স্মৃতিকাব্যে মায়ের মুখ


প্রকাশিত: ০৩:৫৮ এএম, ২৭ জুন ২০১৭

মাকে মনে পড়তেই প্রথমেই স্মরণ করতে হয় মিল্টন খন্দকারের কথা ও সুরে সুগায়ক মনির খানের গাওয়া একটি গানের কয়েকটি লাইন-“এই সেই সুর/এই সেই খাট/বিছানার পাশে আছে পানের বাটা/চশমাটা পড়ে আছে পাশেই/শুধু মা নেই....শুধু মা নেই....।

আসলে ঠিকই আজ সবই আছে। নিজের বাড়ি হয়েছে, যে বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর মা নিজের হাতে করেছিলেন। আজ বাড়িতে আমরা সবাই আছি, কেবল মা নেই। তুমি নেই ৪২৭ ফিরোজা মঞ্জিলে। তুমি নেই কালামৃধায়, তুমি নেই কোথাও তুমি আজ কেবলই স্মৃতি, ঈদ এলে বেশি করে মনে পড়ে মাকে। তেমন করে আর কেউ আর কাছে ডাকে না, অতি স্নেহে কেউ খোকা বলে মুখে সেমাই তুলে দেয় না। ঈদের দিনে বহু ভবনে কিংবা নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করলেও মাকে সালাম করার সেই আনন্দ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ফলের মৌসুমে ফল কিনতে গেলে মাকে মনে পড়ে, বিদেশ থেকে দেশে ফিরলে মাকে মনে পড়ে। যে কোন সফলতায় মাকে মনে পড়ে। আনন্দ বেদনায় মাকে মনে পড়ে। প্রতিদিন ৪২৭ ফিরোজা মঞ্জিলের পাশ দিয়ে আসতে তোমাকে মনে পড়ে। ঐ বাড়িটায় তোমার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তিন ভাইয়ের সংসার ছিল তোমার আশ্রয়ে। সে কি কম সময় একটানা ২০টি বছর। সুখে দুঃখে আমরা ছিলাম একই ছাদের নিচে। তোমার স্নেহ ছায়ায় আমি, সিরাজ রানা, রাজীব, রাহুল, পলাশ, কবিতা, বকুল, পহৃর্নি, সাগর, কলি ও মঞ্জু। কি মধুর ছিল দিনগুলি। তোমার সেই শুভ কামনা আমার কেবলই মনে পড়ে।

মা সকল আপদ-বিপদে আমার জন্য উদ্বিগ্ন হতেন। দেশে কি বিদেশে ফাংশনে গেলে মা চিন্তায় থাকতেন, কখন নিরাপদে ফিরে আসি। চলা ফেরায়, কথা বার্তায় আরও সাবধান হতে বলতো। খ্যাতির অনেক বিড়ম্বনা, জনপ্রিয়তা অনেকের ঈর্ষার কারণ হতে পারে এ নিয়েও মায়ের অনেক ভাবনা ছিল। পর পর দু’বছর একুশে পদকের ঘোষণার তালিকা থেকে আমাকে যখন বাদ দেয়া হলো তখন মা দুঃখ পেয়েছিলেন, হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু তৃতীয় বারে অর্থাৎ ১৯৯৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী সচিবালয় থেকে অন্যতম পরিচালক বন্ধু ইকবাল যখন ফোনে আমাকে একুশে পদকপ্রাপ্তির সুসংবাদ অবগত করলেন তখন জানতে চাইলেন আমার মা জীবিত আছেন কি না, মা বেঁচে থাকলে তাকে এ খবর যেন আমি জানাই এবং স্বর্ণসেবিকা মাকে আমি যেন তার সালাম জানাই। মা খবর শুনে খুশি হয়েছিলেন। ওই বৎসরই মা নভেম্বরের ৩ তারিখে আমাদের ছেড়ে চির বিদায় নিলেন। এখন আর আগের মতো গ্রামের বাড়ি যাওয়ার আগ্রহ জাগে না।

মা নেই, বাবা নেই, কোনো আকর্ষণ নেই। এক সময় কলেজ জীবনে ঈদের বা পূজার ছুটি হলে সোজা ছুটে যেতাম মায়ের স্নেহমায়ায়। মা আমাকে কাছে পেয়ে কি সে খুশি হতেন। আজ সেই হাসনাহেনা ফুল গাছ আছে তোমার লাগানো আমগাছ, সুপারি গাছ, কাঁঠাল গাছ, পুকুর ঘাট ঠিক তেমনি আছে, কেবল তুমি নেই। তোমার সমাধি পাশে নারকেল বিথীতে চিড়ল চিড়ল হাওয়া তেমনি বইছে, বাঁশঝাড়ে বাতাসের হাহাকার জানিয়ে দিচ্ছে তুমি নেই। আজও উঠোনে অগ্রহায়ণে ধানের গন্ধ সুবাস ছড়ায়, রাতের কান্না হয়ে ঝরে শিশির, শিউলী ঝড়ে শরতে, তেমনি ফোটে জুঁই, চামেলি, তোমার প্রিয় বেলী, কিন্তু কেবল তুমি নেই কোথাও। আজ তোমার প্রিয় পন্ডিত কাকু নাই, ওয়াহেদু কাকু নাই। নাই ইদ্রিস কাকুর আজান, তাই বলে আজান থেমে নেই মনির হুজুর কিংবা ছিদ্দিক হুজুরের কণ্ঠে আজও ধ্বনিত হয় আজান, কেবল কোথাও নাই তুমি। তোমার কোন বোন আজ জীবিত নাই। একই চেহারার ঘোষগ্রামের খালাম্মাও আজ বেঁচে নেই। সে বেঁচে থাকলে আজ তার মধ্যে তোমাকে খুঁজে ফেরতাম। উৎসব আনন্দ অনুষ্ঠানে আমরা ভাইবোন একত্র হই, আমরা কেবল তোমার অভাব অনুভব করি। দেশে কি দেশের বাইরে কোথাও গেলে তোমাকে সালাম করে যেতাম। আর যাদু ফিরা আইছেনি বলে তুমি অপেক্ষায় থাকতে। সে আজ কেবলই স্মৃতি, আজ গানের অনুষ্ঠানে সামনের আসনটার দিকে তোমাকে খুঁজে ফিরি আর গেয়ে উঠি-
“মায়ের একধার দুধের দাম/ কাটিয়া গায়ের চাম। সেই মর্মস্পর্শী গানটি।

গান
সুর ও শিল্পী ফকির আলমগীর
মায়ের একধার দুধের দাম
কাটিয়া গায়ের চাম
পাপস বানাইলে ঋণের শোধ হবেনা
আমার মাগো।
পিতা আনন্দে মাতিয়া
সাগরে ফেলিয়া
সেই যে চইলা গেলা
ফিরা আইলোনা
মায়ে ধরিয়া জঠোরে
কত কষ্ট করে
দশ মাস দশ দিন পরে
পেল বেদনা।
এমন দরদী ভবে
কেউ হবে না আমার মাগো।
কি বলবো প্রসবের ব্যথা
মা বিনে সেই ব্যথা
কেউতো বুঝবেনা।
আমার মাগো।
মায়ে ঠেকিয়া সন্তানের দায়
অকালে মা প্রাণ হারায়
কেন সেই মায়ের ভক্তি রাখোনা
এমন দরদী ভবে কেউ হবেনা
আমার মাগো।

এই জগৎসংসারে মায়ের মতো আপন কি কেউ আছে? যার মা নেই তার কিছুই নেই। এই মাকে নিয়েই ১৯৭৮ সালে ঢাকায় সংসার গড়েছিলাম। তারপর স্ত্রী এলো, সন্তান এলো, ১৯৯৮ সালে পর্যন্ত দীর্ঘ বিশটি বছর আমাদের মায়ের আশ্রয়ে কেটেছে। এ সময়টা কত যে মধুর ছিল, কত যে আনন্দের ছিল তা কি কোন দিন আর ফিরে আসবে। বাবা চলে যাওয়ার পর ততটা মা বুঝতে দেননি। আজ মায়ের চির বিদায়ে যেন নিঃস্ব হলাম। মায়ের আদর ভালোবাসার কোন তুলনা হয় না বলেই শিল্প সাহিত্যে মমতাময়ী মা একটা চিরস্থায়ী আসন পেতে আছেন। মা-সন্তানের সম্পর্কের বিষয় নিয়ে তৈরি হয়েছে দারুণ সব চলচ্চিত্র, লেখা হয়েছে অবিস্মরণীয় সব সাহিত্য। এই মাকে নিয়ে কত কবিতা কত গান রচনা হয়েছে তা লিখে শেষ করা যাবে না। আমি কেবল এখানে বর্তমান প্রজন্মের প্রিয় গায়ক জেমসের ‘মা’ শীর্ষক একটি গান তুলে ধরছি-

“দশ মাস দশ দিন ধরে গর্বে ধারণ
কষ্টের তীব্রতায় করেছে আমায় লালন
হঠাৎ কোথায় না বলে হারিয়ে গেলে
জন্মান্তরের বাঁধন কোথায় হারালে
সবাই বলে ঐ আকাশে লুকিয়ে আছে।
খুঁজে দেখো পাবে দূর নক্ষত্র মাঝে।
রাতের তারা আমায় কি তুই বলতে পারিস
কোথায় আছে কেমন আছে মা
ও কে তোরা রাতের তারা মাকে
জানিয়ে দিস
অনেক কেঁদেছি আর কাঁদতে পারি না
মায়ের কোলে শুয়ে হারানো সে সুখ
অন্য মুখে খুঁজে ফিরি সেই প্রিয় মুখ
অনেক ঋণের জালে মা তো বেঁধে দিলে তাই
বিষাদের অভয়ারণ্যে ভয় শুধু পাই।”

এমনি, মাকে মনে পড়ে, মা আমার সাধ না মিটিল, মাগো মা, এমন একটা মা দেনা, মায়ের মত আপন কেহ নেই, মায়ের দেয়া মোটা কাপড় ইত্যাদি কত গান রচনা হয়েছে গীত হয়েছে মাকে নিয়ে দেশকে নিয়ে। মা যেন জন্মভূমিরই প্রতিচ্ছবি। মাকে নিয়ে আমি কত গান গেয়েছি। মায়ের একধার দুধের দাম কাটিয়া গায়ের চাম, পাপস বানাইলে ঋণের শোধ হবে না। এই গানটি গেয়ে দেশ-বিদেশে কত ভক্ত-শ্রোতাকে কাঁদিয়েছি। রেডিও, টেলিভিশন, ছায়াছবি, ক্যাসেটে গানটি শুনে ভক্ত-শ্রোতা আমাকে টেলিফোন করতো, চিঠি লিখতো, দেখা হলে জিজ্ঞেস করতো এই গানটি আপনি এতো দরদ দিয়ে গান, আপনার মাকি বেঁচে আছেন? নিশ্চয়ই মাকে হারিয়ে সেই বিয়োগ বেদনা ধারণ করে কেবল এমন জালজ্বয়ী গান গাওয়া সম্ভব। আপনার গান শুনলে আমাদের তাই মনে হয়। আমার মা বেঁচে আছেন বলে দেশ বিদেশের মঞ্চে ভক্ত-শ্রোতাদের অবগত করতাম। ২১টি বছর মা ঢাকায় আমার কাছে থেকেছেন আমার ৪৮তম জন্মদিনের কেক মুখে তুলে দিয়েছেন ২২ ফেরুয়ারি ১৯৯৮ তে। ১৯৯৭ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে আমার ‘অন্তরে গ্রাম’ ক্যাসেটের শুভ উদ্বোধন করেছেন তৎকালীন ক্রীড়া ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। শিল্পকলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান প্রমুখের উপস্থিতিতে।

এছাড়া ঋষিজের কত প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে, গুণীজন সংবর্ধনায়, একক কনসার্টে মা উপস্থিত থেকেছেন, আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। বিদেশে থেকে এলে বিমানবন্দরে মা আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন। যখন ঢাকার বাইরে গিয়েছি, দেশের বাইরে গিয়েছি, মাকে সালাম করে বের হয়েছি, মা পরম মমতায় আদর করছেন, দোয়া করছেন। গভীর রাতে মা নামাজ পড়ে চুপি চুপি কপালে হাত বুলিয়ে সুরা ইয়াছিন পড়ে ফুঁ দিয়েছেন। আমার সন্তান রানা, রাজীব, রাহুলকে আদর করতেন, তাদের জন্য দোয়া করতেন। সব সময় মাথায় হাত বুলিয়ে গায়ে ফুঁ দিতেন। সেই মায়ের অবস্থার অবনতির খবর আমাকে মোবাইলে ফোন করে জানালেন শ্রদ্ধেয় মেরী ভাবি। আমরা তিন ভাই তখনই অর্থাৎ ৩ নভেম্বর ’৯৯ ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানায় কালামৃধা গ্রামে রওনা হই। তখনও আমাদের বিশ্বাস মা বেঁচে আছেন। ফেরি পারাপারের প্রতিক‚লতা পাড়ি দিয়ে আমরা বিকেল ৫টায় গিয়ে বাড়ি পৌঁছাই। গিয়ে দেখি অন্য দুই ভাই-বোনের আত্মীয়-স্বজনরা সবাই মায়ের কফিন ঘিরে কান্না করছেন। শুনলাম মা ৩টায় মৃত্যুবরণ করেছেন। সবাই এই বলে সান্ত্বনা দিল বিকেল ৩টা পর্যন্ত তোমাদের জন্যই বেঁচে ছিলেন। এই প্রথম অনুভব করলাম যার মা নেই তার কিছুই নেই। চারদিক কেবলই শূন্য, কেবলই হাহাকার। এতদিন বার্ধক্যে থাকলেও ঢাকা থেকে মনে হতো আমার সব আছে। এখন মনে হয় আমার কিছুই নেই। মায়ের বিকল্প কি পৃথিবীতে আছে? আমার গান আমার জীবনে সত্য হলো ভক্ত-শ্রোতারা এখন থেকে জানবে আমার আর মা নেই। শোকের সাগরে ভাসিয়ে মা অসীম শূন্যে পাড়ি জমিয়েছেন।

এ মুহূর্তে মায়ের কত স্মৃতি মনে পড়ছে তা কি লিখে তুলে ধরা সম্ভব? তা কেবল সন্তানই বুঝবে। সামনে রমজান। আসবে ঈদ। কেবল মাকে পাবো না। ঢাকার বাসায় দেশের বাড়িতে আর পড়বে না তার পায়ের চিহ্ন। আর তাকে খুঁজে পাবো না ঢাকার কোন অনুষ্ঠানে। বিদেশ থেকে ফিরলে কিংবা কোথাও যাওয়ার পথে সালাম করতে আর মাকে পাবো না। দেখবে না তার পান খাওয়া হাসি হাসি টুক টুকে মুখ। ১৯৮৯ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর সেই শূন্যতাকে অনেকটা পূরণ করে মা ছিল আমার কাছে সব আনন্দ বেদনার সঙ্গী। এবার একুশে পদক পাওয়ার পর মা শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। রানা, রাজীব নাতি-নাতনিদের ভালো রেজাল্টে প্রাণভরে দোয়া করেছিলেন। মায়ের স্নেহের আশ্রয়ই আমরা এতোদিন জয়েন্ট ফ্যামিলিতে পরম আনন্দে বসবাস করছিলাম। ধর্মানুরাগী আমার মা ছিল অত্যন্ত সহজ সরল। অমায়িক ব্যবহারে সবাইকে মুগ্ধ করতেন। মা কারও মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলতেন না, আজ মায়ের সাথে কত আনন্দের স্মৃতির কথা মনে পড়ছে তা লিখে শেষ করা যাবে না। আমি কবি নই, মাকে নিয়ে কবিতা লিখবো, আমি চিত্রশিল্পী নই যে ছবি আঁকবো। দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের মাকে নিয়ে লেখা কবিতার মধ্যেই আমি খুঁজে পাই আমার মাকে। এই মহীয়সী নারীর স্মৃতি যেমন মনে রাখবে এলাকাবাসী, তেমনি তার পরিবারেরও কেউ কোন দিন ভুলবে না।

লেখক : গণসঙ্গীতশিল্পী।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।