শওকত মাহমুদের বহিষ্কার ও দলের ভিতরের গণতন্ত্র

ইনসাফ কায়েম করতে গিয়ে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত সাংবাদিক শওকত মাহমুদ তবে কী বে-ইনসাফের শিকার হয়েছেন? প্রশ্নটি উঠেছে এ কারণে যে, শওকত মাহমুদ হঠাৎ উঠে আসা কোনো বিএনপি নেতা নন। ছাত্রজীবন থেকে এই দলের সাথে আছেন। জাতীয় প্রেসক্লাব, সাংবাদিক ইউনিয়ন, জাতীয়তাবাদী পেশাজীবী পরিষদসহ বিএনপি রাজনীতির প্রতিটি স্তরে আজীবন মনে প্রাণে এবং প্রকাশ্যে তিনি বিএনপিই করেছেন। একটা সময় সরাসরি দলে যোগ দিয়েছেন এবং ভাইস-চেয়ারম্যান পর্যন্ত পদও পেয়েছিলেন। সেই বিএনপি থেকে তিনি বহিষ্কৃত হয়েছেন এবং এ জন্য তাকে কোনো কারণ দর্শানোও হয়নি।
কেন তাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে তার কারণ তার সাম্প্রতিক তৎপরতা। আধা ডান, আধা বাম রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহারের সাথে একটি সংগঠন করতে গিয়ে তার কপাল পুড়েছে। ফরহাদ মজহারের সাথে মিলে পাঁচ তারকা হোটেলে নৈশভোজ করেছেন, ন্যাশনাল কমিটি ফর সিভিল রাইটস বা জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি নামের একটি সংগঠন তৈরির পরপরই তিনি বহিষ্কৃত হয়েছেন। এর আগে অন্তত দুই দফায় কারণ দর্শানোর নোটিশ পেলেও এবার বিএনপি তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে।
মূল কারণ সন্দেহ। কারণ হলো ফরহাদ-শওকত মিলে একসাথে নৈশভোজ করেছেন কেবল তা নয়, তারা সামনে এনেছেন যে রাজনৈতিক প্রস্তাব যা বিএনপির এখনকার আন্দোলন সংগ্রামের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছে দলের হাই কমান্ড। ফরহাদ-শওকত প্রস্তাব দিয়েছেন, নির্বাচনের আগে দেশের সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে এবং সেই সরকার নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে এবং তারপর জাতীয় নির্বাচন দেবে। এখানেই আসল বিরোধ।
বিএনপি চায় আগে নির্বাচন এবং সেটি হতে হবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। ইনসাফ কায়েম কমিটির প্রস্তাবের সাথে বিএনপির অবস্থানের এখানেই সাংঘর্ষিক অবস্থান। দল মনে করে, বিএনপির আন্দোলন নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিতেই এ ধরনের তৎপরতা চালানো হচ্ছে।
দল সেটা মনে করতেই পারে। কিন্তু কোনো প্রকার কারণ না দেখিয়ে এত পুরোনো একজন নেতাকে এভাবে বের করে দেওয়া যায়? বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিয়ে অনেক কথা প্রচলিত দেশের ভিতরে এবং বাইরে। কিন্তু, যে বিষয়টির উপর গণতন্ত্রের নির্ভর, সেই রাজনৈতিক দল-বিষয়ক আলোচনা কিংবা ভাবনাচিন্তা এ দেশে বেশ উদ্বেগজনক ভাবে অনুপস্থিত। অর্থাৎ দল চলে একেবারে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মত। দলীয় গঠনতন্ত্রের চালচলন সরাসরি গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত। সেটা যদি এমন হয় যে, যেকোনো সময় যে কাউকে নিয়োগ দেওয়া যায় বা বের করে দেওয়া যায় তাহলে সেই দল ক্ষমতায় গিয়ে কোন গণতন্ত্র কায়েম করবে?
শওকত মাহমুদ এখনও দলের বিরুদ্ধে তেমন কোনো জোরালো বক্তব্য রাখেননি। তবে একটা কথা শওকত মাহমুদ বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া দল প্রধান থাকতে পেশাজীবীদের বক্তব্য যেভাবে শোনা হতো, এখন দলে সেভাবে বক্তব্য শোনা হয় না। ইঙ্গিত স্পষ্ট যে তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন বিএনপিতে কথা বলার সুযোগ কম।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠীর প্রভাব সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। দলের ভেতরে এমনই কঠিন ব্যক্তি আধিপত্য যে, অধিকাংশ নেতা কর্মীকে বলতে হয় তারা বেশ গর্বিত একেকটি পরিবার বা ব্যক্তির প্রভাবে। বিএনপি অনেকদিন থেকেই দূর থেকে পরিচালিত। কোনো কর্মকাণ্ড, ঝড় বা সরকারি দমন মোকাবেলা না করেও রিমোট কন্ট্রোলে সব সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করছেন তারেক রহমান।
অনেক মতগোষ্ঠী ও জনগোষ্ঠীকে জায়গা দেওয়ার কাজটি করতে হয় রাজনৈতিক দলকে। এবং সেটি করতে হয় সম্মেলন ও নির্বাচনের মাধ্যমে। বাংলাদেশে এখন আর নির্বাচনের মাধ্যমে বড় কোনো দল বা দলের অঙ্গ সংগঠনের কমিটি গঠন করা হয় না। আওয়ামী লীগের মূল দলে বা কিছু জেলা উপজেলা পর্যায়ে সম্মেলন হলেও কমিটি হয় কেন্দ্রীয় নেতাদের ঘোষণায়। সেখানে পদ বাণিজ্যের ব্যাপক অভিযোগ দল থেকেই উচ্চারিত। ছাত্রলীগ বহু জেলা উপজেলা কমিটি করেছে প্রেস রিলিজ দিয়ে এবং সেটাতেও টাকা পয়সা লেনদেনের অজস্র অভিযোগ।
বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রই এমনভাবে করা যে, এগুলো একেকটা ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানি। পার্টি চেয়ারম্যানের হাতে এমন ক্ষমতা যে, তিনি যে কাউকে দলে যখন ইচ্ছা তখন নিয়োগ দিতে পারেন, মন চাইলে বের করেও দিতে পারেন। এবং এই দুটি দলে নির্বাচন তো দূরের কথা, সম্মেলনও ঠিক মতো হয় না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো বরাবরই ‘অগণতান্ত্রিকতা’র অভিযোগে স্নাত। প্রতিটি দলেই অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ ব্যাপকভাবে আছে। কিন্তু সেই ক্ষোভে একক সিদ্ধান্ত-ভিত্তিক পদ্ধতিকে নির্মূল বা হ্রাস করতে পারছে না। আমাদের নেতা নেত্রীরা মানুন না মানুন, তাদের দলসমূহ অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চায় বিশেষ রকম পিছিয়ে আছে। এ অবস্থা দীর্ঘদিন থাকলে রাজনৈতিকভাবে বহুদূর যাওয়া যায় না। তাই গণতন্ত্রের সাধনাটি দলগুলোতে নতুন করে বলবৎ হওয়া চাই। সেটা দলের স্বার্থে, সর্বোপরি দেশের স্বার্থে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এএসএম