে¡ও আমরা পারছি না প্রিয় মায়ের কাছে যেতে। বলা যায় সবাই এক কঠিন পরিস্থিতি পার করছি। তাইতো চেষ্টা করি কমপক্ষে প্রতিদিন একবার হলেও ফোনে মায়ের সাথে কথা বলার।

রাতে মার সাথে একবার ফোনে কথা না বললে সারা রাত যেন ঘুম আসে না। কোন দিন ফোন না দিলে মা নিজেই ফোন দিয়ে বলেন ‘বাবা আজ তো তুই ফোন দিলি না, শরীর ভালো তো?’ করোনার কারণে মা যেন আরো বেশি চিন্তিত হয়ে পরেছেন, বাহিরে যেন বের না হই, সাবধানতা অবলম্বন করি, ঘরে সব জিনিস আছে কি না আরো কত কিছু। আসলে মায়ের তুলনা হয় না।

মায়ের জন্য ভালোবাসা অকৃত্রিম। জন্মের পর প্রথম মায়ের স্পর্শ পেয়ে দেহ-মন শিহরণ জাগে মানব-দেহের। মা যেভাবে নি:শ্বার্ত ভালোবাসে তার সন্তানদের এমন ভালোবাসা কী পৃথিবীর আর কারো মাঝে পাওয়া যায়? মাকে ভালোবাসার জন্য কী কোন নির্দিষ্ট দিনক্ষণের প্রয়োজন আছে? জীবনের প্রতিটি দিনই সন্তানের জন্য মা দিবস, প্রতিটিক্ষণই সন্তানের জন্য মা দিবস। তাই কোন নির্দিষ্ট দিনে মাকে স্মরণ করার শিক্ষা ইসলাম দেয় না। মায়ের জন্য ভালোবাসা চিরন্তন, অনাবিল। সবারই মায়ের পাশে থাকতেই মন উচাটন। পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াময় মুখ মায়ের। মা শব্দটিতে যে পরিমাণ ভালোবাসা মিশে আছে তা আর কোনো শব্দেই নেই।

বুক ফেটে যায় কান্নায় যখন দেখতে পাই প্রিয় মা-বাবাকে রেখে আসা হয় বৃদ্ধাশ্রমে, করোনার কারণে মাকে ফেলে আসে গজারি বনে। মা দিবস আসলে বছরে একবার বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে গর্ভধারিণী মায়ের খোঁজ নেয় বা ফোনে ‘হাই-হ্যালো’ এ পর্যন্তই। আর অসহায় মা নীরবে বোবাকান্না কাঁদেন বৃদ্ধাশ্রমের চার দেয়ালে। অনাহারে অর্ধাহারে ভোগেন। কথা বলার মতো কেউ নেই। কোন বৃদ্ধাশ্রমে গেলে দেখা যায় সন্তানদের জন্য মায়ের কিযে বুক ভাঙা কান্না। খোকার মুখখানি একবার দেখার জন্য জানালার পাশে বশে কতই না অপেক্ষা। যে মা শত কষ্ট সহ্য করে, নিজে খেয়ে না খেয়ে আমাকে মানুষ করেছে সেই মাকে রেখেছি বৃদ্ধাশ্রমে।

পিতা-মাতার সেবা যত্ন, খোঁজ খবর শুধু এক দিনের জন্য নয় বরং সারা জীবনভর সেবা করার শিক্ষা সৃষ্টিকর্তা আমাদের দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, আর তোমার প্রভু-প্রতিপালক একমাত্র তারই ইবাদত করার এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার তাগিদপূর্ণ আদেশ দিয়েছেন। তোমার (জীবদ্দশায়) তাদের একজন বা উভয়েই বার্ধক্যে উপনীত হলে তুমি তাদের উদ্দেশ্যে বিরক্তিসূচক ‘উহ’-ও বলো না এবং তাদেরকে বকাঝকা করো না, বরং তাদের সাথে সদা বিনম্র ও সম্মানসূচক কথা বলো। আর তুমি মমতাভরে তাদের উভয়ের ওপর বিনয়ের ডানা মেলে ধর। আর দোয়ার সময় বলবে, ‘হে আমার প্রভু-প্রতিপালক! তুমি তাদের প্রতি সেভাবে দয়া করো যেভাবে শৈশবে তারা আমায় লালন-পালন করেছিল।’ (সুরা বনী ইসরাঈল : আয়াত ২৩-২৪)

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার একজন লোক মহানবির (সা.) কাছে জিজ্ঞাসা করেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! মানবজাতির মধ্যে কোন ব্যক্তি আমার নিকট সদয় ব্যবহার ও উত্তম সাহচর্যের সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত?’ উত্তরে তিনি (সা.) বললেন, ‘তোমার মা’। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞাসা করলো, ‘এবং তারপর?’ তিনি (সা.) উত্তর দিলেন, ‘তোমার মা’। লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করলো, ‘এবং তারপর’? তিনি (সা.) উত্তর দিলেন তোমার পিতা’। (বুখারি, মুসলিম) অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, ‘লোকটি জিজ্ঞাস করলো, হে আল্লাহর রাসুল! কোন ব্যক্তি আমার সাহচর্যের বেশি উপযুক্ত? তিনি (সা.) বললেন, ‘তোমার মা, তারপর তোমার মা, তারপর তোমার মা, তারপর তোমার পিতা, তারপর তোমার নিকটাত্মীয়গণ’ (বুখারি ও মুসলিম)।

মহানবী (সা.) সমাজে যেভাবে একজন নারীকে মা হিসাবে, স্ত্রী হিসাবে মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছেন তেমনি তিনি তাদেরকে দিয়েছেন সমঅধিকার। ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এতে নারী-পুরুষ সকলের অধিকারসমূহ সুষ্ঠু ও নির্ভুলভাবে বিন্যস্ত রয়েছে। বিশ্বনবী (সা.) একজন নারীকে মা হিসেবে যে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন, তার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া ভার। এছাড়া ইসলামে মা হিসেবে নারীকে যে উঁচু-মর্যাদা ও সম্মান দেয়া হয়েছে, অপর কোনো সম্মানের সাথে তার তুলনাও হতে পারে না।

মহানবী (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘বেহেশত মায়ের পায়ের পদতলে অবস্থিত।’ অর্থাৎ মাকে যথাযোগ্য সম্মান দিলে, তার উপযুক্ত খিদমত করলে এবং তার হক আদায় করলে সন্তান বেহেশত লাভ করতে পারে। অন্য কথায়, সন্তানের বেহেশত লাভ মায়ের খেদমতের ওপর নির্ভরশীল। মায়ের খেদমত না করলে কিংবা মা’র প্রতি কোনোরূপ খারাপ আচরণ করলে, মাকে কষ্ট ও দুঃখ দিলে সন্তান যত ইবাদত বন্দেগী আর নেক কাজই করুক না কেন, তার পক্ষে বেহেশত লাভ করা সম্ভবপর হবে না।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মাতাপিতার সন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং মাতাপিতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি নিহিত’ (তিরমিজি)। আরো উল্লেখ রয়েছে, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘এক ব্যক্তি মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি কি জিহাদ করব?’ তিনি বললেন, ‘তোমার পিতামাতা আছে কি?’ লোকটি জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আছে।’ হুজুর (সা.) বললেন, ‘তবে তাদের দু’জনের মাঝে জিহাদ কর। অর্থাৎ তাদের দু’জনের খেদমত কর’ (বুখারি, কিতাবুল আদব)।

পৃথিবীতে একজন মানুষের প্রতি অন্য যে মানুষের অবদান, দয়া ও সহানুভূতি সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন মা। অনেক ত্যাগ ও দুঃখ-কষ্ট করে একজন মা বড় করে তোলেন তার সন্তানকে। নিজে না খেয়ে সন্তানকে খেতে দেন। নিজে শত কষ্ট সহ্য করলেও সন্তানের সামান্য কষ্ট মা সহ্য করতে পারেন না। মাকে অসহ্যকর কষ্ট দিয়ে, মায়ের কোলে তিলে তিলে বড় হয়ে সেই মাকে ভুলে যাওয়ার খবর প্রতিনিয়ত পাওয়া যায়। এমন উন্মাদ সন্তানও রয়েছে যারা এই প্রিয় মা বাবাকে হত্যা পর্যন্ত করে। বড়ই কষ্ট হয়, যখন শুনতে পাই কোন সন্তান পিতা-মাতার গায়ে হাত উঠিয়েছে বা ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। যারা এমন করে তারা আসলে সন্তান নামে কলঙ্ক। তারা ইহকালেই জাহান্নাম অর্জন করে নেয়।

আমাদের সবাইকে বিবেক দিন, আমরা যেন আমাদের মাতা-পিতার সাথে উত্তম আচরণ করি এবং তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকি। বিশেষ করে করোনার এ দিনগুলোতে তাদের প্রতি আরো অধিক যত্নশীল হতে হবে। পিতামাতাকে ভালোবাসার জন্য কোন বিশেষ দিনের প্রয়োজন নেই বরং বছরের প্রতিটি দিন হোক আমার জন্য মা দিবস। বিশ্ব মা দিবসে সকল মায়ের প্রতি রইল শুভেচ্ছা।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।