লোডশেডিংয়ের এইটাও একটা বড় কারণ...

টেনশনে পেটের ভাত চাল হয়ে যাওয়া বলে একটা কথা আছে। আমার হয়েছে সেই দশা। সকাল থেকে যতবার লবণ বেগমের কাছে ফোন করেছি, ততবারই এক নারীকণ্ঠ বলে উঠেছে, দুঃখিত...।
জরুরি কিছু বিষয় নিয়ে লবণ বেগমের সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু যন্ত্রমানবী যেভাবে দুঃখ পাচ্ছে, এই দুঃখের সাগর পাড়ি দিয়ে লবণ বেগমকে হ্যালো বলতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। অফিস টাইম কোনোমতে পার করলাম। তারপর বাসায় ফিরেই লবণ বেগমকে জিজ্ঞেস করলাম,
: তোমার ফোনের কী হইছে?
: কিছু হয় নাই তো!
: তাইলে সারাদিন নো আনছার কেন?
লবণ বেগম সরাসরি এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটু রহস্য করল। বলল,
: তাসিনের আব্বু! এই জন্য কি তোমার খুব টেনশন হইছিল?
: টেনশন হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। বাচ্চাকাচ্চা লইয়া থাক...
: শুধু বাচ্চাকাচ্চার ব্যাপারেই টেনশন হইছে? আমারে লইয়া হয় নাই?
: না হওয়ার কোনো কারণ নাই। অবশ্যই হইছে।
লবণ বেগম আবারও রহস্য করল। তারপর বলল,
: যাক, এতদিন ভাবতাম-একটা পাথরের সঙ্গে ঘর-সংসার করতেছি। আমারে লইয়া তুমি টেনশন করছ শুইন্যা খুশি হইলাম।
লবণ বেগম খুশির সাগরে সাঁতার কাটলেও আমার অস্বস্তি দূর হচ্ছে না। নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোন ঘাপলা আছে। আমি বললাম,
: রহস্য না কইরা আসল কথা বল তো!
লবণ বেগম আসল কথার ধারে-কাছেও গেল না। সে তার চুলে বেণি করতে করতে বলল,
: রহস্যই তো নারীজাতির সম্বল। রহস্য না থাকলে কি নারীজাতির এত কদর থাকত?
কী কথার কী উত্তর! আমি বলছি আলু, আর লবণ বেগম বলছে খালু। আমার সন্দেহ এবার আরও বদ্ধমূল হলো, যা ভেবেছি, নিশ্চয়ই তাই ঘটেছে। হয় বাইরে কোথাও ফোন ফেলে এসেছে, নয়তো এটা বাচ্চাদের হাতের আছাড় খেয়ে বত্রিশ টুকরা হয়েছে। তা না হলে খই ভাজতে বসে সে এভাবে জিলাপি ভাজত না। লবণ বেগম বাউলি মেরে অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল। আমি তার হাত ধরে আমার পাশে বসালাম। তারপর বললাম,
: তাসিনের আম্মু! অতি সাধারণ একটা ব্যাপার লইয়া তুমি যেরকম মোচড়ামুচড়ি করতেছ, বিবাহের সময় কবুল বলতে যাইয়াও তো এইরকম কর নাই! ঘটনা কী?
বিয়ের স্মৃতি মনে পড়লে নারীরা কাতর হয়। লবণ বেগমের মধ্যেও এ কাতরতা দেখা গেল। স্মৃতির অতল জলে ডুব দিয়ে সে কী পেল জানি না, তবে মুখ দিয়ে ফোঁস দম বের হওয়ার শব্দ পেলাম। লবণ বেগম বলল,
: তখন তো আর বুঝতে পারি নাই, মোকাম্মেল আসলে একটা ফক্কামেল। বুঝতে পারলে নাচতে নাচতে আগ বাড়াইয়া কবুল বলতাম না...
বুমেরাং বলে এক ধরনের অস্ত্র আছে। এ অস্ত্র ছুড়ে দেওয়ার পর ঘুরতে ঘুরতে নিক্ষেপকারীর শরীরে এসেই আঘাত করে। নিজের ছুড়ে দেওয়া অস্ত্রের আঘাত মুখ বুজে সহ্য করলাম। ফক্কামেল দিয়ে লবণ বেগম কী বুঝাতে চাচ্ছে? মোকাম্মেল শব্দের অর্থ পরিপূর্ণ।
অভিধানে ফক্কা শব্দের অর্থ দেওয়া আছে ফাঁকা, কিছুই নয় এমন, ভুয়া। এসব শোনার পর রাস্তার একটা ফকিরও ফক্কা বিশেষণে আবৃত হতে চাইবে না। আমার অবস্থা তো একেবারে রাস্তার ফকিরের মতো নয়। তারপরও এই মূল্যায়ন? কষ্টে আমার চেহারা মলিন হয়ে গেল। লবণ বেগম অনিমেষ দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল,
: আরে পাগল, আমি তো এই কথা তোমারে ঠাট্টা কইরা বলছি। তুমি ঠাট্টা বোঝ না? শোন, ফোন কোথাও হারাইয়াও আসি নাই। পানিতে পইড়া নষ্টও হয় নাই। ঘরেই আছে। অফিস থেইক্যা আসছ, হাত-মুখ ধুইয়া ধীরস্থির হইয়া নাশতা-পানি খাও। তারপর বিষয় বৃত্তান্ত কী, তা জানার চেষ্টা কর। তা না কইরা এক ঠ্যাং দরজার বাইরে থাকতেই যদি কী হইল, কী হইল বইল্যা শোরগোল তোল, তাইলে তো কিছুটা বিসকাউস লাগবই!
নাশতা শেষ করে চায়ের কাপ হাতে নিতেই লবণ বেগম ফোনসেটটা পাশে রাখল। হাতে নিয়ে দেখলাম, সেটি বন্ধ। অবাক হয়ে বললাম,
: এইটা বন্ধ ক্যান?
: চার্জ শেষ হইয়া গেছে।
: চার্জ শেষ হইয়া গেলে চার্জ দিবা না!
: চার্জ দিতে গেছিলাম। হঠাৎ টেলিভিশনে দেখলাম, আগের রাতের একটা টক শো পুনঃপ্রচার হইতেছে...
: টক শো’র পুনঃপ্রচারের সঙ্গে ফোন চার্জ দেওয়ার কী সম্পর্ক?
: আহা, শুনই না! সেই টক শো’তে সরকারের একজন উপদেষ্টা স্যার উপস্থিত ছিলেন। তারে বলতে শুনলাম, দেশের মোবাইল ফোনগুলা চার্জ নেওয়ার সময় প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎ খাইয়া ফেলতেছে। বর্তমানে দেশে লোডশেডিংয়ের এইটাও একটা বড় কারণ। এই কথা শুইন্যা আমি আর ফোনে চার্জ দেই নাই।
দেশে বিদ্যুৎ সংকট বাইড়া যাওয়ার পেছনে মোবাইল ফোনেরও অবদান আছে, এইটা উনি উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হইছেন। কিন্তু কথা হইল, সামান্য মোবাইল ফোনের কামড়ই যদি আমাদের এনার্জি সেক্টর সহ্য করতে না পারে, তাইলে রেন্টাল, কুইক রেন্টালের নামে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিসাধন কইরা কাদের উপকার হইল, সেইটা দেখা দরকার?
লবণ বেগম জ্বালানি উপদেষ্টার পক্ষ নিয়ে আমার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিল। আমি অবাক হয়ে বললাম,
: কী ব্যাপার, উনি তোমার মামাশ্বশুর হন নাকি?
আমার কথায় লবণ বেগম বিরক্ত হলো। চোখ বড় করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল,
: বিদ্যুৎ উৎপাদন আগের চাইতে বাড়ছে, এই কথা তুমি স্বীকার কর তো!
: স্বীকার করলাম, কিন্তু তাতে আমার কী লাভ হইছে? আগে বিদ্যুৎ বিল দিতাম ৪০০ টাকা, এখন দিতে হয় ১২০০ টাকা। সারাজীবন শুইন্যা আসলাম, জিনিসের উৎপাদন বাড়লে দাম কমে, এই ক্ষেত্রে দেখতেছি নিয়ম উল্টা মারছে।
: উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি চাহিদাও তো বাড়ছে। চাহিদা বাড়লে জিনিসের দাম বাড়ব না?
লবণ বেগমের সঙ্গে বাহাস করতে গিয়ে আমার মনে হলো, আরে ধুর- এই সরকার আমার মামাতো ভাইও নয়; খালাতো ভাইও নয়। এদের এনার্জি সিস্টেম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নিজের শরীরের এনার্জি নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। আমি আলোচনার আলো নিভিয়ে দেওয়ার আগে লবণ বেগমের উদ্দেশে বললাম,
: শোন, চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ার সূত্রটা যদি মারোয়াড়িদের রাজত্বে কার্যকর হয়, তাইলে মনে কোনো দুঃখ থাকে না। কিন্তু যে সরকার নিজেদের জনগণের সরকার বইল্যা ডঙ্কা বাজায়, তাদের বেলায়ও যদি একইভাব দেখা যায়, তবে সে দুঃখ রাখি কোথায়?
লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর ।
basantabilas2021@gmail.com
এইচআর/ফারুক/এমএস