সবার আগে বাংলাদেশ


প্রকাশিত: ০৩:৪১ এএম, ২০ জুন ২০১৭

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল ম্যাচ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে যে সাইবার যুদ্ধ দেখলাম তাতে খুবই অবাক হলাম। ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে আমরা বাংলাদেশ যেনো হারিয়ে গেলাম। অথচ এই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশ যে এত ভালো পারফরম্যান্স করলো তার জন্য মাতামাতি কমই দেখলাম। কোনো আইসিসি`র ট্রফির ইভেন্টে এই প্রথম বাংলাদেশ সেমি ফাইনাল খেললো। কত বড় অর্জন। আইসিসির র্যাং কিংএ আমরা ৬ এ উঠে আসলাম। এগুলো নিয়ে আলোচনা কমই হলো। কোনো দেশ, জাতি, দল বা ব্যক্তি একদিনে হুটহাট আলাদীনের প্রদীপের সাহায্যে অনেক কিছু করে ফেলতে পারে না। রাতারাতি অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে না। সুন্দর ভিশন, মিশন, সুষ্ট পরিকল্পনা ও দক্ষতার সাথে তা সম্পাদন করার মাধ্যমেই আস্তে আস্তে একটি দেশ, জাতি, দল বা কোনো ব্যক্তি এগিয়ে যায়।

বাংলাদেশ যেভাবে বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে এবং খেলাধুলায় বিশেষ করে ক্রিকেটে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে আশাহত হওয়ার কিছু নেই। আমি আমার বাংলাদেশ নিয়ে সুখি। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে অনেক জ্ঞ্যানীগুণি মানুষের স্ট্যাটাস দেখে অবাক হয়েছি। একসময় যখন বাংলাদেশ প্রত্যাশা অনুযায়ী খেলতে পারতো না, বা বড় টুর্নামেন্টের প্রথম দিকেই বাদ পড়তো তখন এদেশে অনেক বিদেশি দলের সমর্থক ছিল। এখন আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ নিজে একটি ক্রিকেট শক্তি। বাংলাদেশ যেকোনো সিরিজে এখন সমানে সমান লড়াই করে। শুধু যে লড়াই করে তা নয়, বাংলাদেশ লড়াই করে জিতেও। তবুও কেন বাংলাদেশে এখন ভারত পাকিস্তানের এত সমর্থক? এটা লজ্জার ব্যাপার। এটা হতাশার।

ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা অন্তত তাই জানি আমি। তবে দুঃখজনক হলো, খেলার প্রবল উত্তেজনায় হোক আর অন্য যে কারণেই হোক খেলাটি সবসময় ভদ্রতার গণ্ডির ভেতরে থাকেনি। অনেক সময়ই খেলাটিতে ভদ্রতার গণ্ডি ছাড়িয়ে অভদ্রতার প্রদর্শন হয়েছে। এর জন্য বিশ্বজুড়ে গুটিকয়েক খেলোয়াড়ের আচরণ দায়ী। এছাড়া কিছু অতি উৎসাহী সমর্থকদেরও দায়ী করা যায়। তবুও আমি মনে করি দিন শেষে খেলাটির গুটি কয়েক খেলোয়াড় আর সমর্থক ছাড়া সবাই ভদ্র। খেলাটি এখনও ভদ্রলোকেরই খেলা। তবুও কথা থেকে যায়।

বাংলাদেশের বিরাট অংশ একসময় ভারত পাকিস্তানের সমর্থক ছিলো।সমর্থন নিয়ে তাদের উচ্ছ্বাস দেখার মত। দুঃখজনক হলো তাদের এই উচ্ছ্বাস অনেকটাই উগ্রতায় ভরা। এখনও তাইই আছে। ফাইনালে অন্তত আমি তাইই দেখলাম। আমি ভাবতেও পারিনা এদেশের মানুষ অন্য দেশকে নিয়ে এত আবেগ, উত্তেজনায় ভোগে কিভাবে। তবুও তর্কের খাতিরে আমি মেনে নিচ্ছি যে খেলায় যেকোনো দেশকে সমর্থন করা অপরাধ নয়। কিন্তু অপ্রিয় হলেও একটা কথা আমাদের ভাবতে হব, এই দেশে পাকিস্তানকে সমর্থন করে কারা? পাকিস্তানকে কারা সমর্থন করে এর উত্তর আমাদের আশেপাশে চোখ ফেললেই পেয়ে যাবো। আজ পাকিস্তানের সমর্থকরা বলছে বাংলাদেশের সাথে ভারতের অভদ্র আর বিমাতা সুলভ আচরণ করে বলেই নাকি তারা পাকিস্তানকে সমর্থন করছে। ভারতের অধিনায়ক ভিরাট কোহলির একটি ভঙ্গির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি, আমাদের অন্যভাবে ভাবতে হবে।

ক্রিকেট বিশ্ব আজ বোঝে গেছে বাংলাদেশ লড়াই করে টিকতে পারে এমন একটা দল।বাংলাদেশ যেকোনো ম্যাচে যেকোনো দলকে হারানোর সামর্থ্য রাখে। বাংলাদেশকে খাটো করে দেখার মত কোনো কারণ নেই আর। ভারতের মত ক্রিকেট পরাশক্তির জন্য বাংলাদেশ কতটা চিন্তার ব্যাপার হলে সেদেশের অধিনায়ক আমাদের কোনো প্লেয়ার আউট হলে এত বাঁধছাড়া উদযাপন করতে পারে ভাবা উচিত। বাংলাদেশ ভারতকে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলো, ভারতের অধিনায়কের বাঁধছাড়া উদযাপনই তা প্রমাণ করে। এই ব্যাপারগুলো নিয়ে এত সিরিয়াস হয়ে যাওয়ার কিছু নেই আমাদের।

আমার দেশ বাংলাদেশ, আমরা বিশ্বের বুকে একটি শক্তিশালী ক্রিকেট দল। বাংলাদেশকে এখন আর অবহেলার চোখে দেখার সুযোগ নেই। তাইতো বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান আউট হলে যে যার মত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবে। সমর্থকদের রাগ হবে। সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার ঝড় উঠবে। তাতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ অন্য ক্রিকেটীয় পরাশক্তিদের মত বাংলাদেশকে হারানোও এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। তাই বলেই প্রতিপক্ষের এত বাঁধছাড়া উদযাপন, সমর্থকদের এত ক্ষোভ!

মনে রাখতে হবে বাংলাদেশকে ভারত হারিয়েছে এটা তাদের কোনো অপরাধ নয়। খেলার মাঠে প্রতিপক্ষকে হারানোই হলো খেলার উদ্দেশ্যে। ভারত ভালো খেলেই জিতেছে। বাংলাদেশ সেদিন পুরো ম্যাচ প্রত্যাশা অনুযায়ী খেলতে পারে নি। তাই বলে আমরা হেরে গেছি। তাতে ভারতের কোনো দোষ নয়। এর জন্য ভারতের বিরোধিতা করা আর পাকিস্তানকে সমর্থন করার ভিত্তি তৈরি হয় না। খেলার মাঠে যা ঘটে তা সমর্থকদেরও খেলোয়াড়িসুলভ মানসিকতায় দেখতে হবে। মাঠে যা হয় তা মাঠেই থাকা উচিত। তা নিয়ে উগ্রতার পরিচয় দেয়া উচিত নয়।

বিরাট কোহলির জিহ্বা যদি হয় ইস্যু তাহলে সেটা নিয়ে পরিমিত সমালোচনা করা যায়। আমরা যারা দর্শক তারা হয়তো বিরাট কোহলিকে খুব এগ্রেসিভ হিসেবে দেখি। বাস্তবে ও কেমন তা আমাদের প্লেয়াররা বলতে পারবে। কিন্তু ভিরাট কোহলি বাংলাদেশের বিপক্ষে কতটা চাপে থাকলে এরকম আচরণ করতে পারে তাও ভাবতে হবে। এখানে একটু বিষয় মনে করিয়ে দিতে চাই, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কুখ্যাত নিয়াজির ভাতিজা সদ্য রাজনীতিতে আসা পাকিস্তান দলের একসময়ের অধিনায়ক ইমরান খান বাংলাদেশ সম্পর্কে বলেছিলো বাংলাদেশ নাকি সেমি ফাইনেলে উঠায় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে। তখন কিন্তু এত ঝড় দেখিনি ফেসবুকে।

কতটা দেউলিয়াত্ব আমাদের মনে তা ফাইনালেরপর ফেসবুকে দেখলাম। তবে একটা কথা স্পষ্টভাবে আলোচনা করা দরকার, আপনি যখন একটা দেশকে সমর্থন করবেন তখন একবার ভেবে নিবেন আপনি সেই দেশের পতাকাকে সমর্থন করছেন। আর যে দেশকে সমর্থন করলেন তারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, ২ লক্ষ মা বোনকে ধর্ষণ করেছে। সে দেশটিকে সমর্থন দেয়ার আগে ভেবে নিতে হবে আপনারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করেন কি না। যদি স্বীকার করেন তাহলে কখনই পাকিস্তানকে কোনো যুক্তিতেই সমর্থন করা সম্ভব নয়।

আমি মনে করি, পাকিস্তানকে যারা সমর্থন করে তারা পারিবারিকভাবেই পাকিস্তানি সমর্থক। এদের পরিবার ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। কালের পরিবর্তনে হয়তো দেখায় তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে তবুও যখন তারা পাকিস্তানকে সমর্থন করে তখন তাদের অজান্তেই আসল পরিচয় বেরিয়ে আসে। পাকিস্তানের বিপক্ষে যেই খেলবে আমি তার পক্ষে। কেননা আমি সবসময় সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তানের পরাজয় কামনা করি। আমার বাংলাদেশকে যারা ক্ষতবিক্ষত করেছিলো আমি তাদেরকে নির্লজ্জের মত সমর্থন করতে পারি না। আমি মেনে নিতে পারি না তাদের পতাকাতে যখন আমাদের স্টেডিয়াম ছেয়ে যায়। সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার জন্য অনেক কিছু আছে। মানুষের ঈদে ঘরে ফেরার দুর্ভোগ, পাহাড়ে কান্না। আসুন আমরা একে অন্যকে সাহায্য করি। হয়তো আমরা কেউই একা অনেক কিছু করতে পারবো না। কিন্তু আমরা সবাই যে যার অবস্থান থেকে একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে অনেক বড় কিছু হয়ে যাবে।

লেখক : ডাইরেক্টর, রেডিও ঢোল, এফএম ৯৪.০ ফাউন্ডার, দ্যা লাভলি ফাউন্ডেশন।
[email protected]

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।