নিয়ন্ত্রণহীন শিক্ষার্থী সমাধান কোথায়?

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রকাশিত: ০৯:৫৫ এএম, ১২ মার্চ ২০২৩

আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি এখনো অজপাড়াগাঁয়ে থেকে সারা পৃথিবীতে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। তখন ভর্তিতে বয়সের বাধ্যবাধকতা না থাকায় দূরের গ্রাম থেকে পড়তে আসা আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়রা অনেকে আমার সহপাঠী ছিল। তাদের কেউ কেউ প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরুতেই পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে দিয়েছিল। সেই সহপাঠীদের অনেকে এখন এই ধরাধামে নেই।

আমরা সবাই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের ভয় পেতাম। তবে অপেক্ষাকৃতভাবে ‘হেড স্যারকে’ বেশি ভয় পেতাম। কারণ তাঁর পাঠে ঠিকমতো উত্তর দিতে না পারলে শাস্তি ছিল অবধারিত। সে শাস্তির ধরন অনেকটাই আলাদা ছিল। সেটা হলো ছোটদের দিয়ে বড়দের কানমলা দিয়ে দেওয়া। আকারে ছোটরা অনেক সময় লম্বা-বড়দের কান পর্যন্ত হাত পৌঁছাতে পারতো না। তখন তাদের নিচু হতে বলা হতো। কানমলা যাতে না লাগে সেজন্য কেউ কেউ কানে সরিষার তেল মেখে ক্লাসে আসতো।

কিন্তু একজন ছিল কিছুটা বখাটে। সে কানমলা খেতে মাথা নিচু করতে চাইতো না। একদিন সে ‘বাড়ির কাজ’ প্রস্তুত করে আনেনি। সেজন্য কানমলা খেতেও অনীহ ছিল। স্যার কয়েকবার মাথা নিচু হতে বললেও সে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। বার বার আদেশ অমান্য করায় স্যার ওর জন্য বাঁশের কাঁচা কঞ্চি আনতে বললেন আমাদের আরেক সহপাঠীকে। স্কুল লাগোয়া মাকলা বাঁশের ঝাড় থেকে দ্রুত একটি কঞ্চি ছিঁড়ে আনা হলো। এরপর শপাং শপাং মার। স্যার ওকে শাসন করে আমাদের সবাইকে সতর্ক করেছিলেন পড়াশোনায় ফাঁকি দিলে কি হতে পারে। কিন্তু মার দেওয়ার পর স্যার ওকে জড়িয়ে ধরে নিজেই কেঁদেছিলেন। আর বলছিলেন আমি তোদের মতো গাধাগুলোকে পিটিয়ে মানুষ বানাতে চাই। সেই মারের দৃশ্য আজও চোখে ভাসে। সে যুগে স্কুলের বাচ্চাদের শাস্তি দিলে অভিভাবক বা কেউ প্রতিবাদ করতে আসতো না। বাচ্চারাও কোনো গাফিলাতি বা অপরাধ করতে সাহস করাতো না। অতীতে বেপরোয়া শিক্ষার্থীদের শাসন ও ভালোবাসা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হতো।

আজকাল যুগের হাওয়া বিপরীত হয়েছে। পোড়োদের শাস্তি দেওয়ার নিয়ম উঠে গেছে। পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব, নৈতিক মূল্যবোধগুলো ঠিকমতো তাদের ভিতরে গড়ে ওঠে না। ফলে অপরাধ করতে ভয় পায় না। অভিভাবক ও শিক্ষকদের মোটেও ভয় পায় না। পড়াশোনাও ঠিকমতো করতে চায় না। তারা বাড়িতে মা-বাবার কথা শোনে না অন্যদিকে স্কুলের নিয়ম-কানুনও মানতে চায় না।

কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা কোনো শিক্ষার্থীর ওপর রাগ করলে এবং সেটা বাড়িতে গিয়ে তার অভিভাবকের কানে পৌঁছালে পরে দলবলসহ শিক্ষককে নাজেহাল করা হয়। শুধু প্রাথমিক বা হাইস্কুল কেন? কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গায় একই অবস্থা। শিক্ষকরা সরাসরি কোন শিক্ষার্থীর অন্যায় কাজের জন্য শাস্তি দিতে গিয়ে অজানা আতঙ্কে থাকেন। এজন্য বহুলাংশে দায়ী ছাত্ররাজনীতির নামে দলীয় লেজুড়বৃত্তিকরা রাজনীতির হীন স্বার্থ।

আমাদের সময় ছাত্ররাজনীতি ছিল ছাত্রকল্যাণের নিমিত্তে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের একটি প্ল্যাটফরম। ছাত্ররা ছিল ভলান্টিয়ার সেবাদানকারী। কোনো অন্যায় দেখলে তারা দল-মতের তোয়াক্কা না করে সব ছাত্রের কল্যাণে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তো। এখন সেটা অতি লাভজনক বৃত্তিতে পরিণত হয়েছে।

অনেকে মজা করে বলেন, এটা এখন ‘পিডিপি’র ন্যায় নতুন ‘পেট ধান্ধা পার্টিতে’ রূপ নিয়েছে। একটি রাজনৈতিক পদ নির্দিষ্ট কোনো কর্মছাড়া কতটুকু আয়ের পথ সুগম করে দেয় তার কোনো আসল চিত্র কেউ জানতে পারে না। কারণ কোনো সুনির্দিষ্ট চাকরি বা বৈধ আর্থিক উৎস না থাকা সত্ত্বেও এরা হরদম নতুন মডেলের গাড়ি, বাইক নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ালে বা মার্কেট, বাড়ি ইত্যাদি তৈরি করলেও এদের সম্পদ, বিষয় আশয় নিয়ে কর কর্তৃপক্ষ কোনো মাথা ঘামায় না। এদের এসব বিষয়ে কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই।

তবে এ নিয়ে সমালোচনার অন্ত নেই। কয়েক দশক ধরে সরকারি ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় ঢুকে পড়া ছাত্র নামধারী সংগঠনগুলো নৈরাজ্য সৃষ্টি ও অনেক বেশি অন্যায় কাজের সাথে জড়িত পড়ছে। সম্প্রতি বাংলা একাডেমির বইমেলায় আগতদের কাছে চাঁদাবাজির অভিযোগে হাতেনাতে গ্রেফতার ঢাবির দুই ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। রাবি, ইবি ও ইডেন কলেজের ঘটনা পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে।

বিভিন্ন কৌশলে নির্মাণ-ঠিকাদারির কাজ তাদের নিয়ন্ত্রণে। হলের সিট নিয়ে বাণিজ্য চালানো নির্যাতনের ঘটনা কতটুকু ভয়ংকর রূপ নিয়েছে তা সাম্প্রতিক বুয়েট, ইবি ও রাবির কিছু শিক্ষার্থীর নির্যাতনের ঘটনা থেকে আঁচ করা যেতে পারে। এছাড়া ক্যাম্পাসের আশেপাশের রেস্তোরাঁ মালিক ও হলের ডাইনিং কর্মীরা তাদের ফাও খাবার নিয়ে তটস্থ থাকেন সব সময়। কয়েকদিন আগে একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এক হোটেল মালিকের লাখ লাখ টাকা বাকি খাওয়ানোর ফলে ব্যবসায় দেউলিয়া হওয়ার সংবাদ দেশবাসী জেনেছিল।

সরকারি অফিসগুলোতে বিভিন্ন সমিতির নামে এসব পিডিপির দৌরাত্ম্য বেশ ভয়ংকর। নিয়োগ, প্রমোশন, বদলি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ পিডিপির অবিচ্ছেদ্য অংশ। জনবহুল ফুটপাতে দোকান, গাড়ি আটকে কাগজ নিয়ে বক্সে আসতে বলা, নির্মাণকাজের চাঁদা থেকে ভাগ-বাটোয়ারার বাণিজ্য নিচ থেকে উপরের লেভেলে সম্প্রসারিত। এরা বেপরোয়াভাবে চলে। কারণ এদের জন্য কোনো শাস্তির বিধান কোথাও নেই। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অসুস্থ রাজনীতির মাত্রাটা নির্যাতক ও নিপীড়কের বেশে বেশি দৃশ্যমান।

আজকাল হলগুলোতে রুমমেট বা শ্রেণিকক্ষের সহপাঠীরা তার সুপরিচিত ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে নিগৃহীত হতে দেখেও প্রতিকারের জন্য এগিয়ে আসে না। কারও কাছে বলতেও সহাস পায় না। কারণ, নিপীড়নের ভয়। পাছে কি যে ঘটে তার ভয় তাদের পেয়ে বসেছে। আজকাল অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক বা সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ করার প্রচেষ্টা অনেক কমে গেছে।

সামাজিক চাপ না থাকায় সহজে কোনো অপরাধের তদন্ত হয় না, রিপোর্ট বের হয় না। মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও গোপন একাউন্টে প্রতিবাদ করে। কারণ সেখানেও নিগৃহীত হওয়ার ভয় সৃষ্টি করা হয়েছে। এভাবে চারদিকে অপরাধীদের জন্য স্বর্গরাজ্য তৈরি করায় অপরাধীচক্র খুশিমনে বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তবে একসঙ্গে প্রতিবাদ করার সুযোগ না পেয়ে মানুষ প্রতিবাদের নানা নতুন কৌশল বের করেছে।

তবে কিছু মানুষ আছে যারা সৎ সাহস বুকে নিয়ে নীরবে প্রতিবাদ করছে। যেগুলো ইন্টারনেটের কল্যাণে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে তুলছে। গত বছর রেলের অনিয়মের বিরুদ্ধে ঢাবি ছাত্র মহিউদ্দিন একাই রেলস্টেশনে বসে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল। পাবিপ্রবিতে প্রমোশনের অনিয়ম ঠেকাতে একজন শিক্ষক একাই অনশন করেছেন। দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে প্রফেসর ফরিদউদ্দিন খান একাই লড়ে যাচ্ছেন।

প্রফেসর খান এটাকে সবার চোখের সামনে তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন মাত্র। কয়েক বছর ধরে তাঁর এই প্রচেষ্টা চলছে। এ পর্যন্ত তিনি একটি পদযাত্রা ও সাতটি প্রতীকী অনশনের মাধ্যমে বিভিন্ন অন্যায় ও নৈরাজ্যের প্রতিবাদ করেছেন। ২০১৮ সালে রাবি শহীদ জোহা চত্বরে চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের পক্ষে তিনি একক অনশন করেছিলেন।

সেসময় ছাত্র নামধারী দুষ্কৃতকারীরা আন্দোলনকারীদের একজনের মাজার হাড় ভেঙে দিয়েছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে তিনি শুরুতেই এর প্রতিবাদে ক্যাম্পাস থেকে রাজশাহী শহরের জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত পদযাত্রা করে প্রতিবাদ করেন। ধর্ষণের প্রতিবাদে এবং করোনার সময় সবকিছু খোলা থাকলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ এ নিয়ে অনশন করেন।

তাঁর ভাষ্য হলো ক্যাম্পাসগুলোতে ইদানীং যেসব নৈরাজ্যকর ঘটনা ঘটছে তা নিয়ে অভিভাবকরা বেশ শঙ্কিত। এসব ঘৃণ্য ঘটনায় কর্তৃপক্ষ শুধু মিটমাট করে দিয়ে ক্ষান্ত থাকে, কোনোরূপ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় বার বার এসব ঘটনা ঘটেই চলছে। হয়তো অনেকে বলতে পারেন, কেন আমি অতীতের কথা নিয়ে ভাবছি।

ভাবনার প্রধান কারণ হলো- আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার নামে আমরা চিরায়ত শাসন, স্নেহ-আদর, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ব্যবস্থা ভেঙে চুরমার করে দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে শিক্ষাশূন্যতা তৈরি করে ফেলেছি। অতীতে শিক্ষার্থীর পাঠে অমনোযোগিতা বা কোনো অন্যায় আচরণ দেখলে শিক্ষক তাদের শাসন করতেন আবার বেশি শাসন করে শারীরিক কষ্ট দিয়ে নিজেও কাঁদতেন।

এখনকার দিনে সেই সুযোগ নেই। আজকাল নেই শাসন, নেই স্নেহ-মমতা দেখানোর পরিস্থিতি। ‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে’- নামক উক্তিগুলো এখন মৃত। তাই তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ করতে এসে শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠছে হীন রাজনীতির শিকার ও ঠিকাদারের তল্পিবাহক। সারাবছর অবহেলা করে নিয়মিত পড়াশোনা না করে ও প্রযুক্তির অপব্যবহার করে তারা হয়ে উঠছে পাঠবৈরাগ্যে পারঙ্গম একাডেমিক চৌর্যবৃত্তির ধারক-বাহক।

অন্যদিকে রুমমেটদের জন্য নির্যাতক, নিপীড়ক এমনকি বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে সহপাঠীদের হন্তারক। এজন্য একবারে নিশ্চুপ না থেকে প্রফেসর ফরিদ খানের মতো বহু মানুষের জেগে ওঠা দরকার। তারা হতে পারেন ছাত্র-শিক্ষক, সাধারণ মানুষ সব শ্রেণি-পেশা থেকে এবং দ্রুত।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

এইচআর/এমএস

আজকাল নেই শাসন, নেই স্নেহ-মমতা দেখানোর পরিস্থিতি। ‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে’- নামক উক্তিগুলো এখন মৃত। তাই তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ করতে এসে শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠছে হীন রাজনীতির শিকার ও ঠিকাদারের তল্পিবাহক।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।