সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনিকে কেন স্মরণ করা হয় না?

স্বদেশ রায়
স্বদেশ রায় স্বদেশ রায়
প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩

শেখ ফজলুল হক মনি কত বড় রাজনীতিক ছিলেন তা বিশ্লেষণ করার জন্য রাজনীতিকরা বেশি যোগ্য হবেন। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে জীবিতদের মধ্যে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমদই তার ঘনিষ্ঠ উত্তরসূরি আছেন। যদি প্রফেশনাল ভাবে কোনো ঐতিহাসিক শেখ ফজলুল হক মনির রাজনৈতিক জীবন নিয়ে কাজ করার জন্য এই দুজনের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতার মাধ্যমে একটা ইতিহাস বের করে আনার চেষ্টা করেন তাহলে শেখ ফজলুল হক মনির রাজনৈতিক জীবনের কিছুটা অংশ এখনও খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে।

এছাড়া মতিয়া চৌধুরী ও রাশেদ খান মেননের সঙ্গে আলাপচারিতা আরও কিছু যোগ হওয়া সম্ভব। বাস্তবে শেখ ফজলুল হক মনির জীবন নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রয়োজনীয় অংশ। কারণ, পূর্ব পাকিস্তান আমলের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বেশ কিছু মাইলস্টোন বাস্তবায়নের ইতিহাস শেখ ফজলুল হক মনিকে প্রকৃত গবেষণা না করে লিখলে সে ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

ঐতিহাসিকরা চাপা পড়া অনেক পাথরের নিচে থেকে ইতিহাস বের করে আনতে পারেন। তারপরেও যেমন আশির দশকে ভারতের কংগ্রেস নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি একদিন আলাপচারিতায় বলেছিলেন, তাদের সময়ে পৃথিবীর অন্যতম ব্রিলিয়ান্ট যুবনেতা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। ওই সময়ের কয়েকটি যুব নেতাদের কনফারেন্সের স্মৃতিও তিনি এ বিষয়ে উল্লেখ করেছিলেন। পরে কলকাতার মেয়র, সে সময়ের তরুণ নেতা সুব্রত মুখার্জী একবার বলেছিলেন, শেখ ফজলুল হক মনি তাদেরও নেতা ছিলেন। তার কাছ থেকে তাদের অনেক কিছু শেখার ছিল।

আজকের প্রজম্মের সাংবাদিকদের শেখ ফজলুল হক মনির লেখাগুলো বার বার পড়া দরকার এ কারণে যে, একজন সাংবাদিক ক্ষমতার কাছে থাকলেও তাকে সত্য কতটা সাহস করে বলতে হয় সেটা শেখার জন্যে। বাস্তবে ক্ষমতাসীনের হিতাকাঙ্ক্ষী হলে তাকে আরও বেশি সত্য বলতে হয়। কখনও শুধু ক্ষমতাসীনকে খুশি করার জন্য সাংবাদিকদের কথা বলতে নেই। আর এ কাজ যারা করে তারা বাস্তবে সরকার ও জনগণের ক্ষতি করে।

তবে সাংবাদিক হিসেবে আমার মনে একটা প্রশ্ন বার বার জাগে- গত ১৫ বছর একটানাভাবে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায়। এ সময়টা আর যাই হোক সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনিকে স্মরণ করার জন্য কোনো প্রতিকূল সময় নয়। তারপরও কেন ‘সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি’কে স্মরণ করা হয় না? শেখ ফজলুল হক মনির জম্মদিন তার তৈরি রাজনৈতিক সংগঠন যুবলীগই পালন করে। আর মৃত্যু দিবস পালিত হয় ১৫ আগস্টের শোকসভার সঙ্গে। অথচ ১৯৭৫ সালের ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক সাধারণ সভায় কিন্তু ওই কঠিন সময়েও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনির নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ঘটনাকে স্মরণ করে তার জন্য শোক প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল। আজ কেন সাংবাদিক নেতারা তাদের অগ্রজ এই পথপ্রদর্শক সাংবাদিকের জম্ম মৃত্যু দিবস পালনের উদ্যোগ নেন না, এ প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ শেখ ফজলুল হক মনি কেবল তিনটে পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন না, তিনি তার সময়ের অন্যতম কলামিস্ট ছিলেন।

শেখ ফজলুল হক মনির লেখাগুলো বর্তমান সাংবাদিকরা বা যারা কলাম লেখেন তাদের জন্য অনেক বড় শিক্ষণীয় একটি আধেয়। কারণ, একজন কলামিস্টের লেখা তখনই একটা লেখা হয়ে ওঠে- যখন ওই লেখার ভেতর দিয়ে মানুষ ওই ঘটনার ভবিষ্যৎ দেখতে পায় ও তার গভীরের নানান বিষয়ের প্রকৃত বিশ্লেষণ পায়। এমনকি অনেক সময় কলামিস্টদের উল্লেখ করা দিকগুলো গবেষকদের গবেষণার দিকও হয়ে ওঠে।

যেমন শেখ ফজলুল হক মনির লেখাগুলো যদি আজকের পাঠক ও সাংবাদিকরা মনোযোগের সঙ্গে পড়েন তাহলে দেখতে পাবেন, শেখ ফজলুল হক মনি বার বার তার লেখায় বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও তার জটিলতার কথা উল্লেখ করেছেন ওই সময়ে বসে। ১৯৭২, ৭৩, ৭৪ সালে বসেই তিনি বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক জটিলতা যখন উল্লেখ করেছিলেন সে সময়ে পৃথিবী দুই মেরুতে বিভক্ত ছিল- আজও পৃথিবী দুই মেরুতে বিভক্ত। শুধু মেরু ও মেরু প্রদেশের সঙ্গীদের বদল হয়েছে।

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক জটিলতা কিছুটা ভিন্নভাবে এসেছে- তবে তারপরেও বিশ্ব রাজনীতির নেতৃত্বও প্রতিবেশি সব মিলিয়ে সেদিনের বাস্তবতায় শেখ ফজলুল হক মনি তার বিভিন্ন লেখায় যে সক ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন আজও তা বাস্তবতা। যেমন আজও ভূ-রাজনৈতিক জটিলতার সব থেকে বড় বিষয়গুলোতে সামনে আসছে, সময়ের প্রয়োজনে বন্ধু নির্বাচন ও তাদের সঙ্গে আচরণ। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনে দক্ষতা। সে ক্ষেত্রে যে কয়টি বিষয় তিনি সেদিন সামনে এনেছিলেন তা আজও বর্তমান। অর্থাৎ সমুদ্র পথের নিরাপত্তা, বন্দরকেন্দ্রিক ভূ-রাজনৈতিক জটিলতা ও তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ও বাংলাদেশে তার প্রভাব। সর্বোপরি শেখ ফজলুল হক মনির লেখায় বার বারই গুরুত্বের সঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে প্রতিবেশীসহ আন্তর্জাতিক সব ক্ষেত্রে পিপল টু পিপল কূটনীতির কথা।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির পাশাপাশি তিনি দেশীয় সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে ওই সময়ে যেসব বিষয় সামনে এনেছিলেন, তা এখনো এ সমাজ ও রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশীয় ও রাজনীতির যে সব দিক তিনি ওই সময় বার বার সতর্ক করেছেন তার সব বিষয় একটি লেখায় বা একটি বক্তব্যে বলা সম্ভব নয়। তারপরও সেদিন তার উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ দিকের ভেতর অন্যতম যে বিষয়গুলো ছিল তা হলো সমাজ ও রাষ্ট্রে সৎ ও যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের আধিপত্য।

প্রশাসন ও ব্যবসায়ীরা যেন কোনো ক্রমেই রাষ্ট্র ও রাজনীতির পরিচালক না হয়ে ওঠেন। আর সমাজের মানসিকতার অত্যন্ত একটি সূক্ষ্ম দিক বার বার ইঙ্গিত করেছেন, সবখানে বড় বেশি তাড়াহুড়ো। সব পেশায় ওপরে ওঠার জন্যে এই তাড়াহুড়োর অসুস্থ প্রতিযোগিতা। অন্যদিকে ধনী হওেয়ারও অসুস্থ প্রতিযোগিতা।

এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা যে একদিকে সমাজের সব পেশায় যোগ্য হওয়ার স্থিরতা ও পরিবেশ নষ্ট করে তা আজ নিশ্চয়ই কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ঠিক তেমনি ধনী হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা একটি রাষ্ট্র ও তার আর্থিক ব্যবস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে। শেখ ফজলুল হক মনি ১৯৭২, ৭৩ সালেই এদিকগুলো উল্লেখ করেছিলেন বার বার।

সর্বোপরি, আজকের প্রজম্মের সাংবাদিকদের শেখ ফজলুল হক মনির লেখাগুলো বার বার পড়া দরকার এ কারণে যে, একজন সাংবাদিক ক্ষমতার কাছে থাকলেও তাকে সত্য কতটা সাহস করে বলতে হয় সেটা শেখার জন্যে। বাস্তবে ক্ষমতাসীনের হিতাকাকাঙ্ক্ষী হলে তাকে আরও বেশি সত্য বলতে হয়। কখনও শুধু ক্ষমতাসীনকে খুশি করার জন্য সাংবাদিকদের কথা বলতে নেই। আর এ কাজ যারা করে তারা বাস্তবে সরকার ও জনগণের ক্ষতি করে।

(গত ৪ ডিসেম্বর ছিল শেখ ফজলুল হক মনির ৮৪তম জম্মদিন। জম্মদিন উপলক্ষে যুবলীগ আয়োজিত স্মরণসভায় কিছু বলার কথা ছিল। কিন্তু অনিবার্য কারণবশত সেখানে যেতে পারিনি। ওই জনসভায় দু’কথা বলার জন্য যে নোট তৈরি করেছিলাম, তার কিছু অংশ নিয়ে সংক্ষিপ্ত এ লেখা তৈরি।- লেখক)

লেখক: সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।